বেজন্মা (দশম পর্বের পর)
সকালে ক্যাম্পে যোগ দিতেই এক বন্ধুর কাছে খবরটা পায়। তাদের ব্যাটেলিয়ানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশ্মীরে রাজৌরি জেলায় নৌশেরা সেক্টারে। অফিসারের সঙ্গে দেখা করে কৃষাণ।
“স্যরি কৃষাণ, তোমাকে ডেকে আনতে হলো। আসলে ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, আমাদেরকে চলে যেতে হবে কাশ্মীরের নৌশেরা সেক্টারে”।
“স্যার একটা খবর দেওয়ার ছিল। এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, যে জানাতে পারলাম না। মানে, দুম করে বন্ধুরা বিয়েটা দিয়ে দিল স্যার”।
“কনগ্রাচুলেশন! খুব ভালো খবর। একটা কাজের কাজ করেছো তুমি। এবার তোমার মনমরা ভাবটা যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ”।
“আসলে বিয়ের দিনেই খবরটা পাই, স্যার। খবর পেয়েই চলে আসতে হল…। আসার সময় রাবেয়া, মানে আমার স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছিল”।
“ঠিক আছে, নৌশেরা সেক্টারে জয়েন করো, দেখি তোমাকে ছুটির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা…”।
#
ভূস্বর্গ কাশ্মীর!! ট্রেন থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস কাঁপিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি গরম জামাকাপড় পরে স্টেশনের বাইরে এলো কৃষাণ। শ্রীনগরে যেতে চোখে পড়লো ছোট বড় সবুজ কার্পেটে মোড়া পাহাড়ের চূড়ায় কে যেন ঢেলে দিয়েছে শুভ্র তুষারের রেণু।
ভ্যান থেকে নেমে চারিদিক তাকায় কৃষাণ। সবুজ কার্পেটে মোড়া ঢেউ খেলানো জমিনে ছোট ছোট বেগুনী, হলুদ, সাদার বিচিত্র কারুকাজ, আসমানি আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, এক পাশে পাইনের সারি আর এক পাশে পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের তুষারাবৃত শিখর। স্বর্গ যেন ধরা দিল তার কাছে। বিস্ময়ে পাথরের মূর্তির মত তাকিয়ে থাকে কৃষাণ। পরক্ষণে মনে পড়ে রাবেয়ার কথা, যদি তাকে পাশে পেতো, তাহলে স্বর্গের এই সৌন্দর্য আরো বেশী করে ধরা দিত।
প্রায় পাঁচ মাস রাজৌরিতে থাকার পর পনেরো দিনের জন্য ছুটি পেয়ে যায় কৃষাণ। অবশ্য এর জন্য তার অফিসারের কৃতিত্বও কম নয়।
যাওয়ার পথে শ্রীনগরে কয়েকটা শাল, সোয়েটার, আর কার্ডিগান কিনে নেয় কৃষাণ। গত তিনমাস প্রতিদিন হয় রাবেয়া ফোন করেছে অথবা কৃষাণ ফোন করেছে রাবেয়াকে। সিংজী ও মানিকদাকেও ফোন করেছে কয়েকবার। মানিকদা জানিয়েছে রাবেয়ার ভর্তির বিষয়টা ঠিক হয়ে গেছে। সিংজী জানিয়েছেন, ফর্মে অবিভাবক হিসাবে তিনিই সই করবেন ।
রোববার জম্মু থেকে রাত সাড়ে দশটায় হিমগিরি এক্সপ্রেস ধরে কৃষাণ। প্রায় ছত্রিশ, সাঁত্রিশ ঘন্টার জার্নি…। এই ছত্রিশ সাঁত্রিশ ঘন্টা রাবেয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই কেটে যায়, পরিচয় সময়, একসঙ্গে বেড়ানো, মনাচিতোর থেকে তুলে নিয়ে আসা, সব…সব…। এতদিন নিজেকে দুর্ভাগা বলেই ভেবে এসেছে। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বোধহয় সে। তার আপন ভাইয়ের মতো বন্ধুরা, পিতৃস্থানীয় সিংজী, এমন পরিবার ক’জনের আছে! ভেবেছিল কাউকে না জানিয়ে সবাইকে চমকে দেবে। অনেক ভেবে সিংজী আর মানিকদাকে ফোন করে জানায়। সিংজী আর মানিকদাকে বলে দেয়, কাউকে না জানিয়ে কোনও ভাবে রাবেয়াকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় হাওড়ায় নিয়ে আসতে।
মঙ্গলবার সকাল, এবারে একটু লটবহর বেড়েছে…। দূর থেকে দেখে সিংজী, মানিকদা আর বিদ্যাভাবীর হাত ধরে কথা বলতে আসছে রাবেয়া। সিংজীই দূর থেকে হাত তোলে। সেটা লক্ষ করে রাবেয়া তাকায় তার দিকে…। কৃষাণ দেখে বিদ্যাভাবীর হাত ছেড়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় রাবেয়া। স্থান কাল ভুলে কৃষাণেকে ধরে কেঁদে ফেলে। ট্রেনের যাত্রীরা তাকায় তার দিকে। বিদ্যাভাবী এসে ধরে রাবেয়াকে, পেছনে সিংজী আর মানিকদা হাসতে থাকে। মিনিট খানিক পরে নিজেকে সামলে নেয় রাবেয়া।
“খারাপ, খুব খারাপ, খবর দিলে কী হতো? কেউ জানায় নি আমাকে…”। অভিমান ঝড়ে পড়লো কথায়।
“খবর দিলে তোমার এমন অবস্থা দেখতে পেতাম কী করে?” কৃষাণের কথায় হাঃ হাঃ করে হাসেন সিংজী।
“চল বেটা, আভি ঘর চল… তেরা টিকট হো গেয়া”। মানিকদা এসে জোর করে কৃষাণে সুটকেসটা তুলে নেয়।
ট্রেনে যেতে যেতে রাবেয়া বলে যে, সিংজী আর মানিকদা তাকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে এসেছে। লাভপুরের এক স্কুলের বন্ধুকে দিয়ে মনাচিতোরের বাড়ী দেখতে পাঠিয়েছিল। সে জানিয়েছে, দরজা বন্ধ, তবে বাড়ীর দরজার সামনে পার্টির ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো…।
দেখতে দেখতে দশ বারো দিন কেটে যায়। রোজ বিকেল হলেই রাবেয়াকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। ছুটির দিনে কলকাতার নানান দর্শনীয় স্থানেও নিয়ে গেছে রাবেয়াকে। মাঝে মধ্যে বিল্লুরাও সঙ্গ নিয়েছে তাদের। কয়েকদিনের জন্য নান্টা, শ্যাম আর জোর করেই সিংজী আর ভাবিকে নিয়ে দীঘায় ঘুরে এসেছে। বিল্লুর একটা বাড়ি ভাড়ার খবর এনেছিল, সিংজীদের প্রচন্ড আপত্তিতে তা বাতিল হয়েছে। রাবেয়া আর আম্মু সকলের সঙ্গে মিশে গেছে দেখে কৃষাণও নিশ্চিন্ত হয়েছে অনেকটা। ফিরে যাবার আগের দিন রাবেয়া সবাইকে নেমতন্ন করে খাইয়েছে, অবশ্য আম্মু আর বিদ্যাভাবী হাতে হাতে কাজ করেছেন।
#
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়। বছরে দুবার ফোর্স থেকে ছুটি নিয়ে আসে। সকলে মিলে হৈ হৈ করে কাটায় দিনগুলি। রাবেয়া ভালোভাবে হাইয়ার সেকেন্ডারী পাশ করে এখন কলেজ ছাত্রী। কৃষাণেরও পদোন্নতি ঘটেছে।
একদিন নৌশেরা সেক্টারে রাতে পেট্রোলিং সময় গোপন সুত্রে খবর পায় কৃষাণ। সঙ্গীদের নিয়ে সন্তর্পণে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এগোতেই হঠাৎ চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি আর প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে পড়ে কৃষাণ ও সঙ্গীসাথিরা। চারিদিক দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শব্দ…, কোনও কিছু বোঝার আগেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে, জ্ঞান হারায় কৃষাণ।
রাজৌরি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কৃষাণ। ধীরে ধীরে চোখ মেলেই দেখে রাবেয়াকে। তার চারদিকে দাঁড়িয়ে সিংজী, ভাবী, মানিকদা বিল্লু…। মনে পরে যায় সেই রাতের কথা। উঠতে গিয়েও ডান পায়ের যন্ত্রণায় উঠতে পারে না। তাড়াতাড়ি সিংজী এগিয়ে এসে ধরে ফেলে। রাবেয়ার দিক তাকিয়ে হাসে কৃষাণ। রাবেয়া এগিয়ে এসে হাত ধরে কৃষাণের পাশে বসে। কয়েক ফোঁটা জল পড়ে কৃষাণের হাতে।
“বেটা, তেরে লিয়ে বহু দো’দিন ঠিক সে খানা নেহি খায়া”।
“জানো, এনারাও দুই দিন ঠিক মতো খায় নি”। বলতে বলতে লেফটেন্যান্ট এসে সামনে দাঁড়ায়।
“কেমন আছেন এখন? অল্প বয়সী বাঙ্গালী যুবক। কৃষাণ সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। হাতজোড় করে নমস্কার করে লেফটেন্যান্ট।
“ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এলাম। এমনিতে মারাত্মক কিছু হয় নি, তবে মাইন বিস্ফোরণে ডান পা সাংঘাতিক ভাবে ফ্র্যাকচার হয়েছে। আগামীকাল অথবা পরশু একটা অপারেশন হবে। তারপর একমাস বিশ্রাম…”।
কৃষাণের অপারেশনের পর রাবেয়াকে নিয়ে ফিয়ে যায় সবাই। যদিও রাবেয়া থেকে যেতে চাইছিলো…। কৃষাণ অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে সক্ষম হয়।
“একটু ভাবো রাবেয়া, এখানে থাকার মত জায়গা নেই, তুমি একা একা হোটেলে কী করে থাকবে? তোমার জন্য কাজ ক্ষতি করে কে থাকবে? একটু বোঝার চেষ্টা করো”।
“তার চেয়ে বরং তোকে দেখাশোনা করার জন্য আমি থেকে যাই। কী বলিস কৃষাণ”? বিল্লুর কথায় হেসে ফেলে কৃষাণ। মানিকদা বিল্লুর কান টেনে ধরে…।
“এটা কী বললি, তোর কি আর বুদ্ধি হবে না? তোর থাকা আর রাবেয়ার থাকা কি এক হোল? আর তোকে রাখলে মমতাজ আমাদের আস্ত রাখবে? আমাদের এই বিল্লুটা আর পালটালো না”। মানিকদা কথা শুনে রাবেয়া ফিক করে হেসে ফেলে। তাই দেখে সকলে নিশ্চিন্ত হয়…।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন