শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

অমিতাভ সরকার

                                     


  বেজন্মা ( সপ্তম পর্বের পর)


“পিসিমা…, রাবেয়া…” দাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় কৃষাণ। দুজনেই বেরিয়ে আসে। কৃষাণ মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দেয়।

“গতকাল আনতে পারিনি, আপনাদের খুঁজে পাবো কিনা, বুঝতে পারিনি, তাই…”।    

“এই সব কেন আনতে গেলে বাবা। দাঁড়াও একটু চা করি”। বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢোকে ভদ্রমহিলা। কৃষাণ রাবেয়ার দিকে তাকায়। বিছানার এককোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চাদরে ওপর হাত বোলায় রাবেয়া, যেন কথা বলার জন্য বিষয় খুঁজছে সে। কৃষাণই নিরাবতা ভাঙে…।    

“আজ তোমার দাদার সঙ্গে কথা বললাম। কথা বলবে…? মাথা নাড়ায় রাবেয়া।  

“আমি তো কোনদিন দেখিই নি, কী বলবো?    

“জানো গতকাল বিকেলটা খুব আনন্দে কাটালাম তোমার সঙ্গে…। যখনই মনে হবে ফোন করো। অবশ্য সবসময় আমাকে নাও পেতে পারো। ডিউটিতে থাকলে পাবে না, তবে মিসড কল হয়ে থাকলে, পরে সময় মতো ফোন করে নিতে পারি”। কথা বলতে বলতে চা নিয়ে ভদ্রমহিলা ঢোকে। কৃষাণ শামসুদ্দিনের বাবাকে ফোন করে। ভাগ্যক্রমে একবারেই ফোন লেগে যায় কৃষাণের।   

“হ্যালো… হ্যাঁ, আমি কৃষাণ বলছি চাচা। এই নিন আপনার বোনের সঙ্গে কথা বলুন”। ফোনটা ধরিয়ে দেয় রাবেয়ার মা’কে।   

“হ্যালো…ভাইজান…” শামসুদ্দিনের বাবার গলা শুনে কেঁদে ফেলেন ভদ্রমহিলা। কথা বলতে গলা ভার হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। কয়েক মিনিট কথা পর আঁচলে চোখ মুছে মোবাইল ফেরত দিতে উঠে দাঁড়ায় কৃষাণ…।        

“পিসিমা, রাবেয়াকে ফোন নম্বর দিয়েছি, প্রয়োজনে ফোন করবেন। যদি সে রকম প্রয়োজন হয়, আমি চলে আসতে পারি। এখন থেকে মনে রাখবেন, আপনারা একা নন, আপনার এই ছেলে আছে”। ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করে দাওয়ায় নেমে আসে কৃষাণ।  

“রাবেয়া এখানে একটু থাক, আমি কৃষাণকে এগিয়ে দিয়ে আসি”। গায়ে একটা সাদা ওড়না জড়িয়ে চটি পরে কৃষাণের সঙ্গ নেয় ভদ্রমহিলা।    

“কৃষাণ, একটা দিনেই কত আপন হয়ে গেছো তুমি। গতকাল ফিরে এসে রাবেয়া শুধু তোমার কথাই বলেছে।" 

“আমার কাছেও একটা দিন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এত যত্ন জীবনে কোথাও পাই নি। রাবেয়া খুব ভালো মেয়ে। পড়াশোনা করে আত্মনির্ভর হতে চায় সে। বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করতে দিন। আমার ফোন নম্বর তো রইল রাবেয়ার কাছে, কিছু যদি দরকার হয় জানাবেন”।   

“জানিই না কতদূর পড়াতে পারবো। মেয়ে বড় হয়েছে, লাভপুরের অবস্থাপন্ন কয়েকজন বারবার এসে জ্বালাতন করে। সবারই ঘরে বিবি রয়েছে, তবু…” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পরে ভদ্রমহিলার। কী বলবে বুঝতে পারে না কৃষাণ।   

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করব কৃষাণ? কিছু মনে করো না… 

“বলুন না পিসিমা, এত দ্বিধা করছেন কেন? আমি তো মাকে দেখিনি কোনদিন, আপনার মধ্যেই আমি মা’কে দেখেছি”। 

“বলছিলাম কি… তুমি তো হিন্দু…? কথাটা শুনে হেসে ফেলে কৃষাণ। 

“আমার কোনও জাত নেই পিসিমা। তাই পদবিও নেই। এই ধর্মই তো যত নষ্টের মূল। ধর্মের ধ্বজাধারীরা বাধা দেয় আমাদের এক হতে। তাই ওসবে আমার বিশ্বাস নেই। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন পিসিমা?”    

“মানে, তুমি যদি রাবেয়ার দায়িত্ব নাও, তাহলে ওই শয়তানদের হাত থেকে মেয়েটা বাঁচে। আমিও নিশ্চিন্তে মরতে পারি। অবশ্য তোমার যদি কোনও আপত্তি না থাকে”। ভদ্রমহিলার কথায় কৃষাণের কালীপ্রসন্ন বাবুর কথা মনে পড়ে গেল… ‘বন্ধুকে বলুন এঁদের এখান থেকে নিয়ে যেতে, মেয়ে বড় হচ্ছে…পরিস্থিতি ভালো নয়’, উনি কী বলতে চাইছিলেন?’ 

“ঠিক আছে পিসিমা, একটু ভেবে নেই, একবার শামসুদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। আর তা ছাড়া আমার সব কথাও রাবেয়ার জানা দরকার। রাবেয়ার মতামতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।   

“ওর আবার কিসের মতামত? তোমার মতো ছেলে…”।  

“না পিসিমা, এটা ঠিক নয়। রাবেয়ার মতামতই আগে দরকার। ভবিষ্যতের কত কী ভেবে রেখেছে সে। তার সঙ্গে আগে কথা বলুন, তারপর আমাকে জানাবেন। ও হ্যাঁ, একটা ফোন নম্বর দিন, যেখানে আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি”।    

“আমাদের তো ফোন নেই বাবা, আমি বরং দিন সাতেক পর তোমাকে ফোন করবো”। কথা বলতে বলতে তারা গ্রামে ঢোকার পথে বটগাছ তলায় এসে পৌঁছায়।   

“অনেক দূরে চলে এসেছেন, এবার আপনি ফিরে যান পিসিমা। চিন্তা করবেন না, আমি অবশ্যই আপনাকে জানাবো” ভদ্রমহিলাকে বিদায় দিয়ে দ্রুত পায়ে এগোয় কৃষাণ। সব শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। রাবেয়ার জন্য দুশ্চিন্তা মাথায় জমা হয়। “কৃষানদা…” মহিলা কন্ঠে ডাক শুনে পেছনে তাকায় কৃষাণ। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে আসছে রাবেয়া।  কৃষাণের সামনে এসে সাইকেল থেকে নেমে হাঁপাতে থাকে…।      

“বাব্বা, এত জোরে হাঁটেন যে, ধরতেই পারি না…”।  

“কী ব্যাপার কোথাও যাবে নাকি?”

“না, এমনি এলাম। ভাবলাম, চলে যাবেন, একটু এগিয়ে দেই। বলা যায় না, আর হয়ত দেখা হবে না, তাই…”  

“কেন দেখা হবে না কেন? আমি তো তোমাকে বলেছি ফোন করতে। দরকার হলে আবার আসব বৈকি…”।   

“আম্মু’র কাছে সব শুনলাম। ঐ প্রস্তাবের পর কেউ আর ফিরে আসে? আম্মুকে নিয়ে আর পারা যায় না। যতদিন যাচ্ছে, আমাকে তাড়ানোর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে…”। শেষদিকটা স্বগতর মতোই শোনালো…।    

“এই ভাবে বলো না, মা তো মেয়ের জন্য চিন্তা করবেই। আর তা ছাড়া, যা পরিস্থিতি শুনলাম…”।   

“বুঝেছি, ঐ সব শয়তানদের কথা বলছেন তো? এক পা কবরে দিয়েও শখ যায় না…” নিজের মনে গজরাতে থাকে।     

“ছেড়ে দাও ওসব কথা। সবই যখন শুনেছো, তখন আমার সব কথা তোমার জানা দরকার।” কৃষাণ তার জীবনের সব কথা খুলে বলে রাবেয়াকে। কথা বলতে বলতে একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অন্তরের সেই ঘা যেন আরো ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। পুঁজ আর রক্ত ছড়িয়ে পড়ে তার শরীর। 

“তুমি শুনে ঘেন্না করবে আমায়। আমি প্রকৃত পক্ষে একটা ‘বেজন্মা’। তোমাদের পৃথিবী আর আমাদের পৃথিবী এক নয়”। কাঁপতে থেকে কৃষাণ। রাবেয়া কিছু না বলে কৃষাণের হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। রাবেয়ার স্পর্শ পেয়ে শান্ত হয় কৃষাণ। যেন রাবেয়ার হাতের স্পর্শ শীতল প্রলেপ পড়ছে ক্ষতস্থানে।  

“সব তো শুনলে রাবেয়া, এবার তোমার মতামত বলো”। কৃষাণের মনে হলো এতদিনের পুঞ্জীভূত অব্যক্ত কথা রাবেয়াকে জানিয়ে যেন হালকা লাগছে নিজেকে।   

“আমি আবার কী বলবো…? আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি”। বাকুল মোড় পেরিয়ে লাভপুরে লজের কাছাকাছি আসতে এটিএম বুথের খোঁজ করে। এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে একটা মোবাইল ফোনের দোকান থেকে একটা ফোন কিনে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দেয়।  

“এখনো কিন্তু তোমার মত পেলাম না রাবেয়া। আমি কী শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলবো?” 

“তোমার যা খুশী…” রাবেয়া কৃষাণের হাতটা চেপে ধরে। কৃষাণের মনে হলো, রাবেয়া যেন তার কাছে সমর্পণ করল নিজেকে। বাসে ওঠার আগে ফোনের বাক্সটা রাবেয়ার হাতে তুলে দেয় কৃষাণ।  

“সিম ভরা আছে…। আজ বিকেলে তোমার ডকুমেন্ট দোকানে জমা করে সিমটা অ্যাক্টিভেট করে নেবে। সকালে আমাকে ফোন করবে, আমি আজ রাতে বোলপুরে থাকব। তোমার ফোন পেলে আমি চাচার সঙ্গে কথা বলব। দুশ্চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাব… আমি ফিরে আসব…”। বাস ছাড়ার সময় জানলা দিয়ে হাত বাড়ায় কৃষাণ। একটু দৌড়ে এসে শক্ত করে হাত ধরে রাবেয়া। রাবেয়ার দিকে তাকায় কৃষাণ। তার কালো দিঘীর মত গভীর চোখে জল উপচে পড়বে যেন।       

( ক্রমশঃ) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন