শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

কস্তুরী কর

                                      



কাজিরাঙা (প্রথম পর্ব)

এক বন্ধুর হাতি সম্পর্কিত পোস্ট পড়ে স্মৃতির পাতা উল্টে গেলাম , আমারও কিছু অভিজ্ঞতা আছে । সে বেশ সাংঘাতিক , মনে পড়লে এখনো ভয় লাগে । তবে ভয়কে শেষ পর্যন্ত জয় করে নিয়েছিল অপরিসীম ভালো লাগা , ভালোবাসার সৌন্দর্য , ভয়ঙ্করের পাশেই যে সুন্দরের অবস্থান।

           আসাম দিয়ে অরুণাচল যাবো , ফেরার পথে কাজিরাঙা দর্শন -- এমনই কথা ছিল , কথামতো কাজ  ।  অরুণাচল থেকে ফিরে  কাজিরাঙার অতিথিশালায় যখন পা দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে , শীতকালে তাড়াতাড়ি সূর্য অস্ত যায় , তবু গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটুকু লাল আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম । বনদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল   জঙ্গলে বেড়ানোর দুটি সময় , এক একেবারে যাকে বলে প্রত্যুষে আর এক দুপুরে । ভোরবেলার ভ্রমণ হাতির পিঠে , দুপুরেরটা জিপে ।
মনে আছে রাত তিনটেতে ঘুম ভাঙতে মনে হয়েছিল মাঝ রাত ,  যাহোক সে অন্ধকারেই আমরা পৌঁছে গেলাম  যেখান থেকে হাতির পিঠে সওয়ার হবো সেখানে । সিঁড়ি দিয়ে একটা একতলা মতোন উঁচু বাড়ির খোলা  ছাদে উঠলাম , ছাদের খোলা অংশটায় এক একটা হাতি এসে দাঁড়াচ্ছে আর মাহুতমশাইয়ের তত্ত্বাবধানে সওয়ারীরা উঠছে , আমাদের আগে দলের অন্য সদস্যরা  হাতির পিঠে বেড়িয়ে গেল , এবার আমাদের পালা , আমাদের জন্য বরাদ্দ হাতিটি এসে ছাদের পাশে দাঁড়ালো , মেয়ের বাবা আগে উঠলেন , উঠে তিনি এবং মাহুতমশাই মেয়েকে ধরে জায়গামতো বসিয়ে দিলেন ( মেয়ে বেশ ছোট ছিল তখন ) এবার আমি ......মাহুতমশাই আমার একটা হাত ধরে আছেন আর একটা হাত দিয়ে বসার জায়গার উঁচু অংশটা ধরে আমি হাতির পিঠে পা রেখেছি কি রাখিনি হঠাৎ হাতিটা একটা হালকা হুংকারের সাথে সাথে একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো ফলে ছাদ থেকে তার বেশ খানিকটা দুরত্ব তৈরি হলো  । একে ঐ বৃংহণ যা জীবনে কোনোদিন শুনিনি তাও এতো কাছ থেকে আর হঠাৎ তৈরি হওয়া আমার আর হাতির মধ্যেকার  শূণ্যস্থান আমায়  এতোটাই ভয় পাইয়ে দিল যে দিশাহারা আমি সব ভুলে সেই মাহুতমশাইয়ের জামা খামচে ধরলাম , বিপদ বুঝে তিনিও সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে  আমাকে  ছাদের ওপর  টেনে নিয়েছেন ততক্ষণে , শূন্যে ঝোলা পা নীচে শক্ত স্থান পেতেই মাথায় এলো ঐ হাতির পিঠে আরো দুজন বসে আছে , সেদিকে তাকিয়ে দেখি মুখদুটো শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে , মেয়ে তো কাঁদো কাঁদো । ভীত চোখে ছাদের ধারটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এখান থেকে নীচে পড়লে হাত , পা ভাঙা বা মাথা ফাটা অবধারিত ছিল , সে তো আমার কিন্তু শুধু মাত্র আমার জন্য পুরো দলটার বেড়ানোর আনন্দ চৌপাট হতো ।  সামান্য প্রকৃতিস্থ হবার পর দেখলাম হাতি আবার যথাস্থানে ফিরে এসেছে এবং অবশ্যই উদ্বিগ্ন মাহুতমশাই কার সঙ্গে অসমিয়া ভাষায় কি সব বলছেন । জানা গেল ঐ হাতিটা মা , তার একটি ছোট ছানা আছে , চঞ্চল ছানাটি মায়ের কাছ থেকে বেশ দূরে চলে গিয়েছিল তাই মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । ছানা কাছে আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করে যখন আবার আমি হাতির পিঠে উঠছি তখন ভোরের নীলচে আলোয় দেখলাম একটি বেশ ছোট  হস্তীশাবক তুরতুর পায়ে এদিকেই দৌড়ে আসছে , ভারি ভালো লেগেছিল তার চলন , কিছুক্ষণ আগের   মারাত্মক ভয়াবহ  অভিজ্ঞতা ভুলে  ভালোবেসে ফেললাম তাকে । তার মায়ের প্রতি কোনো অভিযোগের  প্রশ্নই নেই কারণ সে যে মা , প্রতিটি মা প্রাণীর কাছেই তার সন্তানের থেকে দামী আর কিছু নেই যে । চঞ্চল ছোট্ট ছানা  দুষ্টুমি করলে   মা তাকে ধমকে সাবধান তো করবেই , আর সন্তানের বিপদ আশংকা করে কোন মা স্থির থাকতে পারে ।
            এবার অভয়ারণ্য ভ্রমণ , হাতির পিঠে বসে চলতে চলতে বেশ ভালো লাগছিল , খুব ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে উঠেছিলাম (তখন উঠতে দিতো ) আবার এই । চারপাশের প্রকৃতিতে তখন সদ্য ভোরের আমেজ , আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে , হাতি ধীরে ধীরে জঙ্গলের রাস্তা ধরেছে , বড় বড় গাছের দঙ্গল , কিছু গাছের পাতা ঝরে একেবারে নাগা সন্ন্যাসী আবার কিছুর  বেশ সবুজ আবরণ , যেহেতু শীতকাল তাই জঙ্গল খুব ঘন লাগল না । সুদীর্ঘ গাছের জটলা পেরিয়ে হাতি এবার চলেছে বিরাট বড় বড় ঘাসের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে , এই এলিফ্যান্ট গ্রাস হাতির খুব পছন্দের । সূর্যদেবের সহাস্য ঝলমলে মুখ দেখছি , শীতের মনোরম রোদে প্রকৃতি খুশিতে উজ্জ্বল ,  অনেক রকম পাখি দেখলাম এখানে , লক্ষ্য তো মূলত কাজিরাঙা যার জন্য বিখ্যাত সেই গন্ডারের দর্শন । তো হাতি তার মতন চলছে মাঝে মাঝে মাহুতমশাই মুখে নানারকম শব্দ করে হাতি সামলাচ্ছেন , আর সেই ছোট্ট হস্তীশাবক যার নাম এতক্ষণে জেনে ফেলেছি 'বাবু' , সে কখনো মায়ের সাথে চলছে , কখনো ঘন ঘাসের   ফাঁক ফোঁকরে চলে গিয়ে লুকোচুরি খেলছে , কখনো বা মাকে থামিয়ে দিয়ে দুধ খাচ্ছে , তার শিশুসুলভ আচরণ দেখার মতো বিষয় হয়ে উঠেছিল ,  বেশ মজা লাগছিল । চলতে চলতে দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলো , এরপর হঠাৎ করে বেশ কাছেই গন্ডারের দেখা পেলাম ,  তবে সে আমাদের পাত্তা না দিয়ে একবার মুখ তুলে দূরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখলো তারপর গদাইলস্করি চলনে ধীরে ধীরে চলে গেল । এ জঙ্গলে বিস্তর হরিণ আছে , যখন তখনি তাদের সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছিল । ঘন্টা দুয়েকের ভ্রমণ একসময় শেষ হলো , ছানা সহ হাতি তার আড্ডায় ফিরলো । আড্ডায় এসে দেখি ছোট্ট বাবুর সাথে সব যাত্রীরাই ভাব করতে চাইছে আর বাবুও খুব মিশুকে , সেও সব যাত্রীদের কাছে যাচ্ছে । দেখলাম অনেকে কলা কিনে এনেছেন বাবু এবং অন্যান্য হাতিদের দিচ্ছেন , এ বিষয় আমাদের অজানা ছিল , একটু আফশোস হলো জানা থাকলে আমরাও কিছু উপহার আনতে পারতাম ওদের জন্য । দুজন বিদেশি বাবুর সাথে ছবি তুললেন । একজন ভদ্রলোক ছোট একটা ব্যাগ থেকে কিছু কিছু করে বিস্কুট নিয়ে বাবুকে দিচ্ছিলেন , আমরা সামান্য দূর থেকে দেখছি , বিস্কুটটা বোধহয় বাবুর বিশেষ ভালো লেগেছিল আর অতো অল্প বিস্কুটে তার বোধহয় ঠিক মন ভরছিলো  না   হঠাৎ সে তার ছোট্ট শুঁড় দিয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে বিস্কুটের পুরো প্যাকেটটাই বার করে নিল , তার কান্ড দেখে সবাই তো হেসে কুটোপাটি  আর যাঁর বিস্কুট , তিনি প্রথমে একটু থতমত হয়ে পরক্ষণে সবার হাসিতে যোগ দিলেন । সবাইয়ের মতো আমিও বাবুর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর জানাতে গিয়ে এক নতুন বিষয়ে অবগত হলাম , বাবুর গায়ের লোম বেশ বড় শক্ত কাঁটার মতো , তার চামড়ায় আমার আঙুল পৌঁছোলো না , একমাত্র শুঁড়ের কাছেই তাকে ছোঁয়া যায় । হাতিদের এই লোমের বিষয়টি আমার  অজানা ছিল । দলের সবাইয়ের নানারকম অভিজ্ঞতার গল্প এবং অবশ্যই বাবুর গল্প  করতে করতে আমরা ফিরে চললাম স্নানাহারের জন্য অতিথিশালার দিকে।          
  
ক্রমশঃ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন