রবিবার, ৪ জুলাই, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া

                                    



নিন্দার ফান্ডা 



নিন্দা অপবাদ সহ্য করতে হয়নি এমন মানুষ বিরল। কোন জগতে নেই? এই সেদিন আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে জানতে পারলাম, শঙ্খ ঘোষের মত মানুষের নামে প্রবল কুৎসা রটনা চলছে। জীবিত কালেও ছিল এবং এখন তাঁর মৃত্যুর পরে! লেখার ভুল ধরা থেকে চারিত্রিক কলঙ্ক ... কিছু বাকি নেই। যারা ওখানে প্রতিবাদ করতে গেছে তাদের তুলোধনা করা হচ্ছে। 

একদল লোক সর্বদাই মজা লোটার জন্য কুৎসায় অংশ গ্রহণ করে, তারা সবচেয়ে ঘৃণিত। ইধার এবং উধার এই রকম চরিত্র কোনো জায়গায় ঠাঁই পায়না। 


 এবার বলি, আমাদের আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। সারাজীবন জ্বলেছেন তিনি। লেখার সমালোচনা থেকে চরিত্র... জীবিত এবং মৃত কোনো অবস্থায় রেহাই দেওয়া হয়নি তাঁকে। কি হত? যদি কলম নামিয়ে রাখতেন? আজ কোথায় থাকত বাঙালি? সামনে তেল মেরে পিছনে নিন্দে করতে এতটুকু লজ্জা বোধ হয়নি বাঙালির!

🔥🔥🔥🔥🔥


    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপামর চিত্ত চেতনার প্রতিটি কোষ ঝঙ্কৃত হয় এই একটি নামে। শোক দুঃখ আনন্দ,প্রেম বিরহে বিষাদ... যখন যেমন মনে হয়, হাত বাড়ালেই আছেন তিনি।  আজো পর্যন্ত কত মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে তাঁর জন্য। রোদ ঝড় জল ... তিনি আছেন ...আশ্রয়ের মত। 

   এখন ২০২০ সাল। করোনা আক্রান্ত পৃথিবী। তার মাঝেও মহাসমারোহে  পালন করা হয় রবিঠাকুরের জন্মদিন। 

‌ভাবলে অবাক লাগে , আজ যাঁকে ঘিরে এই উন্মাদনা , একদিন তাঁকে নির্মম ভাবে সহ্য করতে হয়েছিল নিন্দুকের চপটাঘাত। বিষ  নিন্দার আঘাতে জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন --    :এমন অনবরত , এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসসম্মাননা আমার মত আর কোনো সাহিত্যিককে সইতে হয় নি! ( ১৩৩৮ সাল/ নোবেল পুরস্কার লাভ করার পরে)

‌🙏🙏🙏🙏

।          মহৎ সৃষ্টি করতে গেলে গোলাপ পাঁপড়ি বিছিয়ে রাখা পথ থাকে না কোথাও। প্রত্যেকে তাদের নির্মম অভিজ্ঞতা থেকে জানেন কিভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হয় কাঁটার আঘাতে। অযথা কুৎসা অযথা মিথ্যা রটনা  ভয়ংকর আক্রমণ ... বারবার আছড়ে পড়ে সুনামির ঢেউয়ের মত। নিজের চেনা বৃত্ত হতেই আঘাত আসে বেশি।  নিজের কাছের লোকের হাতে লকলক করে ঈর্ষার ছুরি। 

    আজকেও যারা চেষ্টা করছেন দুর্দিনে বাংলা বই মাথা তুলে দাঁড়ায় যেন, কত ভাবে হেনস্থা হচ্ছে তারা!    

     ❤️❤️❤️      রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত ছিলেন যাঁদের হাতে, সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে সেই সময় খ্যাতির শিখরে আছেন তাঁরাও। মানুষ তাঁদের মান দিচ্ছে। তাঁদের রচনা ছড়িয়ে পড়ছে দেশে বিদেশে। নাহ্। তাতে শান্তি নেই। ঠাকুর পরিবারের ওই রবি নামতেই হবে নিচে। নামতেই হবে নোংরা পাঁকে। অদ্ভুত এই বিকৃত মানসিকতার শিকার ছিল তৎকালীন সমাজের বহু বিখ্যাত লোক। কিন্তু কেন? কেন বহন করে মানুষ নিন্দা নামক বিষ? এর কারণ জানতে হলে, একটু আলোচনা করা যাক অন্যদিক দিয়ে। 

 এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:

‌   :পরনিন্দা পৃথিবীতে এত প্রাচীন এবং ব্যাপক যে, সহসা ইহার বিরুদ্ধে যে সে মত প্রকাশ করা ধৃষ্টতা হইয়া পড়ে। .....

       ‌বস্তুত নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, সে ভালো কাজের দাম কী! একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে! ...‌কেবল, প্রার্থনা এই যে, এরূপ নিন্দা যাহার স্বভাবসিদ্ধ সেই দুর্ভাগাকে যেন দয়া করিতে পারি।🙏


‌      দীর্ঘ উক্তি তুলে ধরলাম। কতখানি রক্তাক্ত হৃদয় থেকে তিনি এমন কথা বলেছেন। সহ্য করেছেন কত মিথ্যা লাঞ্ছনা! 

‌১৯২২ সাল। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়  নিজের লেখা গ্রন্থ :রবীন্দ্রছন্দ: 

  তার ভূমিকায় লিখলেন: 

‌      :রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ উপহাস কুৎসা কটু বাক্য গালি গালাজ করিতে দেশে অপরিমিত মূলধনে একটি স্বদেশী যৌথ কারবার স্থাপিত হইয়াছে।


   যৌথ করবার এই মুহূর্তে , লকডাউনের অলস বাজারে এমন যৌথ কারবার রমরম করে চলছে। তবে, বিন্দাস থাকুন। আপনি অন্যায় না করলে কেউ কিছু করতে পারবে না। কুৎসার এত শক্তি নেই যে সরল সৎ মানুষের চুল স্পর্শ করার  আরো উদাহরণ দিতে পারি। কুৎসা রটনা কারি এখন সব কোথায়?

    ‌১৮৮৮ সাল। কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ একটি ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ার বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম -- মিঠেকড়া।

    প্যারোডি করে লিখলেন সেই অযোগ্য কবি: 

‌ উড়িসনে রে পায়রা কবি

‌ খোপের ভিতর থাক ঢাকা

‌  তোর বকবকমম আর ফোঁস ফোঁসানি

‌তাও কবিত্বের ভাব মাখা।...

‌ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ 

‌ বঙ্গের আদর্শ কবি 

‌ শিখেছি তাহারে দেখি

‌  তোরা কেউ কবি হবি? 


‌ পাঠক! এখুনি চমকে যেও না। আরো অজস্র তীর আসছে ছুটে। বিখ্যাত কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এমন সব কটূক্তি করতেন যে, কানে আঙ্গুল দিতে হয়। 

‌আনন্দ বিদায় 

   নামক একটি ব্যঙ্গ নাটিকায় তাঁর ( ডি এ ল রয়) আক্রমণের ভাষা স্তম্ভিত করে। 

‌:একাধারে কবি, অধিকারী , ঋষি কিবা ত্যাগ, কিবা দান

‌ পরিষৎ জল ছিটিয়ে দিলেই ( কবিবর) স্বর্গে উঠিয়া যান।  ‌সুহাসচন্দ্র রায়। তিনি সমালোচনা বিজ্ঞান প্রথম ভাগ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। 

‌" রবি পরম গুরু। তিনি হেলিলে হেলিবে। দুলিলে দুলিবে।"

      ‌ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধু সম্পাদিত নারায়ণ পত্রিকায় বিরোধিতা হত রবীন্দ্রনাথের!

‌বহুলোক এই ধরণের মন্তব্য করতে পিছপা হত না যে, বড়লোকের ছেলে। এত প্রতিপত্তি। কথায় কথায় বিলেত যান। দরকার কি ছিল বাংলা সাহিত্য চর্চা করার? ছড়া বাঁধা হল: 

‌🔥 আয় তোরা কে দেখতে যাবি।

‌ঠাকুর বাড়ির মস্ত কবি

‌হায়রে কপাল হায়রে অর্থ

‌ যার নাই তার সকল ব্যর্থ। 

🔥🔥🔥🔥

‌ হায়!  মানুষের চরিত্র। ধনীর সন্তান । তাই অধিকার নেই সাহিত্য চর্চার! কী অদ্ভুত বিচার! 

‌*********

‌ এই প্রসঙ্গে আলোচনা করি, ঈর্ষা নামক মানসিক ব্যাধির কথা। অপরের সব ভালো, আর আমার কিছু হচ্ছে না, এই মনোভাব থেকে যে মানসিক জ্বলন , ভালো না লাগা , রাগ__সেটাই ঈর্ষা। ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে যখন সেই মানুষটির ক্ষতি কামনা করা হয় এবং আপ্রাণ চেষ্টা করা হয় ক্ষতি করতে, তখন সেটা পরিণত হয় হিংসায়। এবং , ধীরে ধীরে স্ফুলিঙ্গের থেকে জ্বলে ওঠে দাবানল। 

‌একজন মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবে জানি, ঈর্ষা থেকে হার্টের অসুখ হতে পারে। নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে পারে। বদ হজম , ডিপ্রেসন, মাথা ব্যাথা__কিছুটা হলেও, এসব রোগের মূল কারণ মন এবং মনের মধ্যে জেগে ওঠা বিকার। ঈর্ষা হোক। হোক মহতের তরে। মহৎ লাভের আশায় ঈর্ষা করলে, জীব ও জগতের উপকার। 

‌***

‌ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথের কথায়। ঋষিকল্প মানুষটি কিভাবে সহ্য করেছিলেন এইরকম বিষের জ্বালা?  সম্ভব হত কী? কবির কথায় দেখে নি একবার: 

‌ " কেবল এই কথাটা আমি 

‌বুঝিবার ও বুঝাইবার চেষ্টায় ছিলাম যে সাধারনত মানুষ নিন্দা করিয়া যে সুখ পায়,। তাহা বিদ্বেষের সুখ নহে। বিদ্বেষ কখনোই সাধারণভাবে সুখকর হইতে পারে না। এবং বিদ্বেষ সমস্ত সমাজের স্তরে স্তরে পরিব্যাপ্ত হইলে যে বিষ হজম করা সমাজের অসাধ্য। 

     নিন্দা বিরোধ গায়ে বাজে না, এমন কথা অল্প লোকই বলিতে পারে। 

‌যাহার হৃদয় বেশি তাহার ব্যথা পাইবার শক্তিও বেশি।

‌    কতখানি জমাট বাঁধা অভিমান থেকে এমন কথা কবি বলেছেন, ভাবতে গেলে মন ভরে ওঠে গভীর বিষাদে। মানুষ অদ্ভুত। মাথায় তুলে নিতেও দেরি নেই। নিচে ফেলে গুঁড়িয়ে দিতেও পিছপা হয় না। 


(তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ক বিভিন্ন বই। 

রবীন্দ্র বিদুষণ ইতিবৃত্ত: আদিত্য অহদেদার ব্যাখ্যা : নিজস্ব।)


শেষে একটা ফুটনোট দেব: 

যত নিন্দা তত সমৃদ্ধি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন