শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                      


নিজা 


মাউন্ট মৌনালোয়া, ফুজি না নিছক পোপো? বৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক করে দিয়েছে সায়র সেনকে নাহলে এই সব অহৈতুকী দৃশ্যকল্পের তুলনা মাথায় আসার মতো অবসর কোনো মফস্বলের সরকারী হাসপাতাল তার ডক্টর অন ডিউটিকে দেয় না। সপ্তাহের সিংহভাগ এখানেই কাটাতে হয় তাকে। অন্যান্য অপ্রাপ্তি সেভাবে গুরুত্ব না পেলেও একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে থাকাটা মনখারাপেই রাখে। যে আসার পর তার চরাচরে তিনি অন্য রংধনু দেখেছেন তার থেকে দূরত্ব বিষণ্ণতা তো দেয়ই তার মতো মানুষকেও যার জীবন ও তার যাপন সম্পর্কে ধারণাটা মেডিক্যাল ফ্রেটারনিটির বাকি পাঁচজন সমসাময়িকের সঙ্গে মেলেনা। হয়তো মেধা, দক্ষতা এইসব কোন'কে অনালোচিত রাখলে একমাত্র নিয়তি নির্ধারিত বলেই তাকে এই পেশায় আসতে হয়েছে, থাকতে হচ্ছে, হয়তো বা নিজেকেও ভুলতেই হচ্ছে। সদ্য তিরিশ পেরিয়েছেন অথচ তাকে দেখলে কেউ বলবেই না ক্যাম্পাসে বসে কিছুক্ষণ আগেও আড্ডা মারছিলেন না। হয়তো প্রাণশক্তি, হয়তো উদ্দাম স্বাতন্ত্র, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না এক নজরে দেখে কী তাকে এতটা আলাদা করলো। তবে যদি কেউ তাকে লক্ষ্য করে নিপুণভাবে, বুঝতে ভুল হবে না আসলে এখনো তিনি তার আবেগ ও সংবেদনকে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, এর উল্টোটা ঘটলেই বরং স্বাভাবিক হতো, পেশার সঙ্গে মানানসইও বটে। অথচ সায়র বেহিসাবি সফল। অদ্ভুত শুনতে লাগলেও অত্যন্ত বিতর্কিতও। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। এই মুহূর্তে বৃষ্টি বাড়ছে। অন্যমনস্ক থেকে অন্যমনস্কতর হতে হতে সায়রের মনে পড়ছে তার ব্যাক্তিগত মালিকানার নার্সিংহোমগুলোর মধ্যে বিশেষ একটিকে, আরও নির্দিষ্ট করতে গেলে ইডেনের কেবিন ওয়ানকে। কিছু সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয় নাহলে নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক রাখা দুষ্কর হয়ে ওঠে। সায়র ফোন করে নির্দেশ দিলেন, আগামিকাল থেকে ইডেনে কোনো কোভিড পসিটিভ থাকবে না। প্রত্যেককে রেফার, প্রপার প্লেসমেন্ট দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে হবে। প্রয়োজন ছিলো না, কিছুটা স্বগতোক্তির মতো করে জুড়ে দিলেন,

--"গভর্নমেন্ট গাইডলাইন প্রোভাইড করতে গেলে যে অমানবিক আচরণ করতে হবে, পিপিই ইত্যাদি পরে ট্রিটমেন্ট, তা সম্ভব নয়। এতে পেশেন্ট মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সাইটোকাইন তাকে সেখানেই শেষ করে দেয়। আমায় তো দেখেছেন, একটা মাস্ক ছাড়া কোনো গ্লাভসও আমি ব্যবহার করি না। সুতরাং সকলের স্বার্থে এই ডিসিশন নিতে আমি বাধ্য হলাম।"


জ্যা থেকে শরকে মুক্ত করার পর ব্যাধ ভিন্ন ধনুক নিয়ে ভাবিত হয় না বিশেষ কেউ অথচ ফোন রাখার পর থেকে এক বিচিত্র প্রশ্ন সায়রকে তাড়া করতে শুরু করলো। কেন এই স্টেপ? গতরাতে এডমিশন নিয়ে আজ বিকেলে একজন বলিষ্ঠ মধ্য তিরিশের যুবক স্যাচুরেশন শূন্যে পৌঁছে লাশ হয়ে গেছে বলে? চারঘন্টা যাবত এই আকস্মিকতা নিতে না পেরে তার স্ত্রীর আর্তনাদ ইডেনের সব কটা ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়েছে বলে? নাকি সেই একই অলীক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এডমিট হওয়া এক প্রৌঢ়ের একই পরিণতি কাল ঘটলে তিনি দায় নেওয়ার কথা ভাবতেও পারছেন না বলে? জন্ম ও মৃত্যু জনসাধারণের কাছে যতটা প্রবল উদযাপনীয়, ঠিক ততটা প্রেডিক্টেবল নয় অনুভব সাপেক্ষে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত জন্ম এত মৃত্যু, সংখ্যাধিক্য অথবা প্রতিটিতেই অংশীদার হওয়ার কারণে সম্ভবত জীবনের থেকেও অত্যন্ত সহজ ঠেকে তাদের কাছে জীবনে প্রবেশ ও প্রস্থান। তবে কেন তিনি এত অস্বস্তিতে ভুগছেন?

নীলাদ্রি চক্রবর্তীকে ঠিক দুদিন আগে যারা প্রথম ইডেনে নিয়ে এসেছিলো, পরের দিন কথা বলতে এসেছিলো, তাদের কারোর মধ্যে সে ছিলো না। যে মুহূর্ত থেকে যাবতীয় রিপোর্টে অভ্রান্ত প্রমাণিত হলো আপাতত তার আর বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা নেই, শরীরের ভিতরের যন্ত্রপাতি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত যেহেতু একদম জ্ঞান হারানোর আগে কাউকে কিছু বুঝতেই দেননি সদাব্যস্ত ব্যক্তিটি, ছায়ার মত সে এসে দাঁড়ালো, নীলাদ্রির একমাত্র সন্তান। সায়র অসংখ্য সুন্দরী দেখেছেন জীবনে, রূপ তাকে আর প্রভাবিত করে না। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, একজন প্রৌঢ় পেশেন্টের মেয়েকে কীরকম দেখতে সেই অনুসন্ধানের পর্যাপ্ত আগ্রহ, ইচ্ছে বা উদ্যোগ সবেরই বিপুল ঘাটতি ছিলো তার দিক থেকে। তিনি শুধু এড়াতে পারেন নি একজোড়া চোখকে। চোখও নয় ঠিক, দৃষ্টিকে। মুখের নব্বই শতাং মাস্কে ঢাকা অথচ সেই আয়নার উপর আলো পড়লে আর এক শতাংশেরও প্রয়োজন হয় না বুঝে নিতে মালিকানা পৃথিবীর তিনভাগের থেকে আলাদা। অসম্ভব অসহায় অথচ অন্তর্ভেদী। সায়র যতক্ষণ কেবিনে ছিলেন স্পষ্ট বুঝছিলেন, সেই নি:স্ব রকসলিড দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। তার প্রতিটি কথা, মুভমেন্ট, শরীরী ভাষা সব কিছু স্ক্যান হচ্ছে। কথা হয়নি কোনো। কথার প্রয়োজন ছিলো না। একথা নির্মম সত্য পৃথিবীর যে কোনো ভাষা চতুর্থ ইন্দ্রিয়ের উচ্ছিষ্ট হলে অর্থহীন হয়ে যায়। সায়র অন্ধ নির্ভরতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ফলত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন অবশ্যই। উচ্চারণ করতে পারেন নি খুব বেশী আশা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না কারণ তার মাথায় ভাসছিলো নিজের মেয়ের মুখ। বছর খানেক আগেও তিনি একথা জানতেন না এখন যা অনায়াসে বোঝেন, একমাত্র মেয়েদের কাছে তাদের বাবারা ঠিক কোন অবস্থানে থাকে। আঘাত করা যায়না সেই শক্তিস্থল অথবা দুর্বলতম বিন্দুতে, চিকিৎসক হিসেবেও নয়। তার চেয়ে এই ভালো, প্রফেসর অন্য কোথাও শিফট হয়ে যান।


নীলাদ্রি ঘুমোচ্ছেন, তাকে নিয়ে এত উথালপাথাল, অজ্ঞাত তিনি। চাঁদের বিন্দু বিসর্গ উদয়ের সম্ভাবনা আপাতত নেই অথচ তার অবচেতন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। বিস্তীর্ন দিগন্তের একপ্রান্তে এক রাজপুত্তুর, মুকুট তরোয়াল পক্ষীরাজ কিছু নেই, সদ্য দেখেছেন অথচ মনে হচ্ছে বহু চেনা, আরও বহুবার বহু সময় ধরে তাকে দেখতে ইচ্ছে আসছে তার। আর বহুদূরে স্বধা, মেয়ে হিসাবেই তার পরিচয় অথচ নীলাদ্রি বিশ্বাস করেন তার প্রয়াত মায়ের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য মননে বহন করা চলা আত্মজাটি প্রকৃতই তার আত্মারই পরিবর্ধিত রূপ। দৈর্ঘ্য, রঙ ইত্যাদি জাগতিক মাপকাঠিতে যতই স্বধা তার মায়ের জলছবি হোক না কেন, একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলে অথবা কাগজে হিজিবিজি কাটলেও জনকের সিলমোহর নিয়েই করে, এ তার অপ্রকাশিত অহং জীবনভোর যেদিন থেকে তিনি 'বাবা' ডাক শুনেছেন। রক্তের দোষেই তারা বংশপরম্পরায় গ্রন্থকীট। গণিতশাস্ত্রে যতটা ব্যুৎপত্তি তার ছিলো বা আছে, সাহিত্য তাকে সেভাবে টানেনি কখনো অথচ মেয়ে উল্টো হয়েছে। বিজ্ঞান স্বধার কাছে বিরক্তিকরই থেকে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্মিত এক হাসি তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফুটে উঠল। স্বধা দেখলো তাকিয়ে। এই এক্সপ্রেশন জন্মইস্তক তার আর বাবার ব্যাক্তিগত ও পারস্পরিক সংলাপ। সকলেই বলে সে আর তার বাবা দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী। কিছুতেই কোনো সামঞ্জস্য নেই, মতের মিল তো নৈব নৈব চ। অথচ সে আর তার বাবা'ই শুধু জানে কেন্দ্রাতীগ বলের সংজ্ঞা। সাধারণ চোখে তা অনুধাবনযোগ্য নয়, প্রমাণের তো নয়ই। সেই সূত্রে সে আজও জানতে পারলো তার বাবা এখন কী দেখছে। 

স্বধা চোখ বন্ধ করে ছায়াপথ ভাবল একবার। নিমেষে শহরতলীর যাবতীয় বারিষকে মেক্সিকোর রক্তাভ মাটির ধোঁয়া ঢেকে দিল। নীলাদ্রি আর ফুয়েন্তেসের গ্রিঙ্গো একাকার হয়ে গেলেন। লড়ছে তার বাবা। কর্তব্যের চাঁদমারিতে দাঁড়ালে কোন পুরুষ ভাড়াটে সৈনিক নয়? বিরোধে বিরোধে বাবাকে জর্জরিত করা সে দাঁড়িয়ে আছে সামনে আর অবাস্তব মায়া আগলে তার বাবা খুঁজে চলেছে সেই পুরুষ যে তার অবাধ্য আর অসামাজিক সন্তানটাকে ধারণ করতে পারবে পূর্ণ যোগ্যতায়, মর্যাদা দিতে পারবে আপাত পাথুরে স্তর পেরিয়ে অসম্ভব তরল সেই জলাভূমির যেখানে যখন তখন তুফান ওঠে বিনা সংকেতে। প্রতিপক্ষ মাত্রেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তার স্বধার সামনে এ তার কাছে বিষম যন্ত্রণার কারণ তিনি জানেন প্রতিটি আঘাত দেওয়ার আগে স্বধার নিজের ক্ষত হয় চতুর্গুণ, আত্মধ্বংসী নন্দিনী তার। কে বুঝবে তার এই মেয়েকে? 


ভোর হয়ে আসছে।
ইডেনের রিসেপশন স্টাফ কেবিন ওয়ানের পেশেন্ট পার্টিকে ডেকে পাঠালো, জরুরী ইনফরমেশন আছে, স্যার ফোন করেছিলেন...

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল


২টি মন্তব্য: