রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া

                         


                



মনের ব্যাংক

আজ বলব মনের ব্যাংকিংয়ের কথা। ব্যাংক শব্দটা জড়িয়ে আছে জীবনের প্রতিটি স্তরে। নিচুতলা থেকে উঁচুতলা ব্যাংকের দ্বারস্থ সবাই। কারণ, জমা থাক কিছু পুঁজি। অসময়ে কাজে লাগবে। বিপদে পড়লে কাজে লাগবে। 

জমা করা ,জড়ো করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আরো নানান দিক আছে এই জমিয়ে রাখার ব্যাপারে। যেমন , কথায় কথায় আমরা বলি, এনার্জি বাঁচিয়ে রাখতে। একটু ঘুমিয়ে নিতে। শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। পরে কাজ করার সময় বাঁচিয়ে রাখা এনার্জি সাহায্য করবে। ঠিকমত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, সঠিক ব্যায়াম করে শরীর ঝরঝর তাজা করে ফেলার উপদেশ সর্বক্ষণ শুনতে হয়। 

তাহলে মনের ব্যাংকিং কি? মনের ঘরের জমা খরচের হিসেব ঠিক কি রকম?

     ******

  মুশকিল হল, ব্যবহারিক জগৎ আর তার উপযোগিতা নিয়ে সর্বক্ষণ হিসেব নিকেশ করে চলেছি। নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবছি। চারিদিকে সবকিছু সামলে চলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে বাহবা দিচ্ছি। আজ এমন দুজন মহিলার  গল্প করি। গল্প নয়। সত্য ঘটনা। 

 প্রথমজন  বাংলাদেশ হতে প্রচুর সংগ্রাম করে কলকাতা এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জিরো থেকে একেবারে হিরো। ছেলেগুলো হীরের টুকরো বললেও কম বলা হয়। সেইসঙ্গে মা অন্ত প্রাণ। স্বামী অকালে স্বর্গে চলে গেলেও ওনার কোনও  সমস্যা হয় নি। উনি প্রচুর পুজো করতেন। উপোস করতেন। এবং কাউকে বিশ্বাস করতেন না। এককথায় চতুর যাকে বলে। চারিদিকে সতর্ক নজর। টাকা পয়সা অনেক। ছেলেরা হাতের মুঠোয়। ধন্য ধন্য করত লোক। 

  আজ তিনি বিছানায় শয্যাগত। ছেলেরা রাজকীয় চিকিৎসায় রেখেছে। তার স্মৃতি ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। কথা বলেন। কথার বেশিরভাগ হল অশ্রাব্য গালি। নোংরা কথার তুবড়ি। নিজের মনেই বলে যান। আয়া নাকি ওনার গোপনাঙ্গে হাত দিয়েছে। একটার পর একটা আয়া বদল। ওনার গালি গালাজ চলতেই থাকে। 


       গল্প ২

____________

 আরেক মহিলার গল্প। সংগ্রামের ইতিহাস দুজনের প্রায় সমান। সাফল্যের বিচারে দ্বিতীয়মহিলা অনেক কম। অর্থভাগ্য ভালো নয়। সন্তান ভাগ্য ভালো নয়। দিনান্তে নিজের ভাত নিজের ফুটিয়ে খাওয়া ছিল তার ভবিতব্য। 

********

এই মহিলা দুজনকে তাদের মধ্যবয়স থেকে দেখেছি। খুব কাছের থেকে। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করতাম। দুজন মহিলা আমার কাছের মানুষ। দুজনেই বিধবা। দুজনেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। 

আমি লক্ষ্য করতাম ওদের চলাফেরা, কথাবার্তা। সফল মহিলার চলা ফেরার মধ্যে উগ্র অহঙ্কার ফেটে পড়ত। মুখে একফোঁটা হাসি নেই। সর্বদা অবিশ্বাস। ভুরু দুটি কুঁচকে আছে। নিরামিষ খেলেও প্রচুর ফল দুধ হরলিকস একেবারে সময় মেপে খান। বাড়িঘর নিয়ে ভীষন সচেতন। সিল্কের শাড়ী, গহনা।  অপর মহিলা একবেলা আহার করেন। যত অল্প খাওয়া যায়। নিরন্তর মুখে হাসি। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়। যে সন্তান রোজ আঘাত করছে তার জন্য প্রার্থনা। অচেনা লোকের জন্যেও শুভ কামনা। সাদাথান ছাড়া কোনো কিছু নেই। এমনকি একটুকরো সোনা পযর্ন্ত নেই। আমি শুনেছি, সফল মহিলা ব্যঙ্গ করে বলতেন," তুমি ভাই ভীষন বোকা। 

উত্তরে মহিলা হাসতেন। বলতেন," আমি খুব শান্তিতে আছি। 

ব্যর্থ মহিলা সুস্থ থেকে সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেছেন। এক ফোঁটা সেবা নেননি কারো কাছ হতে। সফল মহিলা বিছানায়। সাধের বাড়িতে রাজত্ব এখন আযাদের, ছেলেরা দেখাশোনা করে কিন্তু থাকে নিজেদের ফ্ল্যাটে। সিল্কের শাড়ির হিসাব নেই। গহনা মেয়ের হেফাজতে। কোনো জ্ঞানই নেই। গালাগালি কেন দেন, সেটা এখন আমি জানি। এ বিষয়ে পড়াশুনো করে বুঝেছি, মনের ব্যাংকে যা যা সঞ্চয় হয়ে থাকবে সেগুলো অবচেতনে বেরিয়ে আসে।ওই যে ওনার স্বভাব, যাকে উনি লালন করেছিলেন সযত্নে, মনে করতেন এটাই উচিত। সন্ধ্যে হলেই বাংলা সিরিয়াল দেখতেন। রাতে সেই সিরিয়ালের গল্প বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা ওনার মন একটাই সংকেত দিত সেটা হল, কোথাও বিশ্বাস নেই। নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। এটা হয়ত কোনো অন্যায় নয়। বেঁচে থাকার একটা উপায়। কিন্তু সে উপায় ঠিক না ভুল সেটার প্রমাণ দেয় সময়। উনি মারা গেলে কি হত জানি না তবে বেঁচে আছেন এবং নেগেটিভ স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে আছেন। ওনার মনের ব্যাংকে জমা হয়ে আছে অবিশ্বাসের পুঁজি। অহঙ্কার। ক্ষমতা লিপ্সা। সেটাই এখন ফোয়ারার মত বেরিয়ে আসছে। 

 মন : ভীষণ শক্তিশালী যন্ত্র। সমস্ত রেখে দেয় নিজের ভিতর। মূল কথা হল আনন্দ এবং এনার্জি। ওই যে অসফল মহিলা , উনি ভিতরে কখনো ক্ষোভ পুষে রাখেন নি। যা পেয়েছেন যতটুকু পেয়েছেন আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তৃপ্ত থেকেছেন। সন্তান ওনাকে আঘাত করলেও উনি তার জন্য প্রার্থনা করেছেন আর ওই সফল মহিলার সন্তান মাথায় করে রাখলেও উনি ভাবতেন যথেষ্ট করা হচ্ছে না। সুতরাং, সচেতন থাকতেই হবে। আমরা সবচেয়ে বেশি ছেলেখেলা করি মন নিয়ে। যা পারি, যেভাবে পারি ঢোকাতে থাকি। রাগ অভিমান দুঃখ ক্ষোভ ... যেন এটা আমার ডাস্টবিন। নাহ্। এই মন আমার বর্ম। আমার অস্ত্র। যা খুশি ভাবে তাকে ব্যবহার করার আগে ভাবতে হবে বইকি। এই ভাবনা আমাদের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেবে। শরীরের উপর কত নজর ! চুল এই করো, ত্বক ওই করো। কিন্তু, চিন্তন? মন? সারাদিন তাকে কি দিচ্ছি?

এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। লেখালিখি কথাটা বলতে এবং শুনতে যত সুন্দর হোক না কেন, সে জগৎ কত ভয়ঙ্কর সে কথা সকলেই জানি। দিনরাত সেখানে অবিশ্বাস আর দুর্নামের খেলা চলছে। একে অপরের নামে বলছি আমরা। পোস্ট লিখছি। ঠকছি। ঠকাচ্ছি। সারাদিন এইভাবেই ভাবছি কি করে আরো আরো লাভবান হওয়া যায়। 

 ঈর্ষা হোক মহতের তরে... 

    কালজয়ী কবি এমন বলতে পারেন। সৃষ্টির মূল কথা ঈর্ষা। 

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে কাজের আনন্দ কিসের? কিন্তু তার মানে এই নয় যে , চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা প্রতিদ্বন্দ্বী র কথা ভাবতে থাকব অথবা অপর কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে ক্ষোভ আর হতাশায় ডুবে থাকব। 

  যদি প্রশ্ন হয়, ব্যবসা করতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হবে, না হলে সফলতা আসবে না। সব সফল মানুষ কোনো না কোনো সময় অন্যায় করেছেন এবং করছেন। তবে? তারা কি ভালো নেই? সাধু আর বোকা হয়ে এই দুনিয়ায় কোনো লাভ নেই। 

 সমস্যা হল অন্য জায়গায়। জীবনে লাভ হচ্ছে না ক্ষতি সেটা বুঝতে যখন পারি তখন দেরি হয়ে যায় অনেক। মাটির যেমন ধারণ ক্ষমতা পরিমিত, তার উপর অযথা ভার চাপিয়ে গেলে এক সময় সে বিদ্রোহ করে, মনের জমির নেওয়ার কিছু সীমিত ক্ষমতা আছে। তাকে এনার্জি তে ভরপুর রাখতে হয়। নেগেটিভ কথা আর কাজের পাহাড় চাপিয়ে দিতে দিতে এক সময় বিদ্রোহ করে সে। 

 শেষের সে দিন কে দেখেছে? লোকে বলবে ভালো লোক কি কষ্ট পায় না? কষ্ট কখনো ভালো মন্দ বিচার করে না। যার পাওয়ার সে পাবেই। কথা হল, মনের ধারণ ক্ষমতা বা শক্তি যার বেশি সে কষ্ট নিয়েও ভালো থাকে। সুন্দর ভাবনা থাকার ফলে তার ভিতর তৈরি হয় পজিটিভ এনার্জি। ওই এনার্জি সাহায্য করে। বয়স হলে শরীরের যন্ত্রপাতির ক্ষয় হবে। কালের নিয়ম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, মনের সঙ্গে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিন এনার্জি যোগান দিলে মন সতেজ থাকবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মন ব্যাংকিং। জমা করতে হবে ভালো ভাবনা। সুন্দর চিন্তা। সুন্দর সঙ্গ। সুদে আসলে ফেরত পাওয়া যাবে সময় হলে। 

 টাকা বাঁচিয়ে ব্যাংকে ফেলতে হয়। মন বাঁচিয়ে রাখতে হয় বইকি। সোশ্যাল মিডিয়ার কোন কোন দিক আমাকে বিরক্ত করছে, কোন বন্ধুর সঙ্গ আমাকে ক্লান্ত করে তুলছে ... এগুলো সুদূর ভবিষ্যতে  এনার্জি ব্যাংকের পুঁজি নষ্ট করে দেবে। সাবধান হতে হবে এখন থেকে। 

ভালো লেখক হওয়ার জন্য নামী পাবলিশার হওয়ার জন্য প্রতিদিন এই যে ধার করা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, ভাবছি কি ভবিষ্যত কি নিয়ে আসছে? অকারণ এনার্জি ক্ষয় করে লাভ নেই। বাঁচিয়ে রাখতে শিখতে হবে। জীবন থাকলে কোনো না কোনো দিকে আমাদের পথ খুলেই যাবে। 

  নিজে আনন্দে থাকলে জগৎ আনন্দময়। এমন চিন্তাশক্তি সবল থাক যার ফলে ভালো হতে বাধ্য। মনের ব্যাংকে বেড়ে উঠুক মঙ্গলধ্বনি। একদিন সেটা কাজে লাগবে আমাদের।।


চিত্রঋণ - অন্তর্জাল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন