শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

অজিত রায়


আমায় ঘিরে যে নদী
-----------------------------------
দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার টোরির কাছে সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু খামারপৎ পাহাড় থেকে নির্গত হয়েছে পূর্বভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নদ দামোদর।  যে জলধারাগুলি নেমে এসেছে ঐ পাহাড়ের গা বেয়ে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় ধারাটির নাম সোনাসাথী।  এই সোনাসাথীই দামোদরের উৎস।  রামগড়ের শ'খানেক কিলোমিটার পশ্চিমে হাজার ফুট উঁচু হাজারিবাগ পাহাড় পেরিয়ে নাম নিয়েছে 'দামোদর' (অনেকের মতে 'দামুণ্ডা' থেকে এসেছে দামোদর নামটি।  জৈন নির্বাণগ্রন্থে বরাকর নদকে বলা হয়েছে 'ঋজুকলা'।  কল্পসূত্রে এই নদই 'উজ্জুবালিয়া'।  বরাকর বা দামোদর নামের উৎস নিয়ে বিতর্কের সমাধান আগেই হয়ে গেছে।  প্রবাদ মতে, 'ক্ষুদে, নোনা, বরাকর ---- এই তিন নিয়ে দামোদর'।  সুতরাং ঋজুকলা, ঋজুপালিকা আর উজ্জুবালিয়া এই দামোদরই।)  রামগড়ের ভুরকুন্ডার কাছে বাঁক নিয়ে রামগড়-হাজারিবাগ রোডের তলা দিয়ে চিত্তরপুর-গোলার দিকে এগিয়ে কিছুটা দূরে এসে বোকারোয় ঢুকে খানিকটা পুরুলিয়া ছুঁয়ে পুনরায় বোকারো মাড়িয়ে ধানবাদের দক্ষিণ সীমান্তে সিন্দ্রির পাশ দিয়ে কালুবাথানের দিকে ছুটে গিয়ে শালতোড়া থানার শিরপুরনামা গ্রামের কাছে বাঁকুড়ায় ঢুকে, ক্রমশ দক্ষিণপূর্ব দিকে শালতোড়া, মেজিয়া, অর্ধগ্রাম, বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়ের আর ইন্দাস থানার সোমসারে দামোদর বাঁকুড়া জেলা ছেড়ে বর্ধমান জেলায় ঢুকে রায়নগরের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ দু-ভাগ হয়ে একটি ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে তারকেশ্বরের পানে ধেয়ে গেছে, আর অন্য একটি ধারা ৫৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে অবশেষে গিয়ে মিশেছে বঙ্গসাগরে।
এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
টোরি থেকে ডিসেরগড় পর্যন্ত দামোদরের উচ্চপ্রবাহ।  বরাকরের সঙ্গম থেকে বর্ধমান শহরের আগে পর্যন্ত মধ্যপ্রবাহ।  এরপর জলের তোড় ক্রমশ কমে গিয়েছে।  অতিকায় দামোদর ধানবাদ জেলার তেলমোচো-পারজুরিয়া-তালগড়িয়া-আমলাবাদ-ভাঁওরা-চাসনালা পেরিয়ে কান্দ্রার কাছে সামান্য বাঁক নিয়ে ক্রমশ সিন্দ্রি-কালিপুর-ঘরবার-বেগুনবাড়ি-দলদলি দিয়ে জেলার দক্ষিণ সীমানা চিহ্নিত করে পাঞ্চেৎ ড্যামে গিয়ে বরাকরের সঙ্গে মিশেছে।  একসময় পুরুলিয়া সদর থেকে ধানবাদ মহকুমাকে বিচ্ছিন্ন করেছিল নদীটি।  এঁকেছিল চাস থানার দক্ষিণ সীমান্ত।  ১৯৫৬-এ চাস থানা ধানবাদের অন্তর্ভুক্ত হলে প্রায় সাড়ে তিন দশক ছিল জেলার প্রাকৃতিক সীমারেখা বিলুপ্ত।  ১৯৯১-এ বোকারো জেলার জন্ম হলে এই নদই পুনরায় বিভাজক-রেখা হয়েছে বোকারো-ধানবাদের মাঝখানে।
     মাইথন আর পাঞ্চেৎ বাঁধ নির্মাণের আগে, অর্থাৎ ১৯৫৬-এর আগে পর্যন্ত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে, শোকেরই শমন ছিল দামোদর।  আগে বলে নিই, যে জলাধার-দুটির উচ্চার এলো, পাঞ্চেৎ আর মাইথন, সে-দুটোয় বহু রক্ত বহু জ্বালা বহু অভিসম্পাত কবরিত।  কত যে গাঁ আর মন্দির জলের তলায় রয়ে গেছে!  আবার, বাঁধ না হলেও অতিকায় দস্যি দরিয়া শোকেরই সমন ছিল একদা, আকাশে আষাঢ় ছাইলে চরায় টান ধরত নৌকোর, মাঝির।  বছরের পর বছর ভয়াল বিগ্রহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে, দামাল দামুণ্ডা।  যেমন তার দাপ, তদনুগ কলোচ্ছ্বাস!  মাকড়া পাথরের রোড়া-বালি আর বড় বড় চাটান-চেরা খাত, দু'ধারে খাড়াই ডাঙা, অনাবৃত কঠোর শিলাস্তর ফেড়ে করোগেটেড বক্ষঃস্থল, যার ভাঙাভাঙা বেবন্দেজ খোয়াই পাড়ে মাটির গোচর মেলে ক্কচিৎ, কাঁধার জুড়ে কোথাও ছাড়া-ছাড়া প্যাংলা বাদাড়, পুটুশ বনতুলসী আর চোরকাঁটার গোঁফ, কোথাও-বা শাদা দানাদার পাথরের নিরবচ্ছিন্ন দাহাড়।  নারী যেমতি, প্রকৃতি যেরম, দামুণ্ডাও কিছুমাত্র উনিশ নয় তার-চে।  কিন্তু ঐ দাপ, ঐ মস্তি, সবই থেৎলে গেছে এই আগুনডাঙা ধানবাদে উচোট লেগে।  এখন দামুণ্ডা সহ এ টাঁড়ের যাবৎ নদী সম্বৎসর শুকিয়ে, অন্তঃসলিলা , এমনকি বালুকার তলহাটিতে তাদের তোয়প্রবাহ, বড়জোর পায়ের গুলি, মালাইচাকি ডোবে কদাচিৎ।  সেই দফনিত রক্ত ও খেদ মানুষের পিছা না ছাড়ে।
তো, যেটা বলছিলাম।  এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
দাম যার উদরে, আগুনখেকো, বছরের পর বছর ভয়াল মূর্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই বহতা বলশালী বাওলা নদ, ধ্বংস করেছে জনপদ, তছনছ করেছে শস্যসম্পদ।  ১৮৯৮-এর বর্ষায় বন্যা এমন উগ্ররূপ ধারণ করেছিল যে সরকার বাধ্য হয় এ ব্যাপারে নজর দিতে।  অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  ১৯১৩ আর ১৯৩৫ সালের বন্যায় দামোদর তার ভয়ানকতম রূপটিও দেখিয়ে দেয়।  বর্ধমান জেলার প্রায় অর্ধেক ডুবে গিয়েছিল জলের তলায়।  ১৯৪৩-এর বন্যা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা।  গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নিমজ্জিত হয়েছিল জলের তলায়, রেল লাইনগুলি ঠাহর করা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।  কলকাতার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়েছিল।  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই জরুরি মুহূর্তে এহেন দুর্বিপাকে স্বভাবতই চিন্তিত করে তুলেছিল সরকারকে।  সেই প্রথম সত্যিকার অর্থে টনক নড়ে সরকারের।  বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক ড. মেঘনাদ সাহার সুপারিশে ১৯৪৩ সনেই আমেরিকা থেকে ডেকে আনা হলো টেনেসি ভ্যালি অথরিটির ইঞ্জিনিয়ার ডব্লিউ এল ভরডুইনকে।  ১৯৪৫সালে ভরডুইন নিজের রিপোর্টের মাধ্যমে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ সহ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরামর্শ দেন।  পরিকল্পনাটি ইংরেজ সরকারের মনে ধরেছিল।  কিন্তু বাস্তবায়ন হতে হতে ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে যায়।  ১৯৪৮-এর ৭ জুলাই আমেরিকা টেনেসি ভ্যালির ধাঁচে গঠিত হয় 'দামোদর ভ্যালি করপোরেশন'।  এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি বাঁধ দিয়ে ডি ভি সি বেঁধে ফেলে ৫৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দামাল নদ দামোদরকে।  বাঁধগুলি হলো তিলাইয়া ও মাইথনে বরাকর নদে, কোনারে কোনার এবং পাঞ্চেতে মূল দামোদর নদে।
এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
বিরসা সেতুর কাঁখ বেয়ে কলকল বহে চলেছে দামোদর।  দু-কূলে এলায়িত বালুস্তূপের মধ্যে, তরল রজতরেখার সদৃশ।  বালির পর খাদ-প্রমাণ পাথুরে বাদাঁড়, বনতুলসীর ঝোপ।  পাখিদের জেগে ওঠা, গাছে-বেগাছে।  ঐ মহুলবনি ঘাট।  ঐ চেলেমার পাড়।  মাঝি-মাল্লাদের জটলা-করা অনেককটি নৌকো।  বালির পাড়ে খালুই, ফেটাজাল, খেপলা, চুপড়ি।  হাঁড়িয়ার তিতিল।  তীরে ফের বুনো ঝোপ, আলকুশি, সিয়াকুলের ঝাঁকা।  গাছে গাছে তিতির বটের ভারুই ঘুঘু সিপাহি বুলবুল।  পেয়ারা গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে গিরগিটি মোল্লার ঠায় বুকডন।  কোথাও ক্কচিৎ বুনো হনুমান দাঁত খিঁচিয়ে দিল।  হ্যা-হ্যা কুকুর খৈনি চেয়ে লালা ঝরাল।
এই দামোদর, আমার একটা অবসেশন।
দামোদরের কাছে এসে দাঁড়ালেই এমন।  পৃথিবীর থ্রি-ফোর্থ আঁধার ও উত্তেজনা এখানে।  কলকল কলকল।  অবিরত কলকল।  তিন হাজার ফুট খামারপত শৈল থেকে আছাড় খেয়ে, দাম যার উদরে, আগুনখেকো, বহতা বলশালী বাওলা  নদ, রামগড়-হাজারিবাগ-চিত্তরপুর-গোলা-বোকারা-পুরুলিয়া মাড়িয়ে শুধু যে আমারই জন্য।  যাবে সে শিরপুরনামা গাঁয়ের মাজা বেড়িয়ে শালতোড়া, মেজিয়ার পাড়ে আমাদের দেশের বাড়ি ভুলুই।  তারপর সেথায় খানিক নিদিয়ে সে ফের ধাইবে বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়ের, ইন্দাস থানার সোমসার হয়ে রায়নগরের সন্নিকটে, তদুপরি দু-বেণীতে ক্ষীণ হয়ে দ্বারকেশ কিম্বা বঙ্গসাগর।  আমি যে সেই বঙ্গসাগর ছুঁয়ে আছি ফের দ্বারকেশও।  ছুঁয়ে আছি ভুলুই, জগৎরাম, রামপ্রসাদ!!
ঝাড়খণ্ডের নদী তথা  নদী-উৎসের কথা বলতে গেলে প্রাগেতিহাসের প্রসঙ্গ আসে।  পনেরো-বিশ কোটি বছর আগেকার প্রাক-টার্সিয়ারি ভূ-দৃশ্য কল্পনা করা আজকের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।  ভাবলে কল্পকথা মনে হয়, একসময় আমাদের গোটা ভূখণ্ড জমাট বেঁধে একটি বৃহৎ মহাদেশ রূপে অবস্থান করত।  প্রায় উনিশ কোটি তিরিশ লক্ষ বছর আগে সেই অখণ্ড মহাদ্বীপ বিভিন্ন অংশে ভেঙে গিয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে।  ছোটনাগপুর মালভূমির অংশটিও প্রাগুক্ত মূল বৃহৎ ভূখণ্ডের দক্ষিণ ভাগ (গন্ডোয়ানা ল্যান্ড) থেকে আলাদা হয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে চালিত হয়ে আজকের অবস্থানে চলে আসে।  ওই সময়েই জন্ম নেয় মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ।  এই বায়ু থেকে যে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়, তারই জেরে জন্ম নেয় অসংখ্য নদী।  তাদের মধ্যে অন্যতম হলো আজকের দামোদর, সূবর্ণরেখা, উত্তর ও দক্ষিণ কোয়েল।
ছোটনাগপুর বা ঝাড়খণ্ডের নদীগুলির তোয়প্রবাহ অনুধাবন করলে বিশাল গাছের ডালপালার মত এক চমৎকার কেন্দ্রবিমুখ নদীব্যবস্থার ছবি ফুটে ওঠে, যে বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  প্রায় একই উৎস থেকে জন্ম-পরিগ্রহ করেও উত্তর কোয়েল ছুটেছে উত্তরের শোন নদের পানে, দক্ষিণ কোয়েল ধেয়ে গেছে আরও দক্ষিণের দিকে, দক্ষিণ-পূর্বগামী সুবর্ণরেখা বয়েছে বঙ্গোপসাগরে মেশার তরে আর দামোদর চ্যুতি-উপত্যকার মধ্য দিয়ে ধেয়েছে পুবে ভাগীরথীর খোঁজে।  ছোটখাটো উপনদীগুলিরও এরকম ছন্নছাড়া গতিধারা।  সামগ্রিকতায় বৃক্ষরূপী নদীব্যবস্থা।  সবগুলিই বয়ে চলেছে ভূমির প্রকৃতি অর্থাৎ ধাপগত সাযুজ্য মেনে।  একা দামোদরই অতিক্রম করেছে তিনটি অসমান ধাপ।  এক-একটি ধাপ অন্য ধাপ থেকে ঝাঁপিয়ে দিয়েছে হঠাৎ-হঠাৎই।  এই আকস্মিক লাফঝাঁপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামলাতে পারেনি দামোদর, ফলত তৈরি হয়েছে জলপ্রপাত।  হুড্রু, জোনহা, দুমারগারহি, দশম ইত্যাদির পেছনে একই কাহিনী।  ধানবাদ শহরের সন্নিকটে, প্রায় ৪৫ কিমি দূরে দামোদরের কোল থেকে খসে পড়া এমনি একটি জলপ্রপাতের হদিশ মেলে গিরিডি জেলার উশ্রীতে।  আরও একটি ছোট্টো প্রপাত রয়েছে ভাটিন্ডায়।
ধানবাদের কথাই বলি।  এখানকার বড়-ছোট সমস্ত নদীর জন্ম যেহেতু বৃষ্টিপাত থেকে, সুতরাং নদীগুলির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো সম্বৎসর জল না থাকা।  বেশির ভাগ নদীই অন্তঃসলিলা এবং বালুকার তলহাটিতে উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণপূর্ব অভিমুখে তাদের তোয়প্রবাহ।  ভীষণ বর্ষায় কিছুদিনের জন্যে নাব্য হয়ে উঠলেও, অধিকাংশ নদীর খাতগুলি গ্রীষ্মে তো বটেই, শীতকালেও প্রায়শ শুকনো থাকে।  দুটি পুরুষ নদ ও একটি নারী নদী পরিক্রমা করেছে ধানবাদকে।  এ-বাদে আরও তিন-চারটি ছোট নদী রয়েছে এই জেলার বুকে।  উলঙ্গ, কঠিন শিলার চাটান ব্যতিরেকে, সাধারণত নদীগুলি বয়েছে গভীর খাতের ভিতর দিয়ে।  খাতে-খাতে নুড়িবলি, বড় বড় পাথুরে চাঁই, দু'পাশে খাড়াই পাড়, অনাবৃত কঠোর শিলাস্তর কেটে রচিত হয়েছে সুগভীর নদীবক্ষ।  চাটানের পাড়ে মাটির দেখা মেলে ক্কচিৎ।  তটভূমি জুড়ে কোথাও ছাড়াছাড়া শীর্ণ জঙ্গল, আগাছা আর বনতুলসীর এলাহি ঝোপ; কোথাও-বা স্ফটিকের মতো শাদা দানাদার পাথর।  বালির প্রান্তর, ধূ ধূ।  বালি ফুরিয়ে ফের এবড়ো-খেবড়ো রুখু জমি, ধূসর গাছপাথর।  ধুলো ক্ৰমে কালো রঙ ধরে দিগন্তে হাপিশ।
ছোটনাগপুরের পালামৌ জেলার টোরির কাছে সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু খামারপৎ পাহাড় থেকে নির্গত হয়েছে দামোদর।  এই নদটির কথা বিশদে বলেছি এর আগের পোস্টে।  আজ বলব বরাকর এবং ডি ভি সির বাঁধগুলোর কথা।  ১৯৫৬ সালে দামোদরের ওপর রূপ পেয়েছে ১৩৪ ফুট উঁচু আর ২২১৫৫ ফুট লম্বা পাঞ্চেত ড্যাম ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে।  এটি ডিভিসির বৃহত্তম প্রকল্প।  ১২১৪০০০০ একর ফুট জল ধরে রাখার ক্ষমতা এই জলাধারের।  ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে এর হাইডেল পাওয়ার স্টেশনে।  আজ যেখানে এই পাঞ্চেত ড্যাম, ইতিহাসে তার নাম পঞ্চকোট পাহাড়।  পাঁচটি পাহাড়ের সমাহার ঘটেছে এই পাহাড়ে।  সুদূর অতীতে উঁচু মালভুমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এখানকার মাটি পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে।  ধানবাদের দক্ষিণ-পূর্ব এবং পুরুলিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে চুরাশি পরগনায় বিরাজমান এই পাহাড়টি কামথি বেলেপাথরে তৈরি।  পাহাড়টি আকারে দীর্ঘ, শৈলশিরায় দাগ কাটাকাটা, শীর্ষে গিয়ে মিশেছে পূর্বান্তে।  ছোট ছোট ঘন জঙ্গলে ঢাকা উত্তুঙ্গ খাড়াই, মানুষ ও পথচারী ভারবাহী পশুর পক্ষে গম্য হলেও, ঢাকাওলা শকটের পক্ষে দুর্গম।  পাহাড়টি লাগাতার বাঁকুড়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিহারীনাথ পর্বতমালার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।  বিহারীনাথ পাঞ্চেতেরই একটি শৃঙ্গ।  দামোদর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়েছে, তারই দু-তিন মাইল দূরে গিয়ে শালতোড়া থানার কাছে বিহারীনাথ সহসা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।  শালতোড়ায় শুশুনিয়া আর অন্যান্য পাহাড়েরও জমঘট হয়েছে।  তাদের মধ্যে মেজিয়া পাহাড়ের নাম উল্লেখযোগ্য।  সমস্ত পাহাড়ই পাঞ্চেতের জাতভাই।
দামাল দামোদর গিয়ে ঢুকেছে পাঞ্চেত পাহাড়ের বিরাট জলাধারের ভেতর।  এই জলাধারেই এসে মিশেছে বরাকর।  আর এখানেই সঙ্গম ঘটেছে ধানবাদ, পুরুলিয়া আর বর্ধমানের।  জলাধারের সীমান্তে গোয়াই নদীর অনেকটা পুরুলিয়ায় ঢোকা, খানিকটা বোকারোয়।  পাঞ্চেত পাহাড়ের পুব দিকে দামোদর বেঁকে গিয়েছে।  পাহাড়ের দু-দিক থেকে দুটি নদী এসে মিলেছে।  পশ্চিম থেকে এসেছে উতলা নদী আর পুব থেকে বিসরামঝোর।  পাঞ্চেতের উত্তরে ধাঙ্গি পাহাড়।  পাঞ্চেত থেকে দূরহত পাহাড়ের পনেরো-বিশ কিমি দক্ষিণে দ্বারকেশ্বর-দামোদর বিভাজিকা।  বর্ধমানের গা-ছোঁয়া বাঁকুড়ার সমতলভূমি জেলার মাঝ-বরাবর এসে উঁচু-নিচু গড়ন পেয়ে পশ্চিমে টিলা পাহাড় আর শৈলশিরায় রূপান্তরিত।  সেই পাহাড় প্রান্তর ক্ৰমে ধানবাদ ছুঁয়ে মিশে গেছে রাঁচির পাহাড়ে।  ভাষান্তরে, রাঁচির মালভুমি, পুরুলিয়া-বোকারোর বুকে চড়ে ধানবাদ মাড়িয়ে উঠেছে বাঁকুড়ার মাথায়।  মাটির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে দক্ষিণ রাঢ়ের আসানসোল-রানীগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায়, বাঁকুড়ার শুশুনিয়া-বিহারীনাথ শৈলভূমে।
দ্বাদশ শতকে রাজন্যপোষিত কবি সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর 'রামচরিত' কাব্যে লিখেছেন দামোদর তটবর্তী তেলকুপি গ্রামটি ছিল শিখর রাজাদের রাজধানী।  অর্থাৎ আজ যে জায়গাটি পাঞ্চেত জলাধারে নিমজ্জিত, সেটি ছিল শিখরভূম রাজ্যের অংশ।  অবশ্য আইন-ই-আকবরীতে শেরগড় পরগনাকেই বলা হয়েছে শিখরভূম, যা ছিল বর্ধমানের দামোদর-অজয়ের সংযোগস্থল।  যা হোক, ১৯৫৬ সালে পাঞ্চেত ড্যাম তৈরির সময় তেলকুপির বেশ কিছু প্রসিদ্ধ মন্দির জলের তলায় চলে যায়।  তলিয়ে যায় বহু শাক্ত-শৈব-জৈন সৌধ মূর্তি।  এছাড়া বেশ কিছু গ্রামও জলে ডুবে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।  যে-কারণে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষজন বেশ মারমুখী সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।  সেই আন্দোলনের ছবি ধরা হয়েছে আমার যন্ত্রস্থ উপন্যাস 'দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণে'।  পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে পঞ্চকোট রাজাদের প্রাচীন গড় আর রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে আজও।  ভাঙাচোরা কিছু মন্দিরও।  অন্যান্য পাহাড়ের চূড়াও দেখা যায় এখন থেকে।  একটি শিখরের নাম 'ঘাতক পাহাড়'।  জনশ্রুতি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ওই পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলা হতো।
বরাকর দামোদরের ভাই।  তারও উৎস হাজারিবাগ পাহাড়।  জাতীয় সড়ক ২, ৩১ ও ৩৩-এর সংযোগস্থল বিরহী থেকে আঠারো কিমি দূরে বরাকর নদে ডিভিসির প্রথম প্রকল্প তিলাইয়া বাঁধ।  কোডরমা স্টেশন থেকে উনিশ কিমি।  ১২০০ ফুট দীর্ঘ এবং ৯৯ ফুট উঁচু এই বাঁধে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিরহী ছাড়িয়ে হাজারিবাগ রোড ক্রস করে বরাকর পিরটাঁড়ের দিকে এগিয়েছে অত্যন্ত শ্লথ গতিতে।  ধানবাদ জেলার উত্তর সীমান্ত শিখর ছুঁয়েছে সারা বা নওয়াটাঁড়ের কাছে।  তারপর পঞ্চাশ মাইলেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে ধানবাদ-গিরিডি, ধানবাদ-সাঁওতাল পরগনা এবং ধানবাদ-বর্ধমানের সীমারেখা চিহ্নিত করে পাঞ্চেতে ঝাঁপ দিয়েছে দামোদরের বুকে।  গিরিডির সীমান্তে উশ্রী নদী এসে বরাকরকে দিয়েছে গতি।  তারপর টুন্ডি, পানড্রা, মাইথন, চিরকুন্ডা হয়ে বরাকর ছুটেছে পাঞ্চেত অভিমুখে।  ধানবাদ শহর থেকে ৫০ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ বর্ডারে মাইথনে এই বরাকর নদের ওপর বাঁধা হয়েছে ১৫৭১২ ফুট লম্বা আর ১৬৫ ফুট উঁচু ডিভিসির অন্যতম প্রধান বাঁধ মাইথন ড্যাম।  সাবেক সালানপুর গ্রামের অর্ধেকটা হয়েছে আজকের মাইথন।  পর্যটকদের পাঞ্চেতের চেয়ে বেশি টানে মাইথন।  সত্যিই রমণীয় বাঁধটি।  বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে একপাশে চোখে পড়ে দু-পাশে বিস্তীর্ণ বালুকাস্তূপের মধ্যে তরল রজতের মত অতিকায় বরাকর।  অন্যপাশে দেড়শো ফুট নিচে খাদ-প্ৰমাণ জঙ্গল ও পাথুরে জমি।  বাঁধের নিচে ৬০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরির হাইডেল পাওয়ার স্টেশন।  পাহাড়ের গভ্যন্তরে ১৩৫ ফুট গভীর এই প্রকল্প।  এছাড়া রয়েছে ডিয়ার পার্ক, আর শীতের দিনে উড়ে এসে জুড়ে বসা হরেক রকম পাখিদের স্যাঙ্কচুয়ারি।  এখানকার আরেকটি আকর্ষণ বরাকর-দেন্দুয়া ভায়া মাইথন সড়কে হ্যাংলা পাহাড়ের গায়ে পাঁচশো বছর পুরনো কল্যাণেশ্বরী মাতার মন্দির।  শোনা যায়, কুষাণদের তাড়া খেয়ে হরিগুপ্ত পালিয়ে এই পাহাড়ে আশ্রয় নেন।  এখানে তিনি রাজ্য গড়ে তোলেন।  মন্দিরটিও তাঁর তৈরি।  কৃত্রিম গুহার দ্বারে অষ্টধাতুর প্রতিমা, অন্দরে সোনার তৈরি দেবীর মূল বিগ্রহ।  মন্দিরের উত্তরে স্রোতস্বিনী চালনা বা চাল্লাদহের পাড়ে দেবী কল্যাণেশ্বরী বা শ্যামা যেখানে শাঁখা পরেন তারই স্মৃতিতে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত মন্দির।  পঞ্চকোটের মহারাজা কল্যাণ শেখর আনুমানিক ১২১৫ শকে সেনবংশের কুলদেবী শ্যামারূপাকে এনে শ্রীশ্রীকল্যাণেশ্বরী নামে এই অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা ত্রিপুরী দেবীর মূর্তিটি প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন।  মায়ের পদচিহ্নও রয়েছে পাষাণবেদিতে।  আর আছে চতুর্দশ শিবমন্দির।  শীতলা মায়ের থানে মনস্কামনা পূরণার্থে ঢিল বাঁধার প্রথা আছে।  এ-বাদে নতুন তৈরি হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির।  'মায়ের স্থান' বলেই তিন বর্গ কিমি জুড়ে তৈরি টাউনের নাম মাইথন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন