শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

অন্বেষা রায়


দুপুরের ফোন
-------------------

-------------------
আজ ভেবেছিল খেতে খেতে বিকেল গড়াবে।দুপুরে ফোনটা এলে ধরতে পারবে না।এত রান্না! রাতে ওঁর অফিসের লোকেরা আসবে।ভাবতেই বুক দুরু দুরু করে ওঠে।বড় বড় মানুষ, শুধু তো খাবার বেড়ে দিলেই হল না, মানানসই থালা বাসন, ন্যাপকিন ভাঁজ সব দিকে নজর রাখতে হয়।উনি আবার বলে দিয়েছেন একদম খাঁটি বাঙালি খাবার হতে হবে।মিস্টার আহুজা নাকি 'বাংগালি ফুড' বলতে পাগল।আর মিস্টার আহুজাকে খুশি করতে পারলে সিধুর বাবার ব্যবসার কিসব সুবিধে হয়।
  পারুল কিন্ত বলেছিল যদি কিছু গণ্ডগোল হয়! তার থেকে ভাল দোকান থেকে আনিয়ে নাও।কিন্ত সিধুর বাবা গম্ভীর গলায় বলেছিল,
" মন দিয়ে রাঁধলে তো তুমি মন্দ রাঁধো না, তুমিই করো।" 
পারুলের কান দুটো জুড়িয়ে গিয়েছিল। " তুমি তো মন্দ রাঁধো না!"
এমন কথা যে তাকে আগে কেউ বলেনি তা তো নয়।বরং এর থেকে অনেক বেশি প্রশংসাই পেয়েছে সে। তবু সিধুর বাবার কথা আলাদা।তাঁর মুখে তো চিরকাল একই ধাঁচের বুলি," রান্নাঘরে গা ঢেকেই তো কাটিয়ে দিলে, দুনিয়াদারির বোঝটা কি!"
"বুদ্ধি বলে তো ঘটে কিছু নেই, সব ব্যপারে কথা বলো না।" 
শুনতে শুনতে নিজেও সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে তার দ্বারা কিছু হবে না।সামান্য রান্নাবান্না ছাড়া।এই আত্মবিশ্বাসহীনতা,নিজের প্রতি অশ্রদ্ধার মাঝে যখন "তুমিও মন্দ রাঁধো না" গোছের বাক্যাংশ কানে আসে তখন ভেতরে এক অদ্ভুত অভিমান ভরা সুখ হয়।সেই সুখানুভূতি পারুলকে গলিয়ে দেয়।স্বামীর প্রতি আরো যত্নশীল করে তোলে।


 শাশুড়িকে পানটা সেজে ঠিক তিনটে নাগাদ ঘরে ঢুকে দরজা দিল পারুল। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। কাপড়ের গায়ে জেদি দাগের মতন একটা অপরাধবোধ লেগে আছে ভেতরে। ঝুমির কথা রাখতে সেদিন ফোন করেছিল।ঝুমি সম্পর্কে পারুলের ননদ।দিনরাত খোঁটা দিচ্ছে পারুলকে।
"দাদাকে বিয়ে করে পেয়েছটা কি তুমি! সারাদিন ঝিগিরি করা আর তার মেজাজ সওয়া। লজ্জা করে না তোমার? পালাতে ইচ্ছে করে না? এত সুন্দর দেখতে,এতো গুণ! দাদার গলাতেই মালা দিতে হল শেষপর্যন্ত?  এইজন্য তোমার মা এত কষ্ট করে জন্ম দিয়েছিলেন বুঝি?"
পারুলের কষ্ট হয় ঝুমির কথা শুনে।স্বামীর দায়সারা প্রশংসায় গলে যেতে যেতে কোথাও যেন ধাক্কা লেগে শক্ত হয়ে যায় ফের।ঝুমির তো ভালবেসে বিয়ে ছিল।পাঁচ বছরের সম্পর্ক,  দু বছরও টিকলো না বিয়েটা।দুটো প্রমোশনের পরেই বিগড়োতে লাগল সবকিছু।ঝুমি বলে, " ওসব সন্দেহ ফন্দেহ স্রেফ অজুহাত বৌদি।আসল কথা হিংসা।আমার উন্নতি সহ্য হচ্ছিল না ওর।তাই মাঝখান থেকে আমার বসকে টেনে....."
বস ভদ্রলোক মানে ওই অভিরূপ বরাট কিন্তু বেশ ঝকঝকে।বয়সটাও মানানসই ঝুমির সাথে।ঝুমির ফ্ল্যাটেই আলাপ হয়েছিল।পারুল কথায় কথায় আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করেছিল সত্যিই কিছু আছে কিনা ওদের মধ্যে।কিন্তু ওরাই উলটে পারুলকে নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে উঠল.....

এলোপাথাড়ি ভাবনার মাঝেই ফোনটা কাছে নেয়। 
ফোনটা যদি আসে তাহলে এই সময়েই আসার কথা।
 এর আগে দুদিন ঝুমির ফ্ল্যাটে যাওয়ার নাম করে.......
সিধুর বাবাকে না জানিয়ে এতোটা করা ঠিক হচ্ছে কিনা জানেনা পারুল।কিন্তু জানালে যে আর এগোতে পারবে না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।শুধু নিরাপত্তার উষ্ণ আশ্রয় নয়,জীবনকে কখনো কখনো ধাক্কাও দিতে হয়।  ঝুমির কথা উড়িয়ে দিতে পারে না পারুল।এত বড় একটা চ্যানেলের দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছে মেয়েটা।নিজের বোনের মতন ভালবাসে বৌদিকে।খালি বলবে, "রোজগার করছো না তাও মানলাম তা বলে তোমার নিজের একটা পরিচয় থাকবে না?"

বাইরে বাজ পড়ে কোথাও। চমকে ওঠে পারুল।
"আমাদের সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।আড্ডা হেঁসেল।আমি চাই ওদের আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় তুমি যাও।তোমার স্পেশাল কোনো রান্না সকলকে শেখাতে।"
ঝুমির কথাটা তখন বিরাট একটা ঠাট্টা মনে হয়েছিল।কিন্তু ও এতো জোর দিয়ে বলছিল যেন পারুলকে স্বীকৃতি দেওয়াটাই ওর একমাত্র স্বপ্ন।
" তুমি অডিশনটা দাও অন্তত।দেখোনা কি হয়।অভিরূপদাও তোমাকে নিয়ে খুব আশাবাদী।শুধুমাত্র অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য এ পৃথিবীতে আসোনি তুমি।প্লিজ না কোরোনা।যদি জিতে যাও তাহলে পরপর তিনটে পর্ব সঞ্চালনা করার সুযোগ পাবে। সেই সংগে প্রাইজ মানি তো আছেই।দরজাটায় ধাক্কা দিয়েই দেখো না সেটা খোলে কিনা।"

 অডিশন খুব সহজেই উৎরে গিয়েছিল পারুল।তারপর ছিল আসল প্রতিযোগিতা। আর আজ সেই প্রতিযোগিতার ফলাফল।হাতে ফোনটা  ধরে বসে থাকে পারুল।অনেক সাহস করে দরজায় ধাক্কা দিয়েছে সে।দেখা যাক  খোলে কিনা.....
------------------------শেষ-------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন