শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

মানসী গাঙ্গুলী


 #আত্মসুখ

       শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আজ বিশাল হইচই, চারিদিকে লোকে লোকারণ্য,কেউ জানে,কেউ না জেনেই ভিড় দেখে আরও ভিড় বাড়িয়ে চলেছে, কেউ বা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। টুকরো টুকরো কথা ভাসছে বাতাসে,তার থেকে অনুমান করা যায় কিছুটা। খানিক পরেই স্কুলে পুলিশ,অ্যাম্বুলেন্স,হই হই কান্ড।
       ক্লাস এইট এর সুদীপ্তা ক্লাস রুমের ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলছে,জিভটা তার বেরিয়ে আছে।ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে খাতায় আঁকিবুকি কাটছিল তাইতে মিস বকায় নাকি সম্মানে লেগেছে,তাই। এবার শুরু হলো জল্পনা,কিন্তু কখন করল? কেউ জানতে পারল না?গলায় ওড়না পেঁচিয়েছে ও কি জানত মিস বকবেন? আসল রহস্যটা যে কি কেউ জানে না। একজন মিসের নাম বারেবারে শোনা যাচ্ছে,তিনি নাকি খুব মুখরা আর তাঁর বিরুদ্ধে রোষ ওগড়াছে জনতা। সবাই তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছে যখন একজন তাঁর পক্ষ নিয়ে বলে আচ্ছা স্কুলে তো ক্লাস শুরুই হয়নি এখনও তাহলে মিস বকলেন কখন? অপর একজন বলল সেটা বোধহয় কালকের ঘটনা আর তার জেরেই......।
          অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল বডি নিয়ে হাসপাতাল, পুলিশের গাড়িও বেরল,মেয়েরা কান্নাকাটি করছে,কেউ দুঃখে,কেউ ভয়ে,ক্লাসরুম তালাবন্ধ। স্কুল আজ বন্ধ করে দেওয়া হবে কিন্তু মেয়েরা যে গাড়িতে স্কুলে এসেছে তা তো বেশিরভাগ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে তাহলে ওই মেয়েরা কিভাবে পৌঁছাবে?সমস্যা অনেক। টিচাররা দায়িত্ব নিয়ে গেটের বাইরে যেসব গাড়ি তখনও ছিল তাদের সাথে কথা বলে যাদের গাড়ি বেরিয়ে গেছে তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন। যদিও অনেক গাড়িই তখনও ছিল।স্কুলে পৌঁছাবার পর ড্রাইভাররাও অনেকে খানিক সময় আড্ডা মারে স্কুলের বাইরে,আর তারপরেই আজ এমন একটা মুখরোচক খবরে অনেকেই প্রায় থেকে গিয়েছিল।
      সত্যিটা জানা গেল অবশেষে,বাপ সোহাগী মেয়ে বাবার ওপর তীব্র অভিমানে এই কাণ্ডটি করেছে। তিন বছর হলো মায়ের এক খুড়তুতো বোন মফস্বল থেকে শহরে এসেছে কলেজে পড়াশোনার জন্য,দিদির বাড়ি থেকেই পড়াশোনা চলছিল তার।ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল।খুবই আনন্দে ছিল সুদীপ্তা মাসিকে পেয়ে,কত হইহই করে সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া,রেস্টুরেন্টে খাওয়া। রাতে মাসির সাথেই শুত ও,ভাই শুত মা-বাবার সাথে।ঘুমের মাঝে রাতে একদিন গরম লাগায় ঘুম হালকা হতে টের পায় বিছানায় আরও কেউ,ফিসফিস করে কথা কানে যায়, ঘুমের ঘোরে বোঝেনা অত তবে মনে হয়েছিল যেন বাবা এসেছিল ঘরে। এমন মাঝে মাঝেই মনে হতে একদিন কথাটা মাকে বলে আর এই নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তিও হয় বাবা মায়ের মধ্যে। মা মাসিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চায়,বাবা চায় না। এভাবে অশান্তি চলতে থাকে বাড়ির পরিবেশও খারাপ হয় ক্রমে। বড় হচ্ছে সুদীপ্তা,বুঝতে পারে যা ঘটছে তা না ঘটারই ছিল,মায়ের চোখের জল ওকে কষ্ট দিতে খুব। বাবাও আর কাছে ডাকত না,আদর করত না,ও ও অভিমানে বাবার কাছে আর কিছু আবদার করত না। এভাবে চলতে চলতে মাসির পড়া শেষ হলে মা ভাবল এবার বাঁচবে বোনকে পাঠিয়ে,শান্তি ফিরবে সংসারে।
        কিন্তু না,তা হবার নয়,একদিন অফিসিয়াল ট্যুরে যাবার মতন স্ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলে মাসিও
 ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মাকে বলে,"আর তোমায় জ্বালাব না, আমি চলে যাচ্ছি"। মা কোন উত্তর দেন না।কদিন পরেও বাবা না ফিরলে অফিসে ফোন করে মা জানতে পারেন অফিস থেকেই তাদের আমেরিকার অফিসে পাঠানো হয়েছে সোমেশ বাবু মানে সুদীপ্তার বাবাকে।উনি নিজেই এই পোস্টিং এর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এরপর মা কাকার বাড়ি ফোন করে জানতে পারেন মাসি সেখানে ফেরেনি। পরে ওরা জানতে পারে মাসিকে বিয়ে করে বাবা আমেরিকা নিয়ে চলে গেছে চিরকালের জন্য,আর ফিরবে না।চোখের জলে মা ভাসছিল, চারিদিকে আঁধার,ভাইটা  ভালো করে বুঝতেও শেখেনি। বয়ঃসন্ধিক্ষণে যখন নানারকম মানসিক অবস্থায় সুদীপ্তা জর্জরিত সেই সময় ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকতে থাকতে আর সহ্য করতে না পেরে এই কাণ্ডটি করেছে সে,আর মিসের বকুনিটা ইন্ধন যুগিয়েছে মাত্র তাতে।তবে সুদীপ্তার বই থেকে পাওয়া চিঠি বাঁচিয়ে দিয়েছে মিসকে যাতে বাবার উপর অভিমান ওগরানো ছিল। যার শেষে লেখা ছিল," বাবারা শুনেছি আশ্রয় হয়,বটগাছের মত আর বাবা তুমি আমাদের এভাবে নিরাশ্রয় করে চলে গেলে কেবল নিজের আত্মসুখের জন্য?তোমার সু-এর জন্য তোমার মনটা একটু কাঁদল না?"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন