শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

শমিতা চক্রবর্তী


মরণের পরে 
-------------------
                     

আজ সেই অভিশপ্ত দিনটা -২৫শে জুলাই ! প্রত্যেক বছর এই দিনটায় কেমন যেন একটা আতঙ্ক অব্যক্ত যন্ত্রণার অবয়ব নিয়ে ঘিরে থাকে আমাকে ! আজ পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো দিনটার --তবুও চোখের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান সেই দিন টা ----------
                            সকাল থেকেই কখনও ঝিরঝির কখনও ঝমঝম --অবিরাম বৃষ্টি চলছে সেদিন ! তাড়াতাড়ি ক্লাস অফ্ হয়ে গেছিলো --বাড়ি ফিরে এসেছিলাম অসময়েই ! শ্রী দরজা খুলেই ঝর্ণা র মতো কল কল হেসেছিলো --ওমা তুমি ! কি টেলিপ্যাথি দেখো --আমি ভাবছিলাম আজ যদি তুমি তাড়াতাড়ি ফেরো -ইভিনিং শো এ একটা সিনেমা দেখে আসবো --সলমন খানের বই চলছে --প্লিজ না কোরোনা ! শ্রী -টা মাঝেমাঝে এমন ছেলেমানুষী করে না !  ওর আবদার রাখতেই হল --সত্যিই তো ডোডো -ছোট আছে বলে অনেকদিন কোথাও বেরোনো হয় না --মা সবসময়ই আপত্তি তোলেন ! অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মায়ের অনুমতি আদায় করে --ডোডো কে মায়ের জিম্মায় রেখে --বেরোলাম l 

                      বৃষ্টি কমার লক্ষণই নেই ! সিনেমা শেষের পর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম --শ্রী ও এবার ছটফট করে উঠলো --ডোডো টা কতক্ষণ মায়ের কাছে --রাতও প্রায় দশটা বাজতে চললো ! চলো না হাঁটা দিই --রাস্তায় যদি রিক্সা -টিক্সা পাওয়া যায় ! অগত্যা হাঁটা -----

                     রাস্তা প্রায় ফাঁকা --দুটি ছাতা সম্বল করে হাঁটা --ভিজে ঝুপ্পুস দুজনেই ! হঠাত্ই যেন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ওরা ----এক লহমায় ঘটে গেলো সবকিছু --আমাকে জাপটে ধরলো কজন --শ্রী র হাত ধরে টানছে --বাধা দিতে গেলাম --মাথায় একটা আঘাত --ব্যস আর কিছু মনে নেই ! অনেক রাতে আবিস্কার করলাম --আমি হসপিটালে র বেডে --রাস্তায় টহলদারি পুলিশ তুলে এনেছে এখানে --বাড়ি তেও খবর করা হয়েছে --শুধু শ্রী র খোঁজ মেলেনি ! 

            পাওয়া গেল শ্রী কে পরদিন --রাস্তার পাশে একটা ঝোপের ধারে বিবস্ত্র অবস্থায় --সারা শরীরে অত্যাচারের চিন্হ স্পষ্ট ! একমাস হসপিটালে থাকার পর বাড়ি ফিরে এলো বটে শ্রী কিন্তু এ এক অন্য শ্রী ! সারাক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে --আমি বা কেউ কাছে এলেই কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে যায় --নিজের স্ত্রী র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও কেমন যেন কুণ্ঠা হয় ! বড় অপরাধী লাগে নিজেকে ! ডোডো টাও ঠাম্মার আঁচল ধরে ভয়ে ভয়ে মায়ের ঘরে উঁকি মারে ! 

                  মায়ের অবিরাম বিলাপ অব্যাহত --আজকাল অসহ্য লাগে ! শ্রী কে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোও হয়েছে --ডক্টর বলেছেন --ট্রমা টা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে ! 

                     দিন -মাস -বছর পেরিয়ে গেলো শ্রীরাধা --আমার শ্রী আর কোনদিন ই ট্রমা টা কাটিয়ে উঠতে পারলো না --বরং ওষুধের প্রভাবে দিন দিন ওর অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ আরও শিথিল হতে থাকলো --আস্তে আস্তে একেবারেই বেড -রিডন ! আগে তাও জোর করে জানলার পাশে চেয়ারটায় বসাতাম --এখন শুধু বিছানাটাই তার জগত্ ! 

     দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলো ডোডো এখন আঠাশ বছরের পূর্ণ যুবক ! কিছুটা ভরসা পেতে শুরু করেছি ! কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় আমার প্রতি সহায় নন --সম্প্রতি শ্রী র শরীরে বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ ! 

                 ওর প্রতিদিনকার জ্বালা যন্ত্রণার সাক্ষী আমি ! ভাগ্য কে দোষ দিই , কপাল কে দোষ দিই ! রোজ ভাবি শ্রী কে যদি এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে পারতাম ! যদি ইচ্ছামৃত্যু কে এদেশের আইন স্বীকৃতি দিতো ! তাহলে হয়তো এমন কত শ্রী সত্যিই বেঁচে যেতো ! 

               কখনও কখনও মরণের পরেই বুঝি সত্যিকারের বাঁচা যায় ! 
         -----------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন