শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

মেঘশ্রী ব্যানার্জী




#শিরোনাম: মৌনমুখর

হাওড়ার এক ঘুণ ধরা পুরনো পাড়ায় আর চারঘর ভাড়াটের সাথে বাস অলকের। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে। বাবা ছিলেন রাজ্য সরকারী অফিসে টাইপিস্ট। চাকরির অবসরের পর আরো দুটি বছর দিনগত পাপক্ষয় করে জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন তাও প্রায় বছর দুই হল। ছেলে অলককে নিয়ে না বাবা না মা কেউই কোন স্বপ্ন দেখেন নি কোনদিন - যেমন স্বপ্ন এই পুরোনো পাড়ার অন্য বাবা-মায়েরা দেখেছিলেন তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তারই ফলস্বরূপ আজ গোটা পাড়াটা উচ্চাকাঙ্ক্ষার দাম মেটাচ্ছে প্রায় বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হয়ে!
অলক একটু আলাদা। ছোট থেকে 'মূক-বধির' স্কুলে তার পড়াশুনা। খুব যে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছে তা নয়। প্রতিবন্ধী কোটা সত্ত্বেও সরকারী চাকরির পরীক্ষাতে সুবিধা করতে পারেনি। তাই বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে তাঁর বন্ধু অতীন্দ্রমোহন বসুর প্রকাশনায় ছোটখাটো একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আহিরীটোলায় কাকাবাবুর তিনতলা বাড়ির নিচের তলায় অফিস। যাতায়াতের মাধ্যম হিসাবে অলক লঞ্চকেই বেছে নিয়েছে। এতে যেমন যানজট থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তেমনই গঙ্গার বক্ষবিভাজিকায় টলমল করতে করতে পৌঁছে যাওয়া যায় লক্ষ্যে।
ফেরার পথে কখনও বা একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চুপটি করে বসে থাকে আহিরীটোলার ঘাটে কিম্বা এপারের বাঁধাঘাটে নেমে জলের ধারে বসে কাটায় কিছু সময়। দেখে ফেরিঘাটের ব্যস্ততা। সদাই ফেরির আসা যাওয়া - মানুষের ছুটোছুটি - সিঁড়ির চাতালে হরেকরকম চটপটা খাবার নিয়ে হকারের সওদা - ঘাটে সময় কাটাতে আসা প্রেমিক-যুগলের উষ্ণতার আদানপ্রদান -- সমস্ত ঐ বাঙ্ময় দুইচোখ দিয়ে প্রাণ ভরে শুষে নেয় অলক। আশেপাশের প্রতিটি ক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার মনবীণার তারে সৃষ্টি করে চলে মানানসই শব্দতরঙ্গ! সেই শব্দকোষের মালিকানা তার একান্ত আপন! কোন কোনদিন বুক ভরে নেয় সূর্যাস্তের ঘ্রাণ। গঙ্গাবক্ষের রঙ পরিবর্তন দেখে অপলকে - সকাল থেকে ব্যস্ত 'মা' গঙ্গা যেন অস্তরাগের সোহাগ মেখে হয় লাজে রাঙা 'প্রেয়সী'। অলক এখানে প্রথমবার প্রেমে পড়ে -- প্রকৃতির প্রেমে!
প্রকাশনার অফিসঘরে অলক ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে দ্বিতীয়বার - এবার সাহিত্যের প্রেমে। দিনরাত এক করে পড়তে থাকে ছাপতে আসা সমস্ত রকম পাণ্ডুলিপি। সাহিত্যে আগ্রহ দেখে কাকাবাবু তাকে আস্তে আস্তে প্রুফ রিডারের কাজে নিযুক্ত করেন। যেহেতু জন্মবধির তাই চারপাশের শব্দে তার মন সংযোগ নষ্ট হয়না। খুব তাড়াতাড়ি এই কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে সে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একটু শিখেপড়ে নিতেই তাকে পুরনো ডেস্কটপ এ বসে ইমেইলে আসা স্ক্রিপ্ট পড়ার দায়িত্বও দিয়েছেন কাকাবাবু।
নিজের নামে একটা ফোল্ডার বানিয়েছে অলক। জন্মগত এক প্রতিবন্ধকতাই হয়তো তার অবসার্ভেশন পাওয়ার আর অনুভূতিকে করেছে প্রখরতর! ওই পুরনো কম্পিউটারের কি-বোর্ডের মাধ্যমে তার একলা বাঁধন ছেঁড়া মনকে ধীরে ধীরে উজাড় করতে থাকে। লেখে তার ফেরিঘাটের কথা - নিজের পাড়ার সমবয়সীদের বেড়ে ওঠার কথা - স্বপ্নপূরণের জন্য তাদের ইঁদুরদৌড়ের কথা - তাদের একদা গর্বিত বাবা-মায়েদের অহংকারী দৃষ্টির সময়ের বাড়ার সাথে সাথে কষ্ট-লাঞ্ছিত বোবা চাহনিতে পরিণত হওয়ার কথা এবং আরো কত কি!
আজ অলক আমন্ত্রিত অতিথি। তার ফোল্ডারে সযত্নে বেড়ে ওঠা 'বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা' কাকাবাবু পড়ে ফেলেন এবং তাকে না জানিয়ে বই হিসাবে ছাপিয়ে তাকেই উপহার দেন। তার বইয়ের প্রথম দেড়শো কপি নাকি হটকেকের মত বিক্রী হয়েছে। রয়্যালটি হিসাবে বেশ কিছু টাকা কাকাবাবু তাকে দিয়েছেন। সেদিন কথা বলতে পারলেও কি কাকাবাবুকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা তার থাকত? দুটো হাত ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেছিল অলক। কাকাবাবুর চোখের জলও বাঁধ মানেনি। তার নিজের ছেলে বাবার 'সিলি বিজনেস' এ যোগ দেবেনা বলেই যেন জেদ করে অস্ট্রেলিয়ায় রয়ে গেল। তাইতো উপন্যাসের সাথে এত একাত্ম হয়েছিলেন উনি। আজ বরাবরের করুণামিশ্রিত স্নেহের পাত্রটির জন্য তার ধুঁকতে থাকা প্রকাশনা ঘুরে দাঁড়াবার একটা আশা দেখছে আবার! একটা ওয়েলফেয়ার গ্রুপ যারা সপ্তাহান্তে বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমের অধিবাসীদের সাথে কিছুটা করে সময় কাটায় তাদের ধূসর দিনগুলো রঙীন করার জন্য আর মূক-বধির দের নিয়ে কাজ করা একটা এন.জি.ও. মিলিতভাবে তাকে সংবর্ধনা দিচ্ছে আজ।
একটি বৃদ্ধাশ্রমেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানকার সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন বয়সী কিছু মানুষও আছেন যারা অলকের মতই একটু 'আলাদা'। এক সুবেশী মহিলা তার উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ পাঠ করে শোনাচ্ছেন আর একটি কিশোরী তা প্রকাশ করছে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে। অলক আর কাকাবাবু স্মিতহাস্যে মঞ্চ আলোকিত করে আছেন। কাকাবাবুকে ছাড়া একা আসতে সে কিছুতেই রাজী হয়নি। আজ অলকের শুনতে না পাওয়ার কোন গ্লানি নেই - উপন্যাসটির প্রতিটি শব্দ তার মনের মাঝে গাঁথা। তার আজন্ম অকথিত চুপকথাগুলি আজ সকলের অনুভূতির সাথে একাত্ম হচ্ছে । পাঠ শেষের করতালিতে মুখরিত চারদিক - যেন অলকের মৌনতার পরিপূরক। বয়স্ক মানুষগুলি তাঁদের চোখ আর ঝাপসা চশমা মুছতে মুছতে অলকের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ জানাচ্ছেন - কেউবা টেনে নিচ্ছেন বুকে। আর উৎসাহিত অন্য একটি দলের মুখে অলক প্রদত্ত আশার আলো। এই মুহূর্তের একরাশ ভালোলাগার দোলা আর প্রেয়সী গাঙ্গেয় বিভাজিকার দোলা মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে অলকের সত্ত্বায়! দুচোখ বেয়ে নামছে মা গঙ্গার প্লাবন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন