শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

শর্মিষ্টা দত্ত


অভিযোজন (৫)

বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে । প্রসূন,প্রমোদ আর পাড়ার কয়েকজন সকাল থেকেই মর্গে ।পোস্টমর্টেম শেষ করে বডি রিলিজ করতেই কেটে গেল সারাটা দিন । পাশের বাড়ির অনিলদা  কংগ্রেসের ডাকসাইটে  নেতা প্রিয়বাবুর চেলা , সে এসে না পড়লে  তাও হত কিনা সন্দেহ ।এই নৈরাজ্যে এখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো কাজই হয় না ।প্রসূন মারমুখী হয়ে উঠছিল ,প্রমোদ ধমকে থামালেন তাকে ।অঝোরবৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে জুলাই মাসের সন্ধ্যে । ।কেওড়াতলা শ্মশানে পৌঁছতে পৌঁছতেই সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত ।প্রণবের সঙ্গে শেষ কবে কথা বলেছেন  মনে করতে পারেন না প্রমোদ ...তবু গলার কাছে কেমন যেন তিতকুটে স্বাদ ।অম্বল হয়ে গেছে নির্ঘাত ,সারাদিন কয়েক কাপ চা ছাড়া তো আর কিছু পড়েনি পেটে ! ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা কেমন যেন সৃষ্টিছাড়া ।বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পাড়ার আজেবাজে ছেলের সঙ্গে মিশে বখে গিয়েছিল ।অবশ্য প্রমোদও তেমনভাবে কোনোদিন শাসন করেননি ,সংসারের এসব ঝুটঝামেলার থেকে তিনি বরাবরই নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ।তাই বিয়ের পরেই দূরত্বের বাহানায়  নিজের পরিবারকে নিয়ে আলাদা সংসার গুছিয়ে নিয়েছিলেন । 

ভীষণ বিরক্ত লাগছিল প্রমোদের ,কিন্তু বাড়ির বড়ছেলে হিসেবে এ অবস্থায় এখানে  এই উপস্থিতিটুকু এড়াতে পারেননি ।সকালে বেরোনোর আগে রেখার মুখের অভিব্যক্তিতে শামুকের মতো গুটিয়ে যাচ্ছিলেন প্রমোদ । রেখা এদেশী বনেদী পরিবারের মেয়ে , অবস্থা যদিও পড়তি ,তবু বাঙাল শ্বশুরবাড়িকে কোনদিনই পছন্দ করেনি সে ।আইবুড়ো ননদ যদিও চাকরি করে ,বখাটে কার্তিকমার্কা মেজ দেওরের তো রোজগারের কোনো ঠিকঠিকানাই  নেই ।তারপর তার  বিয়ের সময় কেচ্ছা -কেলেঙ্কারি তো আর কম হয়নি ও বাড়িতে ! মল্লিকাও বাঙালবাড়ির মেয়ে তাই মনে মনে তাকে হেয় করলেও আজকাল তাকে ঈর্ষাও করে রেখা ,একে তো মল্লিকা  অসামান্য রূপসী ...রেখা টিপটপ সেজেগুজেও  তার পাশে নিতান্ত সাদামাটা ।তার ওপর সংসারের এত  অশান্তি ,ঝড়ঝাপটা সামলেও দুটো  ছোট বাচ্চা নিয়ে প্রাইভেটে বি এ পাশ করেছে এবার । ছোট দেওর প্রসূনও  বি এস সি পাশ করেছে সবে ,এখনও বেকার ।আজকাল আবার পার্টি নিয়ে মেতেছে...কবে যে শ্রীঘরে যাবে কে জানে ! আজকাল কমিউনিস্ট পার্টি করাটা শিক্ষিত ছেলেদের নতুন ফ্যাশন হয়েছে । তাই প্রমোদ বা তার রোজগারের ছিটেফোঁটাও  যেন ওবাড়িতে না যায় সেদিকে রেখার তীক্ষ্ণ নজর ।কাল রাতেই রেখা বলে দিয়েছে ,পাপাইকে এ অবস্থায় ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া চলবে না , ও বড় হচ্ছে এখন ,অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে ওকে ।ওই পরিবেশের মধ্যে গিয়ে কি শিখবে ও ! এজন্যই কেবলমাত্র নববর্ষ আর বিজয়ায় শাশুড়ীকে প্রণাম করা ছাড়া  ছেলেকে নিয়ে ও বাড়িতে যায় না রেখা ।প্রমোদও দু -তিনমাস অন্তর বড়জোর আধঘণ্টার জন্য মায়ের কাছে যায় ।এভাবেই নিজের ছোট্ট বৃত্তটার মধ্যে আবর্তিত হতে গিয়ে পারিবারিক সূত্রটা ক্রমশ আলগা হয়ে আসছে প্রমোদের ।মুখাগ্নি করার সময় তবু কেন যে চোখে জল এল ...কে জানে ! প্রণবের মেয়েরা ছোট তাই দাদা হিসেবে প্রমোদকেই এ কাজটা করতে হল ।

প্রায় শেষরাতে তাঁতীবাগানের বাড়িতে ফিরল ওরা ।আগুন ,লোহা ছুঁয়ে , নিমপাতা দাঁতে কেটে শ্মশানযাত্রীদের মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় দেওয়ার পর প্রভার  ঘরে  এলেন  প্রমোদ ।তক্তাপোষের বিছানায় তখন  দুই মেয়েকে দুপাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছে মল্লিকা ।সিঁদুর মুছে ,শাঁখা ভেঙে স্নান করিয়ে , খানিকটা সেদ্ধভাত খাইয়ে ওকে অনেকক্ষণ আগেই শুইয়ে দিয়েছে উমা ।মল্লিকাকে কোনোদিন এভাবে শুয়ে থাকতে দেখেননি প্রমোদ । শাড়িটা বুকের ওপর থেকে খানিকটা সরে গেছে ,গোড়ালির ওপরেও উঠে এসেছে খানিকটা ।ওর সদ্যফোটা ফুলের মতো পবিত্র মুখটা দেখেই শরীরে একটা আলোড়ন শুরু হল প্রমোদের ।প্রবৃত্তি পরিবেশ ,পরিস্থিতি কিছুই কি মানে না ...ছিঃ ! নিজেকে শাসন করে মায়ের কাছে এসে বসলেন তিনি । প্রভা তখনও শক্ত হয়ে বসে রয়েছেন ।উমা  ততক্ষণে খানিকটা দুধসাবু মেখে নিয়ে এসেছে ।"মা ,এবার অন্তত কিছু মুখে দাও ,সারাদিন কিছু খাও নি  ।"
"আইজ আর কিসু খামু না ..তরা খাইয়া ল ।"উমা আর কথা বাড়াল না ।দাদা আর ভাইকে খেতে দিয়ে তিতলির পাশে শুয়ে পড়ল ,কিছু মুখে না দিয়েই ।শারীরিক ও মানসিকভাবে সেও বিপর্যস্ত ।

অপঘাতে মৃত্যু তাই পাড়ার কালীমন্দিরে নম নম করে তিনদিনেই শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে গেল । মল্লিকা যেন একটু বেশিমাত্রায় স্বাভাবিক ...এটাই অস্বাভাবিক লাগছিল ওদের সবার ।একদিন দুপুরে প্রণবের ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলল ।প্রভা কষ্ট পেলেন তবু  কিছু বললেন না ওকে ...যেভাবে শান্তি পায় মেয়েটা ...পাক । তিতলি আর তিতিরের স্মৃতিতে ওদের জন্মদাতার আর কোনো অস্তিত্ব রইল না ।অবশ্য বাবাকে ওরা চিনেছিলই  বা কতটুকু ! 

তিন বছরের তিতলি ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে যখন গল্প শোনার বায়না করে ,দেড় বছরের তিতির আধো আধো বুলিতে ঠাম্মা বলে ডাকে তখন একটা স্বর্গীয় অনুভব ছড়িয়ে পড়ে প্রভার শরীরে ।না ...আর কোনো অভাববোধ নেই তাঁর ।ঈশ্বর তাঁকে যেমন সন্তানশোক দিয়েছেন ,আবার নাতনিদের নির্মল শৈশবের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগও তো দিয়েছেন ! নিজের সাধ্যমত ওদের পৃথিবীটা সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করবেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন