শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

রজতশুভ্র কর্মকার

প্রজেক্ট লাজারুস

1….
"বন্ধুগণ, আপনাদের জন্য আমার মন প্রাণ সব নিবেদিত, এলাকার উন্নয়নের জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়ে ফকির হয়ে যাবো। আপনারা যাতে ভালো থাকেন সেজন্য আমি আপনাদের সাথে থাকতে সব সময় তৎপর। এলাকার কৃষকদের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে, কৃষকদের উন্নতির জন্য আমি এইবারে প্রাণপাত করে দেব। এখানকার মহিলারা যাতে স্বনির্ভর হতে পারেন, যাতে তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়, সেটা দেখাও আমার দায়িত্ব। শুধু আমাকে একটু ভোট দিন, আমাকে জিতিয়ে দিন। এখানে আরো চাকরি আসবেই, এখানকার যুবকদের আরো উন্নতি হবেই। উন্নয়ন আসবেই। "
পুরো জ্বালাময়ী ভাষণ, নিচ থেকে জয়ধ্বনি আসছে "রবিন দা জিন্দাবাদ"। সাথে জোরদার হাততালি, রবিন বাবু বেশ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কৃষক, সৈনিক এবং এরকম বেশ কিছু মানুষদের নিয়ে ঠিকঠাক বলতে পারলে জনগণ হাতের মুঠোতে। ইলেকশন জেতা এখন সময়ের অপেক্ষা। যদিও পুরো ব্যাপারটা মসৃন হয়েছিল তা নয়! কতগুলো লোক কৃষিঋণ মকুব কবে হবে, সার, বীজ এগুলোর দাম কবে কমবে এগুলো নিয়ে চ্যাঁচামেচি করছিলো। রবিন যদিও রেয়াত করেননি এসব বদমায়েশি। পুলিশ দিয়ে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। এইটুকু বাদ দিলে তার আজকের জনসভা পুরো আগুন। জয় নিয়ে কোনো সন্দেহের আর অবকাশ নেই রবিনের।
"স্যার, এখন বেরোতে পারলে ভালো হয়, পার্টি প্রেসিডেন্টের সাথে মিটিং আছে। " পাশ থেকে সেক্রেটারি তাগাদা দিলো। অবনী ঘোষ ডেকে পাঠিয়েছে আবার!  লোকটা কথায় কথায় খালি রবিনকে জ্ঞান দিতে আসে। এর আগে কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে একদিন একটু হলেই তুলকালাম হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। বলে কিনা রবিনের জন্য নাকি এটা "লাস্ট ওয়ার্নিং !" ভেবেই রবিনের মাথা টা একটু গরম হয়ে গেলো।
"হ্যা চলো চলো, আর কি! জলদি চলো! খাবারের ব্যবস্থা আছে তো?"
"হ্যা স্যার, আর সাথে আপনার স্পেশাল স্কচও।"
সবাই জানে রবিনের জন্য চাই সিঙ্গল মল্ট স্কচ। ওটা পেলে রবিন খুশি। আর এলাকাতে সবাই জানে ওনার কতটা প্রভাব আর প্রতিপত্তি। কৃষক আত্মহত্যার পরিমান যদিও বেড়েছে অনেকটাই, কিন্তু রবিন ১ টাকা কেজি দরে চাল আর ডাল দিয়ে সমর্থন এখনো নিজের দিকে রেখেছেন। বিরোধীপক্ষ তাকে এই নিয়ে বেঁধার চেষ্টা করেই চলেছে, কিন্তু তিনিও কম জাননা, খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের প্রাণের ভয় থেকে শুরু করে সব রকম ভয় দেখিয়ে হুমকি দিয়ে রেখেছেন। পুলিশ ও তার এবং তার দলের হাতের মুঠোয়।  তিনি থাকতে ধুতরো ফুল চিহ্নে ভোট পড়বেই।
2….
ইনোভা গাড়িটি চলছিল, রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালোনা। বিশেষ করে সামনেই একটা খাল মতো রয়েছে, সেখানে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। মিনতিবালা আর ওর পূর্ত দফতর কি করছে কে জানে! জোরালো ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা উল্টে যাচ্ছিলো প্রায়। কোনোরকমে ড্রাইভার সামলে নিলো। দুটো ৪ অক্ষরের শব্দ বলে বিরক্তি প্রকাশ করলেন রবিন বাবু।
"সামলে চালা শুওরের বাচ্চা! মারবি নাকি? সালা এরকম চালালে তোর মাইনে বন্ধ!"
"সরি স্যার, রাস্তার অবস্থা তো দেখেছেন। "
"রাস্তার অবস্থা নিয়ে জ্ঞান দিতে না এসে তুই গাড়িটা চলা। সালা তোকে এতগুলো টাকা দিয়ে পুষি কি জ্ঞান দেবার জন্য?"
"মাফ করবেন স্যার।"
"বেশি না হেজিয়ে গাড়িটা চালা। "
গজগজ করছিলেন রবিনবাবু। একে তো মাথা গরম। গাড়িতে বসে স্কচ এ চুমুক দিচ্ছিলেন। একটু হলেই অত দামি হুইস্কিটা চলকে পাঞ্জাবিতে পড়ে যেতে পারতো। এই সব ছোটোলোকগুলোকে বেশি মাথায় তুললেই আবার চড়ে বসে। আর ইদানিং রবিনের মাথা যেন একটু বেশি গরম হয়ে যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই আজকাল মাথা গরম করে সবাইকে যা মুখে আসে তাই বলে দেন। আর এটা বেশ কয়েকমাস হলো হয়েছে, অনেকে জ্ঞান দিতে এসেছিলো যে, মাথাটা ঠান্ডা করতে, নাহলে নাকি রাজনীতি হবেনা! রবিন পাত্তা দেননি, একদম নিচু থেকে উঠে এসেছেন। নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝেই ছাড়বেন উনি। আপাতত বিধায়ক হিসেবেই রয়েছেন, এর পরে ওনার লক্ষ্য মন্ত্রী হওয়া। এর জন্য যা করা  দরকার সেটাই করবেন। ছেড়ে দেবেননা কাউকে।
3…..
ড্রাইভার এর কথায় সম্বিৎ ফিরলো,
"স্যার, পৌঁছে গেছি দেখুন!"
চোখটা লেগে এসেছিলো প্রায়। ঘড়ি দেখলেন, অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছেন রবিন! মানে কড়কানিতে কাজ হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে পার্টি অফিস এর দিকে এগোলেন। গুটিকয়েক লোক ছাড়া সেইভাবে কেউ নেই। একজন বললে, " মিটিং কেমন হলো রবিনদা? যাও অবনীদা অপেক্ষা করছে।"
হ্যা আর কি, এখন গিয়ে অবনী ঘোষের সঙ্গে বকতে হবে! বিরক্তি যতটা সম্ভব চেপে রেখে দরজায় টোকা দিলেন।
আওয়াজ এলো, "চলে আসুন।"
দশাসই চেহারার অবনীবাবু তার চেয়ারে বসে ছিলেন, পেছনে একটা বিরাট বড় বই এর সেলফ, আর একটা একটা বন্ধ করা আলমারি।  কি যে আছে ওতে কে জানে। এককালে নাকি আমেরিকায় রোবোটিক্স এর ওপর গবেষণা করতেন। এখন ম্যাডাম এর পরে এই দলে অবনীই হলেন শেষ কথা। 
হাতে ধরা পেপারটা নামিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন অবনী, "কি মনে হচ্ছে? "
"সিট আমাদের হাতেই থাকবে দাদা। "
"তা হাতে থাকবে যখন, তখন আজকের মিটিং এর এই অঘটনটা ঘটানোর দরকার ছিল?"
রবিন দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন। খবর পৌঁছে গেছে ঠিকই! পার্টির মধ্যেই তাকে এখন কোনঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। 
"অঘটন কিছু হয়নি দাদা, কতগুলো লোক বেগরবাই করছিলো। পুলিশ দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছি। আর ওসব তো বিরোধীরা দায়িত্ব নিয়ে জনসভা ভণ্ডুল করার জন্য করেছিল।"
"আর কত নাম ডোবাবেন দলের? ম্যাডাম রীতিমতো রেগে আছেন এই সব কাজের জন্য। সব সময় এরকম একটা কাজ না করলেই নয়? বিরোধীরা এই নিয়ে তুলোধোনা করবে দেখবেন। "
"যা হয়েছে, ঠিক হয়েছে দাদা, এদের বোঝাতে হবে যে আমরাই পাওয়ারে আছি! এর জন্য এটুকু করার দরকার হলে করবো। নাহলে সব পেয়ে বসবে!"
"আপনাকে আগেও বলেছিলাম মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করুন। নাহলে হবেনা। এইভাবে দাদাগিরি হয়, রাজনীতি নয়!"
"রাজনীতি দাদা আপনার কাছে অন্তত শিখতে রাজি নই এখন। আর রাজনীতিতে আসল তো হলো ভোটে জেতা, সেটা আমরা জিতছি, বিরোধীদের তো চুপ করিয়েই রেখেছি। আমাদের কাজটা করতে দিন। "
অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রবিনের দিকে। ওই চাউনি দেখে রবিনেরও যেন বুকটা একটু কেঁপে উঠলো, কিন্তু সেটা বুঝতে দিলেন না। অবনী চশমাটা একবার চোখ থেকে নামালেন,
"লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম আগেরদিন, এবার ও দিচ্ছি। একটু সংযত হন। আর আজকের ঘটনার জন্য আপনাকে প্রেস কনফারেন্স ডেকে ক্ষমা চাইতে হবে। ম্যাডাম এর অর্ডার। "
রবিনের মাথার মধ্যে যেন কিছু একটা জ্বলে উঠলো। বুঝতে পারছেন যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন উনি। রবিন টেবিলে একটা ঘুষি মারলেন,
"না অবনীদা পারবনা, রবিন কারুর কাছে ক্ষমা চাইবেনা, আমি সালা ঝিলপাড়ের মাল, লড়াই করে উঠে এসেছি, কোনো শুওরের বাচ্চার কাছে ক্ষমা চাইবোনা। সে যেই ই অর্ডার দিক না কেন।"
অবনী চুপ করে দেখলেন, মাথা নাড়লেন। বিড়বিড় করছিলেন, "নাহ, এই মডেলটাও ফেল!" হাতে একটা রিমোট কন্ট্রোল উঠে এলো, লাল রঙের বাটনটা প্রেস করলেন।  গোটা শরীরে যেন একটা জোরালো ঝটকা লাগলো। রবিন একটা ভাঙা কলের মতো চেয়ারে পরে গেলেন। রবিন ভাবছেন যে ব্যাপারটা কি হলো? সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! অবনী বেল বাজাতে বাইরের চারটে লোক ঢুকে এলো, " প্রোগ্রামিং রুম রেডি কর।  ভার্শন ৬ নামাতে হবে আজ রাতের মধ্যেই। আর এই মডেলটাকে স্ক্র্যাপরুমে নিয়ে যা। ভার্শন ৫ ফেল করেছে। "
4….
রবিনের শরীরটা মাটির থেকে উঠে গেলো! চারটে শক্ত হাত তাকে ধরে রেখেছে, রবিন নড়তে পারছেননা! কোনোকিছু তার বিশ্বাস হচ্ছেনা! লোকগুলো ওদিকে বলাবলি করছে,
"এই মডেলটার আজকেই শেষ দিন! ব্যাটারী চলছে যদিও!"
"আর চললেও কি হবে! সেল্ফ ডেস্ট্রাক্ট মোড এ চলে গেছিলো! আজকে দাদা তাই প্রসেসর পুরো বার্ন করে দিলো।  অন্য মডেল ই লাগবে!"
"এই হিউম্যানয়েডগুলোর ব্যাপার সত্যি বোঝা দায়, এটা ৫ নম্বর মডেল না?"
"হ্যা, দাঁড়া ব্যাটারী খুলে নে, পরে কাজে লাগবে!"
একটা ছোট ঘরে এনে একটা টেবিলের ওপর রবিনকে শোয়ালো ওঁরা। । রবিনের হাত পা আর চলছেনা। মাথাটা ধরে এসেছে। কি হচ্ছে এটা? লোকগুলো রবিনের পাঞ্জাবিটা ছিড়ে ফেললো, আর একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে বুকের মাঝে একটা কেবিনেট খুলে একজোড়া ব্যাটারী বের করে আনলো। এইভাবে শেষ হওয়ার কথা তো ছিলোনা? মন্ত্রিত্ব এর স্বাদ তো এখনো মেটেনি! সব অন্ধকার হয়ে যাবার আগে রবিন শুনতে পেলেন, "পরের মডেলের জন্য প্রোগ্রামিং টা একটু ভালো করতে হবে, যাতে পলিটিক্সটা আরেকটু ভালো করতে পারে!"
5…
অবনী অফিস এ  বসে ছিলেন। রবিন ভার্শন ৬ এর ডিসাইন টা দেখছিলেন। এম আই টি এর প্রজেক্ট লাজারুস এর সম্পূর্ণ ফল পুরোটা পেতে এখনো অনেক দেরি, সেটাই ভাবছিলেন। হিউম্যানয়েড গুলো মাঝে মাঝেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন নতুন করে আবার শুরু করতে হয়। প্রোগ্রামিং রুম রেডি, খবর চলে এসেছে। রবিন ভার্শন ৬ কে ঠিকঠাক অ্যাসেম্বল করতে হবে যাতে ভার্শন ৫ এর মতো ভুলভাল মাথা গরম না করে। ফোন এলো সুরক্ষিত লাইনে,
"হ্যা ম্যাডাম, কোনো অসুবিধে নেই, এই মডেল কোনো বেগরবাই করবেনা। পুরো যা বলবেন তাই করবে! চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। "
দুদিন পরে, রবিন কর্মাধ্যক্ষ্য সাংবাদিক সম্মেলনে জোর হাত করে বললেন, " আমার আগের ভুলের জন্য আমি ভীষণভাবে ক্ষমাপ্রার্থী, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাদের সাথে আছি এবং থাকবো। উন্ননয়নের পথে আমরা একসাথে একটা ভালো দিন আনব। "
যদিও রবিনের চোখের লুকোনো হাসিটা কেউ আর খেয়াল করেনি। পাশে বসা পার্টি প্রেসিডেন্ট অবনীও না! প্রোগ্রামিংটা খুব জোরদার হয়েছে এবার!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন