শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়


রমাকান্ত নামাবোধোদয় 


রমাকান্তর অভিজ্ঞতা বড়  পরুষ ঘেঁষাআর হবেই না বা কেন স্বয়ং যে তিনিপুরুষ ! পুরুষ বলতে কি বোঝায় তাতাঁর বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে এখানে নেই।জগতের দুই জাতি--নারী  পুরুষ। আর বাকী সব অপরিণত রূপবাচ্চাকাচ্চা, বুড়বুড়ি, সুস্থ-অসুস্থ অথর্বইত্যাদি ইত্যাদি
অনেক কথা বলতে পারেন না রমাকান্তযা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতায় ধরা থাকে--বিশেষ করে নারী জাতির ব্যাপারেএটাও যদি এক তরফা বলা হয়ে যায়,পুরুষ জাতির পক্ষপাতিত্ব এসেই যেতে পারে--এটা জোর করে অস্বীকারকরতেও পারেন না তিনি  
জগতের সব কিছুই তো প্রকৃতির—প্রাণীও তবে প্রাকৃতিক। প্রকৃতিজাত,প্রকৃত ছিন্নমূল, তারপর অনেক দূর এগিয়ে এসেও আবার জংলী হতে কারভাল লাগে ? আর  একটা গর্ব আছেনা--সবার ওপরে মানুষ সত্য--তাহারওপর নাই ! কাজেই ব্যতিক্রমীব্যাপারগুলি নিয়ে রমাকান্ত আর মাথাঘামাতে চান না  
রমাকান্তর পাশের বাড়ির উদ্ধব বাবুরকথা মনে পড়ে বেচারা নারী নিপীড়িতব্যক্তি ! না ঠিক তা নয়, বলা যায়--স্ত্রীনির্যাতিত গোবেচারা যখনকার কথাতখন তিনি সংসার নিয়ে একটুজর্জরিত ছিলেন 
উদ্ধব নামটা কিন্তু ওবিয়াসলি নিজেরদেওয়া নয়। বাপ ঠাকুরদার দেওয়াঅথবা মা ঠাকুরমার দেওয়া।  ক্ষেত্রেবুদ্ধিমান ব্যক্তিরা যুক্তির ফাঁক ফোঁকরগলিয়ে আগ বাড়িয়ে বলতে পারেন--কেন দাদু দিদিমা না কেন ? এখানটাএকটা রেষারেষির জাগা--সংসারীমাত্রেই অবগত হবার কথা যে স্ত্রীপক্ষস্বাভাবিক ভাবে দুর্বল থাকে। 
যাই হোক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে লাভ নেই--ওইউদ্ধব বাবুর কথায় আসা যাক--বেচারার সংসারে বড় খেঁচাখেঁচিচলছিল। সাপোর্ট দেবার মত তার ঘরেমা, বাবা, ভাই, বোন কেউ ছিল না। বিয়ের আগে বাবা তারপর বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই উদ্ধব বাবুর মাও মারা গেলেন। স্ত্রী ছিলেন তাই বলবান। কারণ, স্ত্রী তার মা, বাবা, ভাই, বোনপরিবৃতা ছিলেন যে ! 
উদ্ধব বাবুর শাশুড়ি আর দশটাশাশুড়ির মত মেয়ের কান ভারিকরতেন  স্বামী সেবার সঙ্গে সঙ্গেস্বামীকে নিজের মুঠোয় রাখাটাও নাকিস্ত্রীর ধর্ম ! আর এই ধর্মকর্ম বজায়রাখতে গেলে যা হয় আরকি--স্বামীরপ্রতি চাপ পড়ে যায়--যাকে বলে প্রেশার!
সেদিন উদ্ধব বাবু রমাকান্তর বাড়িরদরজা খটখটালেন, স্ত্রীর কথায় ভয়নির্লিপ্ত হয়ে দরজা খুললেন  রমাকান্ত,এত রাতে উদ্ধব বাবু !
পরিচিত হাসির দাঁতগুলি আজ বের হলনা তাঁর--সোজা তিনি বৈঠকখানা ঘরেগিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন।উদ্ধব বাবুর ওপর দিয়ে ঝড় ঝঞ্ঝা ধরনের কিছু বয়ে গেছে বলে মনে হলমাথার চুলগুলি এলোঝেলো, চোখ দুটিঈষৎ লালচে !  রমাকান্ত অধীর আগ্রহনিয়ে বলে উঠলেন, কি হল উদ্ধব বাবু--কোন বিপদ ?
বেজার মুখ নিয়ে তিনি বলে উঠলেন,বিপদ আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে--সংসার দেখছি আমায় ছাড়তেই হবে ! 
রমাকান্তর স্ত্রী শৈলবালা ততক্ষণেবিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন,অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কি হল উদ্ধব দা ?
--কি আর হবে--এক আপনাদের এখানেএসেই আমি একটু শান্তি পাই ! ঘরে যে ক্যাচাল--
--আবার কিছু নিয়ে লাগলেন নাকি ?শৈলবালা বলে উঠলেন। 
--আমি কেন লাগতে যাব ? বলুন তোআপনারা তো আমায় চেনেন--
--আর চেনা--আপনাদের পুরুষ জাতটাতো--বাকি কথা বলার আগেরমাকান্তের মুখের দিকে চোখ পড়ে গেল শৈল বালার। তাঁর মুখ মণ্ডলেরছাপে হঠাৎ ধীর স্থির মহাপুরুষেরগম্ভীরতা দেখে শৈলবালা থেমে গেলেন।
এই তো নিজের ঘরে কিছু সময় আগেইএক চোট হয়ে গিয়েছে, তার রেশ চটকরে যায় ! স্ত্রী শৈলবালা ভালো যখনভালো, আবার কোন কারণে বিগড়েগেল তো তার মত খারাপ আরদ্বিতীয়টি খুঁজে পান না রমাকান্ত। আরশুধু শৈলবালা কেন প্রায় ঘরেরবালারাই এমনি ধরণের হবে! না হলেএত রাতে উদ্ধব বাবু তাঁদের ঘরে এসেউপস্থিত হন ? রমাকান্ত শৈলবালাকেথামালেন, তা না হলে যে নিজের ঘরেইআবার ছুঁচোর কীর্তন  শুরু হয়ে যাবে !
--না, বউদি আপনি ঘটনাটা শুনুনউদ্ধব বাবুর কাতর কণ্ঠ শোনা গেল।
--ঠিক আছে, এখন শান্ত হয়ে বসুন,তারপর সব শোনা যাবে,   রমাকান্তবর্তমান পরিবেশে শান্তি আনার চেষ্টাকরলেন
উদ্ধব বাবু যেন ককিয়ে উঠলেন, আরশান্ত--আমার মা, বাপকে নিয়ে পড়েছে--আমার সব সহ্য হয় কিন্তু মরা মা,বাপনিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বললে বড় কষ্টহয়--
--শুরু কি নিয়ে হল ? শৈলবালা আবারমুখ খুললেন
--ওই এক কথাআপনারা তো জানেনসরলা আমার ছাত্রী, ওকে নিয়ে সন্দেহকরার কি আছে ? সব সময় বলবে,তোমার সরলা,  তোমার সরলা, কথাটাকার না  গায়ে লাগবে ?
একটু খোলসা করে নেওয়া যাকসরলাক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী, উদ্ধব সে স্কুলেরটিচার। মাঝে মাঝে দু একজন ছাত্রছাত্রী উদ্ধবের কাছে পড়া বুঝতে এসেপড়ে। তবে হবে সরলার আনাগোনাএকটু বেশী।  
--ওই মেয়েটা আপনাদের ঘরে নাআসলেই পারে--শৈলবালার জেরা। 
--কি বলব বৌদি, শুধু সরলা কেন--ঘরের ঝিটাকে নিয়েও--আমি নাকিওকে বেশী লায় দিয়ে ফেলি--উদ্ধব তাঁরনিজের বয়ান দিয়ে যাচ্ছিল।  
শৈলবালার নিজের ঘরের কোন্দলেররেশ তখনও মনে হয় রয়ে গেছে, আধোঝাঁজের সুর নিয়ে বলে তিনি বলেউঠলেন, একটা কথা বলবো উদ্ধব বাবু--আপনাদের পুরুষদের এটাই তো বড়দোষ--
রমাকান্ত বিব্রত হয়ে বলে উঠলেন,এখন এসব কথা থাক না, শৈলবালা !
শৈলবালা থামলেন নাবরং রমাকান্তরদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোমারএত লাগছে কেন গোউচিত কথাবললে গায়ে ফোস্কা পড়ে বুঝি?
এমনি কাটা কাটা কথা বলাভদ্রমহিলাদের বোধ হয় একটা অভ্যাস।অন্তত রমাকান্তর এই মুহূর্তে এমনটাইমনে হল। তবে মাঝখানে তিনি আর ফোঁড়ন কেটে তিক্ততা বাড়াতে চাইলেন না।
উদ্ধব বাবু মাথা নিচু করে অপরাধীরমত বসে আছেন। রমাকান্তর খুবখারাপ লাগছিল। বেচারা একটুপক্ষপাত পাবেন বলে এখানে এসেছিলেন--ভেবে ছিলেন, হয় তো আপনথেকে পর ভালো, এখন হয় তোভাবছেন, এর চে জঙ্গলই বোধ হয় ভালছিল !
আরও কিছু মুখ ফসকাবে ভেবেশৈলবালা বোধ হয় হঠাৎ স্তব্ধতা নিয়েচলে গেলেন। তাঁর চোখের সামনে হয় তো রমাকান্তর মতই আর একটি পুরুষমানুষের ছবি মূর্তিমান হয়ে উঠছিল !
উদ্ধব বাবু এখন মাথা নিচু করে বসেআছেন। রমাকান্ত তাঁর পাশটায় গিয়েবসলেন, আস্তে করে নিজের হাতটাউদ্ধবের পিঠে রাখলেন, সহানুভূতিরস্পর্শ পেয়ে উদ্ধব বাবু মুখ তুললেন,ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, জানেন,আমার কেউ সাপোর্টর নেই--আমি তোঘরে একা--আর ওরা স্ত্রী আর শাশুড়িআমায় সব সময় চাপে রাখে !
রমাকান্ত বুঝলেন, হ্যাঁ, এক দিক বেশভারী বটে ! উদ্ধব বাবুর পেরে নাউঠাটাই স্বাভাবিক। 
রমাকান্তর ভাবনাগুলি এগিয়ে চলছিল।এমনিতে স্ত্রী জাতি মাত্রেই সন্দেহবাতিকী, আবার পরক্ষণেই তাঁর মনে হল--আর পুরুষ জাতি ? তার কি কোনদোষ নেই ? রমাকান্ত নিজের মধ্যেঝেঁকে দেখেছেন, হ্যাঁ আছে বৈ কি--ভাললাগা স্বভাব বোধ হয় তার মজ্জাগত।তাদের ভাল লাগে প্রকৃতি, রং ফুলেরসৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাত তাদের জাতধর্ম। সত্যি কথা বলতে কি মেয়ে ছেলেদেখলে ছুঁক ছুঁক ভাবটা পুরুষ জাতিররক্তে মাখামাখি থাকেহ্যাঁ, তার প্রকাশপুরুষদের স্বভাবের ওপর নির্ভর করেকারও আবার বাইরে দৃশ্য-গম্ভীরগুমোট চেহারা হলেও অন্তরে প্রেমউচ্ছলতা ছলাৎ ছলাৎ চলতেই থাকে !
নারীর প্রকৃতি অনেক আলাদাভগবানও নাকি তার ধরণ বুঝে উঠতে অক্ষম। সৃষ্টির মাঝে  গাঁট বন্ধনের প্যাঁচএমন ভাবে তৈরি যে সেখানে আলাদা কোন গিঁটের প্রয়োজন নেই !
তবে অনেক গভীরে গিয়ে নারী প্রকৃতিনাড়া খায়--বেশ কিছুটা ত্যক্ত বিরক্তিরপরই বোধ হয় এমনটা হয় আর সেবোধোদয় অনেকটা সময় স্থায়ী হয়।মুদ্দা কথা, আমাদের পূর্বপুরুষদেরমাথা মোটা ছিল না--অনেকঅভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে যেতে যেনিয়ম, সংসারধর্মের ধারণা তাঁরা পুঁতেগেছেন তার মূল্যও অপরিসীম। তা নাহলে ঘর ভাঙাই হত পুরুষদের প্রধানকাজ আর নারীদের সর্ব ভোগ্যা হয়েথাকতে হত। অরাজকতার রাজ হত। তাই তো এই ঘর, সংসার, চারদেওয়াল, স্ত্রী জাতির সংরক্ষণ গুণগুলিসমাজ বন্ধনকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে  
সে দিন উদ্ধব বাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। রমাকান্ত আরও একটু সময়তাঁকে বসতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনিরুদ্ধ গলায় বলে উঠেছিলেন, জানেনরমাকান্ত বাবুআমি নিশ্চয় একদিন ঘরছেড়ে পালাব। 
--কোথায় ? সহমর্মী হয়ে রমাকান্তজিজ্ঞেস করেছিলেন।  
--সাধু হয়ে, ঘর ছেড়ে কোনআশ্রমে চলে যাব
তারপর বহু বছর কেটে গেছে। আজওউদ্ধব বাবু সাধু হয়ে ঘর ছাড়তে পারেন নি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন