শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

অমিতাভ দাস


আমার যা আছে সকলি দিতে পারিনি তোমারে , হে নাথ...

  সারারাত বৃষ্টি হল । এখনো হচ্ছে । মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল বৃষ্টির গমকে । অন্ধকার রাত । ঝরে যাচ্ছে শ্রাবণ ধারা । তার নিজস্ব একটা সুর আছে , লয় আছে , ধ্বনি মাধুর্য আছে । প্রায় এক ঘন্টা মতো বৃষ্টি শুনলাম কান পেতে । ভাবলাম বৃষ্টি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব , ছেলেবেলার রাত্রিগুলির মতো । বড়বেলায় আর ঘুম পায় না । কান্না পায় । কান্নাও পায় না , ভিতর ঘরে সব কেমন যেন চুপ হয়ে থাকে । আকুলি- বিকুলি যন্ত্রনা । কে যেন বুকের ভিতর গামছা নিঙরে দিচ্ছে । তবু বৃষ্টি অবিরাম ঝরে যাচ্ছে । বৃষ্টি নিয়ে চিরকালীন বিলাসিতা আমার । নিজের সঙ্গে কথা বলা  ।স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাওয়া । জীবনানন্দ কবেই তো বলে গেছেন " কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে " । এতদিনে বুঝেছি বেদনা জাগায় স্মৃতি । বেদনা জাগায় গতজন্মের ভূত ।

ইদানীং বিকেলগুলো খুব অন্যরকম মনে হয় । নিজের সঙ্গে কাটাই । প্রায় ফাঁকা বাসে জানালার কাছে সিটে বসি । জানালা দিয়ে কত কিছু দেখি । হাওয়া আসে । কিছু ভাবতে চাই । আসলে কিছুই ভাবা হয় না আর । মিনিট ২০ পর নেমে ছাত্র পড়াই । তাদের সঙ্গে কাটাই ।ফেরার সময় শ্মশানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াই । অনেক আগে বছর তিনেক আগে, আমি আর চয়ন খুব আসতাম । শ্মশানের কাছে একটা ছাতিম গাছ ছিল । এখনো আছে হয়ত । সেই গন্ধে ম ম করত পথঘাট , চারপাশ । তখন মূলত আমার বা ওর বাইকে চেপে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতাম । অদ্ভুত কত যে খেয়াল ছিল । গল্প করতাম । অচেনা গুমটি দোকানে বসে চা- বিস্কুট খেতাম । সর্বদাই খুঁজে চলা--- একটা গোটা জীবন কেবল খুঁজে চলা ছাড়া আর কী !! এই যে বৃষ্টি অনর্গল ঝরে যাচ্ছে ঝরে যাচ্ছে আর ঝরে যাচ্ছে--- এও তো এক খোঁজা । এই ঝরে যাওয়াতেই বৃষ্টির আনন্দ । সে তোমার ভিতরের খসখসে মাটি যে ভিজিয়ে দিলো গো । মাটি নরম হল যে -- চাষ করবে না ? " এমন মানব-জমিন র ইল পতিত 
আবাদ করলে ফলত সোনা ।"--- কী গো সোনা ফলাবে না ? কেবল ঘুম ? এত ঘুমুলে হবে । ঘুমুবে তাঁরা যাঁরা কেজো মানুষ । অফিস- আদালতে যায় । স্কুল- কলেজে যায় । চাকরি করতে যায় । তুমি তো কেজো মানুষের জগতে অকেজো একটা লোক । তোমার ঘুমুলে চলবে কেন ? তুমি লেখ--- বৃষ্টি লেখো । শব্দ লেখো । নিজেকেই লেখো । এসব কে যেন বলে , কানে কানে বলে , শুনতে পাই ।

বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ট্রেন চলে গেল । হু হু বিষাদ লাগছে । সবার যেমন শীত লাগে , আমার বিষাদ লাগছে । অথচ কথা ছিল সোনা ফলাবার । কথা ছিল খুব চুপ হয়ে থাকবার । কখন যে ঝুপ করে কান্না নেমে আসবে আমি জানি না । সত্যিই আমি জানি না কেন কান্না ঝুপ করে নেমে টুপ করে খসে পড়ে দু- চোখ থেকে । 

সে কত বছর আগের কথা । এক দুপুরে হালিশহরে গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলাম  । পুজোর ঠিক আগে আগে । আকাশ কালো করে বৃষ্টি --- সে কী তীব্র বৃষ্টি । সবাই উঠে চলে গেল । আমি উঠলাম না । বসে থাকলাম ছাতাটা খুলে মাথায় দিয়ে । লোকে ভাবল পাগল । তাতে বয়েই গেল । বসে না থাকলে আমার যে দেখা হত না আকাশ আর নদী কীভাবে মিশে যায় ! কীভাবে মেঘ নেমে আসে জলে ? কীভাবে বিদ্যুৎ চমকায় জলের শরীরে ? কীভাবে রচিত হয় আকাশ আর নদীর সঙ্গম । দেখলাম চরাচর নীলাভ- কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে । সে এক অপূর্ব রূপ । যে সময়ে ভৈরব জেগে ওঠে , ভৈরবী খুলে রাখে তাঁর আনত কেশভার । জলে জলে ছবি আঁকে এক অদৃশ্য চিত্রকর । কালিদাস আনন্দে যেন উন্মাদ হয়ে ওঠেন । তানসেন কখন যেন বসে যান মল্লার গাইতে -- মেঘে মেঘে তখন বিপুল আলোড়ন । গোবিন্দ দাস , জ্ঞানদাস , চন্ডীদাস , এমনকী রবীন্দ্রনাথ বসে পড়েন কিছু লিখতেই হবে , অথচ লেখা হয় না । কদম্বকাননে ফাঁকা একটা দোলনা অকারণ ঝুলতে থাকে--- ফাঁকা , কেউ নেই । ঝুলতে থাকে । দূরে ভিজতে ভিজতে একটা- দুটো নৌকা আসে । বসে বসে ভিজে যাই আমি । ভিজে যায় চোখ । এক সময় বৃষ্টি থেমে যায় । তবে আজ বৃষ্টি থামার নয় । ঝরে যাচ্ছে অবিরাম । তোমার ভালো না লাগলেও ঝরে যাচ্ছে । গাছেরা আরো সবুজ হয়ে উঠছে । জীবনে এমন সবুজ খুব দরকার । জীবনে খুব বৃষ্টি দরকার ।

যুগ যুগ ধরে যে দোলনাটা ঝুলছে , কেউ এসে বসেনি তাতে । চোখ বন্ধ করো । দেখতে পাবে । ওই দোলনাটার নাম কি জানো ?
---  ওর নাম বিরহ ।।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন