শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়


হঠাৎ দেখা //

এগারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে তখনও বারুইপুর লোকালটা দাঁড়িয়ে আছে, ছুটতে ছুটতে গিয়ে কোনোমতে লেডিস কার্পাটমেন্টে উঠেছি ,দুএকটা বসার জায়গা তখনও ফাঁকা ছিল| এদিক ওদিক খুঁজছি কোথায় বসা যায়, ঠিক তখনই,--” এই  কাঁকন এদিকে এদিকে ;”
গলাটা শুনে ঘুরে তাকাতেই -- “আরে! জয়িতাদি না?” আনন্দের চোটে ভীড় ঠেলে  আমি প্রায় উড়ে উড়ে গিয়ে জয়িতাদির সামনে উপস্থিত|

--  “দূর থেকে দেখেই তোকে আমি ঠিক  চিনেছি,
আয় বস একটু, আমি দাঁড়াচ্ছি |”
--” আরে দূর তুমি বোসো, ,এখনো এতো বুড়ি হয়নি,আর তোমাকে দেখে না সব ক্লান্তি এক মুহূর্তে ভ্যানিস|”
--”কেমন আছিস বল?  সংসার কেমন করছিস?”
--”বলবো কেন ? চলো আমার সাথে নিজেই দেখে
আসবে !”
--”যাবো যাবো মেয়েটা একটু থিতু হোক ?”
--”মানে ! কত বড়ো তোমার মেয়ে, এর মধ্যে বিয়ে দিয়ে থিতু করবে?”
--”দূর বোকা বিয়ে দেব কে বললো?
চাকরিবাকরি আগে পাক! এখন ফাইনালইয়ার চলছে ক্যাম্পাসিং হয়ে গেছে|”
-- “তাই বলো! আমি তো তোমার সাথে মেলাতে পারছিনা! এত ডাকাবুকো দিদিটার মুখে এমন আদ্যিকালের মাসিমা টাইপ ডায়লগ কেন ?” সারা মুখে খুশির আলো ছড়িয়ে কাঁকন আরো বলে --বা! মেয়েটাকে তো বেশ মানুষ করে ফেলেছো?
এখন তো দেবাদেবী স্বাধীন? ও ! ভালো কথা সৌমেনদা কেমন আছে? অনেককাল দেখিনি?”

-- “আপনি বসুন আমি নামবো|”
জয়িতাদির পাশে বসা মহিলা আমাদের গল্পের তোড়ে স্টেশন আসার বেশ আগেই জায়গা ছেড়ে দিলেন| আমিও ব্যাগ গুছিয়ে জয়িতাদির পাশে বসে সেই ফেলে আসা খুব চেনা দিন গুলোর যেন গন্ধ নিলাম| যাদের সাথে ছোট বেলার টক ঝাল আর বিটনুন জড়ানো কত দুষ্টুমি ভরা সময় কাটিয়েছি , এখন হঠাৎ তাদের কাউকে কাছে পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করেনা, মনে হয় ওই আলো মাখা দিনের টুকরো স্মৃতিরা আবার হাত ফস্কে যাবে চলে |
কাঁকন জানেনা তারমতো সবাইকে এমন স্মৃতিমেদুরতা
গ্রাস করে কিনা |

এই মুহূর্তে আমি চশমা আঁটা দিদিমনি নোই, কারো বৌ বা মা নোই ! এখন আমি সেই প্রানোচ্ছল অকালপক্ক মেয়েটি,যে দিদিদের পেছন পিছন ঘুরে বেড়াতো | তেঁতুলমাখা জড়ানো লেবু পাতার মতো তাদের অজান্তেই অনেক গোপন কথা শুনে নিজের মনের লুকোনো ঝুলি ভরিয়ে তুলতো|

অভিদার সাথে জয়িতাদির প্রেম,তারপর অজানা কারণে অভিদার সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া| জয়িতাদির সেই ঠোঁটকাটা স্মার্ট ইমেজ, জীবনানন্দ প্রেম, ইংরিজি নিয়ে যাদবপুরে পড়তে আসা, কাউকে রেয়াত না করা তখনকার মফস্বলের আধুনিক মেয়ে, যাকে মনে মনে গুরু মানতাম|

এই মধ্যবয়সী মহিলার মুখে আমি আতিপাতি করে খুঁজে চলি সেই হারিয়ে যাওয়া বাইশ বছরের জয়িতাদি কে| আমার অবাক করা চাহুনি  লক্ষ্য করে জয়িতাদি বলে ওঠে, -----”কিরে ভ্যাবলার মতো কি দেখছিস?”
--”আমি হেসে বলি কিছু না”…..
-- সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করি,’ জেঠু  জেঠিমা কেমন আছে গো?”

--”বাবা আজ দুবছর হলো নেই ; আর মাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি| মায়ের সাথে তার প্যায়ারের ছেলের মনোমালিন্য | আমিই জোর করে ,আমার কাছে এনেছি|
বলে দিয়েছি,  “তুমি আমারও মা ; আমি চাই যে কটা দিন আছো বিন্দাস থাকো| কি ছেলে-বৌ, টাকা-পয়সা,বসত- ভিটে -ফ্ল্যাট,মাছেরপিস,দিদিশাশুড়ির মাথার কাঁটা, নাতনির প্রেম --  এসব ঝুটঝামেলায় যাও? ও সবই মায়া, বোঝোনা! কবে আর বুঝবে?”
তাই বলি আমার কাছে থাকো, আমার এখন তোমায় খুব প্রয়োজন| আমায় আগের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে,আমতেল দিয়ে মুড়ি মেখে দেবে, বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হলে বকুনি দেবে| ছেলেকে তো এতো দিন অনেক কিছু  দিলে আমাকে এইটুকু দেবে না! চলোনা মা আমার কাছে?”

তখন দেখি চোখ মুছে রাজি হলো| আমিও এনথ্রু দিয়ে বললাম--”সকাল সন্ধ্যে পুজোপাঠ করো, সিরিয়াল দেখো, নাতনির সাথে খুনসুটি করে বিন্দাস থাকো|
আমি কিছু বললে তবু সহ্য হবে, বৌ বললে ইগোতে লাগবে| নিজের পয়সায় থাকবে খাবে অতো চাপ নিওনা, মন খুলে বাঁচো| বাবা এতোদিনে গার্ল ফ্রেন্ড পেয়ে গেছে, আর তুমি শুধুশুধু চিন্তা করে হেদিয়ে মরছ|”
তা বুঝলি আমারিতো মা,তারপর আর আপত্তি করেনি |
--”আর সৌমেন দা ?”
--”সে এখন আমার জীবনের একটা ক্লোজ চ্যাপ্টার|”
--”মানে?”
--”মানে আবার কী?”
--”যা সত্যি তাই বললাম |”
--”অবাক হচ্ছিস! শোন তাহলে সৌমেন বাবার পছন্দ করা পাত্র| আমিও আপত্তি করিনি | আমার কোনো কিছুতেই না করেনা| আমি চাকরি করি, তাতে না নেই | কোনো কোনো দিন আসতে দেরি হলেও রাগ নেই | একেবারে আদর্শ স্বামী বলতে যা বোঝায় আরকি | ওদিকে মিনু, পরিপাটি করে সংসারের খুঁটিনাটি সব গুছিয়ে রাখে | ওকে তো নবছর থেকে মানুষ করেছি, মেয়ের থেকে বছর খানেকের বড়ো | আমার আর সৌমেনের মেয়ে হয়েই থাকে | অনেক চেষ্টা করেছি পড়াশোনা করাবার, মোটে মন নেই কিন্তু ঘরের কাজে খুব চটপটে, খুব গোছানো|

সকালে রান্না কিছু করলেও অফিস থেকে ফিরে কোনো কাজ আমার জন্য থাকতো না, সব সুন্দর  করে সেরে রাখতো মিনু| এমনকি বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সরবত টাও রেডি|”

আমাকে দেখে অফিসের লোক হিংসে করতো | আমি অফিসের কোনো কাজে না করিনা | সে যতই দায়িত্বপূর্ণ কাজ হোক| তার ওপর অফিসের বিভিন্ন ওয়ার্কশপ   অ্যাটেন করা, বা নতুন কোনো প্রজেক্টে লিড করা এ সব কিছু নিয়ে খুব ভালো ছিলাম রে| মেয়েটাও পড়াশোনায় মন্দ নয় | জীবনে কোনো চাপ নেই, এক কথায় সুখের পানসিতে ভেসে চলা যাকে বলে |
একদিন অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছি, আমার মেয়েও এসে বসলো পাশে| খুব ডিপ্রেসড, তারপর দেখি ঝর ঝর করে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে | আমি ওকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোর ? হঠাৎ কাঁদছিস কেন? তখন কান্না থামিয়ে বলে কি --”মিনুর গালে বাবার ঠোঁট”…...
আমরা দুজন সেই মুহূর্তে কি ভীষণ একলা হয়ে গেলাম কি বলবো! কাউকে বিশ্বাস করা কি অন্যায়?

সে রাতে কিছু বলিনি--” সকাল হতেই মিনুকে বিদায় দিলাম| বললাম --  “এক মুহূর্ত তোমাকে এ বাড়িতে দেখতে চাইনা|” ও কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করলোনা জানিস!
মিনু চলে যেতে সৌমেনকেও বললাম-- “বাড়ি আমার নামে, আমার লোনেই এই বাড়ি| তোমার ফিক্সড ডিপোজিট, লাইফ ইন্স্যুরেন্সর সব পেপারস এই ব্যাগটার মধ্যে আছে | আর প্রয়োজনীয় জিনিস যা  যা আছে তা নিয়ে কেটে পড়ো | তোমার মুখ আর আমি দেখতে চাইনা | আমার মাথায় আগুন চড়ে যাচ্ছে |এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে | তা নইলে মেয়েকে নিয়ে আমিই চলে যাবো ? কোনটা চাও বলো ?”

“এই দুবছর আমরা খুব মনের সাথে লড়াই করেছি রে,
যার বাবা অন্ত প্রাণ, সেই মেয়ের বাবার প্রতি কি তীব্র ঘৃণা, তুই ভাবতে পারবিনা কাঁকন !
সৌমেন আমাকে এইভাবে না ঠকিয়ে , যদি বলতো আমি তোমার সাথে থাকতে পারছিনা বা আমি আলাদা থাকবো | তাতে কষ্ট পেলেও বিশ্বাসের জায়গাটা এইভাবে চুরমার হতো না | আমার মান বাঁচতো, সবার কাছে আমার আর মেয়ের মাথা এভাবে হেঁট হতোনা | ভাবতে পারিস দীর্ঘ দিন ধরে আমার চোখের আড়ালে  এমন কুকর্ম করে গেছে, মেনে নেওয়া যায় তুই বল ?”….



---”এখন আমি অনেক ভালো আছিরে?”

--- “সৌমেন দা আর আসেনি?”

--”একমাস আগে এসেছিল | বললো মাফ করা যায় না!”

আমাকে তো জানিস আমি ছেড়ে কথা কইনা, আমি বলেছি --“তুমি যে অন্যায় করেছো তার মাফ হয়না| আর কাকে মাফ করবো তোমার মতো রেপিস্টকে?
মিনুরতো সব দোষ নয় ,  তুমি ওকে লোভ দেখিয়েছো? মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরী করেছে? তুমি জানোনা তোমার এই কুকর্মের ফলে মেয়েকে কাউন্সিলিং করাতে হয়েছিল | মানসিক চাপে পড়াশোনার কতটা ক্ষতি হয়, তোমার মতো বাপের পক্ষ্যে বোঝা সম্ভব নয় |  আমাদের জীবনে তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের আর কোনো স্থান নেই|”
আমার রুদ্র মূর্তি দেখে চলে গেছে |

--”আর মিনু ?”

--”ওর খবরও ঠিক বলতে পারবোনা|”

--”অফিসের একজন বলছিলো, ওরা সুভাষগ্রামে না কোথায় ঘর ভাড়া করে থাকে?দেখ, মিনু আবার হয়তো নতুন সঙ্গী জুটিয়েছে! তাই আবার সৌমেন ফিরতে চাইছে;


আমি এখন অনেক ভালো আছিরে| সেই মুহূর্তে আমরা এতটাই অপমানিত আর বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম কি বলবো| সারারাত ধরে অনেক ভাবনাচিন্তা করে, একুশ বছরের নিশ্চিন্ত জীবনকে এক লহমায় ছুঁড়ে ফেলে দিই| জানি একে আপোষ করা মানে অনেক বড়ো অন্যায়কে সাপোর্ট করা |



সে মুহূর্তে জয়িতাদির মধ্যেবয়সের ওই ক্লান্ত চোখে যেন খুঁজে পেলাম আপোষ না করা তারুণ্যের এক দুর্বার জেদ, যেটা চিনিয়ে দিলো বিশ্বাসভঙ্গের  অপরাধীকে কখনোই ক্ষমা করার মেয়ে জয়িতা নয়|


হঠাৎ দেখি ট্রেন বারুইপুরের ঢুকছে| কোথা থেকে যেন কেটে গেল সময়টা| মনে মনে বলি জয়িতাদি সবাই তোমার মতো পারেনাগো ……


নামতে যাচ্ছি জয়িতাদি বলে উঠলো-- ”তোর কথা শোনা হলোনা, আমি কেবল আমার কথা বলে গেলাম|”

--”আমি হেসে বলি--”ভালো আছি, পরে আবার কোনোদিন হঠাৎ দেখা হলে তখন না হয় শুনো|
আজ আসি, ভালো থেকো “ ….


অর্ঘ্যকে এখন প্রায়ই অফিস ট্যুরে যেতে হয় সঙ্গে ওর সেক্রেটারি সোমালি | অনেক কথাই হাওয়ায় ভাসে --
বিনি সুতোয় গাঁথা অর্ঘ্য আর তার আটপৌড়ে সম্পর্কটার পরতে পরতে এখন অনেক গিঁট |  ছিঁড়বে! সে শক্তি কোই ?

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসেনা কাঁকনের..…..



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন