সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

অন্বেষা রায়

কফি ও গৃহপ্রবেশ
-------------------------

-----------------

(১)

আজ বিকেলে বাড়িতে একটা ছোট্ট কফির আসর বসবে।আমন্ত্রিত দুজন। মৈনাক, সঙ্গে মন্দাক্রান্তা। মৈনাক আমার স্বামী আর মন্দাক্রান্তা ওর প্রেমিকা। আচ্ছা আপনি শর্মিলা ঠাকুর,সঞ্জীব কুমার আর সারিকার 'গৃহপ্রবেশ' ছবিটা দেখেছেন? বাসু ভট্টাচার্যের পরিচালনা?  না দেখে থাকলে দেখে নেবেন। ভাল ছবি। 

ছবিতে স্বামী এক সহকর্মীর প্রেমে পড়েছেন এবং স্ত্রীর কাছে বিবাহবিচ্ছেদ চাইছেন।স্ত্রী সাধারণ ঘরোয়া গৃহবধূ। ভাড়া বাড়িতে থাকেন এবং  পয়সা জমান নিজের একটা বাড়ি বানাবেন বলে। স্বামীর প্রস্তাবের প্রাথমিক ধাক্কাটুকু সামলে স্ত্রী সম্মত হলেন কিন্তু সঙ্গে জুড়ে দিলেন একটি শর্ত। স্বামীর প্রেমিকার সাথে আলাপ করাতে হবে। যেদিন মেয়েটি আসবে সেদিন স্ত্রী তার সঞ্চয় ভেঙে বাড়ি এবং নিজেকে ঢেলে সাজালেন। বিকেলে প্রেমিকা সমেত স্বামী ঘরে ঢুকে তো হতবাক।নিজের ঘর,সংসারকে বাঁচানোর জন্য মেয়েটির এই আকূল প্রচেষ্টা স্বামীর ভেতরে এক প্রবল ধাক্কা দিল। ছবির শেষে দেখা গেল স্বামীটি তার প্রেমিকাকে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য এগিয়ে দিতে গিয়ে এক চরম মানসিক দোলাচলে পড়েছেন এবং শেষমেশ নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে আসছেন।
আমার আর মৈনাকের গল্পটাও খানিকটা এই ধাঁচের। কিছু সামান্য এবং কয়েকটা প্রধান পার্থক্য থাকলেও মোটের ওপর আজকের কফির আসর বাসু ভট্টাচার্যের 'গৃহপ্রবেশ' ছবির সেই ক্লাইম্যাক্সের মতোই বলতে পারেন। এখন ছটা বাজে, আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মন্দাক্রান্তাকে নিয়ে  মৈনাক উপস্থিত হবে,তার আগে আপনাকে আমার এবং মৈনাকের সম্পর্কে কিছু বলে নিই।

মৈনাক আর আমার ভালোবেসে বিয়ে। ভালোবাসাটা প্রাথমিকভাবে ( যদিও এখন মনে হচ্ছে পাকাপাকিভাবেই) একতরফা ছিল। আমিই কলেজে পড়াকালীন মৈনাকের প্রেমে পড়েছিলাম।শুধু আমি নই আমার তুলনায় ঢের ঢের গুণ বেশি আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমতী বেশ কয়েকজন মেয়েও মৈনাককে প্রেমিক হিসেবে চেয়েছিল। কিন্তু শিকে ছিঁড়ে ছিল আমার ভাগ্যে। কলেজের শেষ বছর, বুকে প্রচুর সাহস নিয়ে মৈনাককে বলেছিলাম মনের কথা। মৈনাক হ্যাঁও বলেনি আবার না বলে কাটিয়েও দেয়নি।ঝুলিয়ে রেখেছিল।আসলে খেলাচ্ছিল। এইসময়টা আমি ওকে পাওয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলাম। ওর হয়ে নোটস কপি করা, টিফিন নিয়ে যাওয়া, গরমকালে জলের বোতল যোগান দেওয়া।আসলে কি জানেন আমি মেয়েটা না ভেতরে ভেতরে বরাবরই একটু সতীলক্ষ্মী টাইপের।আমার প্রিয়বন্ধু তানিয়ার ভাষায় 'বউ বউ মতন'। 
তা আমার এতো সেবা বিফলে গেলনা।মাসখানেকের মধ্যে মৈনাক হ্যাঁ বললো। আমি আনন্দে ভেসে গেলাম। এরপর পাঁচ বছরের মাথায় আমাদের বিয়ে হয়। এই পাঁচ বছরে মৈনাকের চাকরি পাওয়া, আমার শখের কম্পিউটার কোর্স হওয়া আর বিস্তর সম্বন্ধ নাকচ করা হল। এমনকি প্যানপ্যানে হিন্দি রোম্যান্টিক ছবির মতন আমার আর মৈনাকের মাঝে মিথিলা কয়েকমাসের জন্য ঢুকে আবার বেরিয়ে গেল। 
মিথিলার সাথে মৈনাক যখন লুকিয়ে সিনেমা দেখছে, বেপাড়ায় রোল খাচ্ছে বা ট্যাক্সিতে ওর শ্যামলা হাতের পাতায় আদর রাখছে তখন আমি বাড়িতে বসে কেবল টিভিতে বাসু ভট্টাচার্যের 'গৃহপ্রবেশ' দেখছি। শর্মিলা ঠাকুরের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কষ্ট পাচ্ছি, লড়াই করছি, সঞ্জীব কপুররূপী মৈনাককে ভালোবাসছি আর সিনেমার শেষে তৃতীয়জনের বিরুদ্ধে জিতে যাচ্ছি।

খবরটা দিয়েছিল তানিয়া। ভাগ্যিস সেসময় বাড়িতে কেউ ছিল না। তাহলে মৈনাক আর আমার বিয়েটা সম্ভব হত কিনা জানিনা।ঘরে ঢুকে বিছানায় ব্যাগটা ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠেছিল তানিয়া।
" মৈনাক তোকে ঠকাচ্ছে সে খবর রাখিস?" 
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাঁপা কাঁপা হাঁটুতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। তানিয়া উত্তেজনায় গলা চড়াচ্ছিল।
"বাসের জানলা থেকে আমি পরিষ্কার দেখেছি পৃথা। মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে সেঁটে বসেছিল মৈনাক। তুই এক্ষুনি  ফোন কর ওকে।" 
তানিয়ার কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম। তানিয়া এরকমই। ও না থাকলে আমি বোধহয় পড়াশোনা ছেড়েই মৈনাকের সেবা করে যেতাম।তানিয়া আমাকে টেনে রাখে। 
 মৈনাককে সাত আটবার ফোন করেও ধরতে পারিনি। পরেরদিন বিকেলে দেখা করে পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করে ও।তানিয়া নাকি ভুল দেখেছিল। আমারও কেন জানিনা মৈনাকের কথাই সত্যি বলে মনে হয়েছিল।দাঁত কিড়মিড় করতে করতে  শাসিয়ে ছিল তানিয়া( মৈনাকের ওকালতি করতে যাওয়া আমাকে)। 
"পরেরবার ছবি তুলে রাখবো।"

তানিয়া ছবি তুলবে বলে, নাকি আমার কান্নার জেরে জানিনা মৈনাক আমাকে পরের বছর ভাল ছেলেটির মতন বিয়ে করে ফেললো।স্মার্ট ছেলে, চাকরির ক্ষেত্রে উন্নতিও করছিল।আমি বাড়িতে একটা টিউটোরিয়াল খুলে বসলাম। ফোর থেকে এইট সায়েন্স গ্রুপ।ভালই চলছিল।

 বিয়ের পরের বছরই আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হল। তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয় কন্যা। তানিয়া চাকরি নিয়ে ভিন শহরে চলে যাওয়াতে আমার রাশ যেন আরো আলগা হয়ে গেল।আমি একেবারে পঞ্চাশের দশকের নায়িকাদের মতন পতিপ্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। এরই মধ্যে কসবায় দারুণ একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করে ফেললো মৈনাক। দামটা একটু বেশি। লোন পেতে পারে তবে অতটা লোন নিলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে। অগত্যা........আমার বাবার থেকে কিছু টাকা ধার আর সঙ্গে আমার সমস্ত গয়না। ফ্ল্যাটে ঢোকার মাস দেড়েকের মধ্যে মন্দাক্রান্তার ব্যাপারটা  জানতে পারলাম।মৈনাকের ফোন মেসেজ থেকে।


(২)

বাসু ভট্টাচার্যের 'গৃহপ্রবেশ' আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। দ্বিতীয় নারীর থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনছেন স্ত্রী।ভালোবাসার জোরে। তবে আমার গল্পটা সিনেমার প্লটের থেকে বেশ আলাদা। আমার স্বামী শুধু পরনারীর প্রেমে পড়েই ক্ষান্ত দেননি, তাকে নিয়ে বার দুয়েক মন্দারমণিও ঘুরে এসেছে। আমার স্বামী সিনেমার মতন নিজে থেকে কিছু বলেননি। আমি ধরতে পেরে প্রচন্ড কান্নাকাটি করায় নিজের কর্মকান্ড স্বীকার করেছেন মাত্র। পরিষ্কার জানিয়েছেন মন্দাক্রান্তাকে তিনি বিয়ে করতে চান অতএব আমি যেন এক দেড় মাসের জন্য নিজের ব্যবস্থা নিজে করি। আর তৃতীয় তফাৎ সিনেমার স্বামীটির মতন মৈনাকের এটা প্রথম পরকিয়া নয়। তানিয়া না থাকলেও দু চারজন বন্ধু আমাকে এষা আর পিয়ালীর কথা জানিয়েছে। যারা একমাত্র মৈনাকের ভাষাতেই 'শুধু ভাল বন্ধু'।

যাইহোক,  মন্দাক্রান্তার কথা জানামাত্র বাসু   ভট্টাচার্যের 'গৃহপ্রবেশ'  আবার মাথায় হানা দিল। আমি গোটা একটা দিন না খেয়ে কাটালাম এবং দিনের শেষে খেয়াল করলাম, আমার দুটি শিশু সন্তান আমার শোক পালনের জেরে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মৈনাক সেইরাতে বাড়ি ফেরেনি। আমার নতুন ফ্ল্যাট, আমার সমস্ত গয়না দিয়ে কেনা শখের বাড়ি,গোছানো সংসার সব ছত্রখান হয়ে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে 'গৃহপ্রবেশ' এর কথা ভাবছিলাম। স্ত্রীর ভালোবাসায় স্বামীর প্রত্যাবর্তন। 
 শেষমেশ এক সন্ধ্যায় মন্দাক্রান্তাকে নেমন্তন্ন করেই ফেললাম। আজ সেই সন্ধ্যা।

সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুর সারাদিন ধরে নিজেকে এবং বাড়িটিকে সাজিয়েছিলেন। আমিও ঘরগুলো গুছিয়ে ফেললাম। ভাল করে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম প্রস্তুত হব বলে।মেয়েদের আগেভাগেই এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যে সাতটা বেজে পাঁচ এ মন্দাক্রান্তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মৈনাক।আমাকে দেখে চমকে উঠলেও কিছু বললো না। গায়ের রঙ ফর্সা হলেই যে কেউ সুন্দরী হয়না আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আমাকে দেখলে প্রথমেই 'ময়দার তাল ' মনে হবে। তারমধ্যে শাঁখা পলা, সিঁদুর শাড়ি আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে আরো ভ্যাদভ্যাদে ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আজ সবকিছু আলাদা।
মন্দাক্রান্তাকে আপ্যায়ন করে ঘরে বসালাম। ওদের সাথে দরকারি কথাগুলো সেরে ফেলতে হবে
।মৈনাককেও বোঝাতে হবে আমার অবস্থা,আমার মেয়েদের কথা.....
 মৈনাকের চোখ অবাক বিস্ময়ে আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার।আমার এই সাজ ওর অচেনা। 
কাপে কফি, প্লেটে খাবার এগিয়ে দিয়ে আমি বসলাম মুখোমুখি। মন্দাক্রান্তাকে একটু অস্বচ্ছন্দ মনে হল। আমি সময় নষ্ট না করে কথা শুরু করলাম।

" তাহলে কতদিনের মধ্যে যাচ্ছো?"

মৈনাক থমকাল।

"মানে?"

আমি আমারা শাঁখা পলাহীন হাতটা মুখের কাছে নিয়ে ছোট্ট করে কাশলাম।

" দেখো মৈনাক, বাড়িটা তো আমার আর আমার বাবার টাকায় কেনা তাই তোমাকে তো আর এখানে থাকতে দিতে পারছিনা। তুমি মন্দাক্রান্তার কাছে কবে যাচ্ছো? "

 মন্দাক্রান্তা প্রচন্ড বিস্ময়ে মৈনাকের দিকে তাকালো।
  
আমি ততক্ষণে আত্মবিশ্বাসী। গলা আরেকটু শীতল করে বললাম,

"সোফার পাশে দুটো বড় ব্যাগ আছে। গুছিয়ে ফেলো। মেয়েরা আসার আগে বেরিয়ে যাও কেমন।  তোমায় ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছি এটাও যেমন ওদের দেখা উচিৎ নয় তেমনি তুমি আমার ঘাড়ে পা দিয়ে নিজে টুকু  নিঙড়ে নেবে সেটাও কি ওদের শেখা উচিত? "

মৈনাক বাক হারা। দু একবার উত্তেজিত হয়ে 
"তুমি এরকম করতে পারোনা"র বেশি কিছু বলতে পারেনি। আর মন্দাক্রান্তা?  মৈনাককে অগ্নি দৃষ্টিতে জ্বালিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেছে।

এই কফি আসরের পরের পরের দিন মৈনাক বাড়ি থেকে চলে যায়। খুব সম্ভবত কোনো মেসে। ডিভোর্সের কেস ফাইল হবে দু এক দিনেই।আমার টিউটোরিয়াল রমরমিয়ে চলছে।
  আজ বাড়িতে নারায়ণ পুজো। আমার ছাত্রছাত্রী আর দু চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসবে। আজ আমার বাড়িতে আমার ' গৃহপ্রবেশ।'

-----------------------
  
      
  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন