শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

ভজন দত্ত


প্রসঙ্গ টেরাকোটা     
চতুর্থ পর্ব
------------------
.
টেরাকোটা শিল্পে বাঁকুড়া জেলার ঐশ্বর্য, গর্ব করার মতো।দেখলাম যে,শুধু মন্দির অলঙ্করণেই নয় বাস্তব জীবনের নানান লৌকিক ধর্মীয় উপকরণ হিসাবে টেরাকোটা এখনো ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
১৯৬৯ এর ২৪ জানুয়ারি,রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন পাঁচমুড়ার শিল্পী রাসবিহারী কুম্ভকার মহাশয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন National Awards for Master Craftsman এর পুরস্কার। বাঁকুড়ার ঘোড়া বলে বিশ্বব্যাপী যা পরিচিত তা নির্মিত হয় পাঁচমুড়া গ্রামে
রবীন্দ্রনাথ সামন্ত লিখেছেন,এই ঘোড়া ---            " হেনরি মুরের ঘোড়া নয়, সুনীল দাসের ঘোড়ার ছবির একটির মতোও নয়, ঘোড়া মন্দির টেরাকোটায় অলংকৃত হয়ে যে দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে তাও নয় বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া।কোলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ঘোড়াটির মতো তো নয়ই।বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া নিজস্ব শৈলীতে একক অনবদ্য।অবাস্তব গড়ন কিন্তু অনস্বীকার্য ভঙ্গি।প্রতীকী,তাই এমন। " বিশ্বে আর কোথাও এমন ঘোড়ার দেখা মেলে না। কারনেই বাঁকুড়ার বিভিন্ন স্থানে যেমন, রাজগ্রাম,মুরলু,সোনামুখি, কেয়াবতী,স্যান্দরা, রাণীবাঁধ,বিবড়দা প্রভৃতি স্থানে কুমোরেরা নানারকম স্টাইলের ঘোড়া তৈরি করলেও "বাঁকুড়ার ঘোড়া" বলতে যে ঘোড়াটির ছবি মনের আয়নায় ধরা পড়ে সেটি হোলো পাঁচমুড়ার ঘোড়া।যত বড় বলবেন তত বড়ই ওরা তৈরি করে দেবেন। পোর্টেবল। ভেতরটি ফাঁপা,ফলে ভার কম।কাজেই ঘোড়াটি সহজেই 'উড়ে বেড়াতে' পারে।  কান,
মাথা,ধড়, লেজ আলাদা আলাদা প্যাকিং করে নিয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্যই ঘোড়া
সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়েছে অনায়সে।
বৈশিষ্ট্যে অনন্য হওয়ার জন্যই এই ঘোড়া বাংলার হস্তশিল্পের প্রতীক। 
.
   উঁচু, লম্বা গলা এই পাঁচমুড়ার ঘোড়ার বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য। কেন লম্বা হোলো এখনকার তৈরি ঘোড়ার গলা? এখানে কি কখনো জিরাফেরা ঘুরে বেড়াত! এমন গলার সঙ্গে তো জিরাফেরই মিল। কিন্তু তার প্রমাণ অনুসন্ধান করেও পাইনি। (যদি কেউ পেয়ে থাকেন দয়া করে জানাবেন।) তবে! খোঁজ করছিলাম নানান জনের কাছে। কেউই সদুত্তর  দেননি। উল্টে হাসিঠাট্টাও  হজম করতে হয়েছে। যাঁদের কাছে উত্তর পাওয়া যেতে পারে তাঁদের প্রায় সকলকেই এই প্রশ্ন করেছি।গত বছর (১৪২৩) লক্ষীপুজোর সময় বিখ্যাত কবি 'কবিতা পাক্ষিক' এর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় প্রভাত চৌধুরী এসেছেন তাঁর গ্রামের বাড়ি বাঁকুড়ার কাদাকুলিতে ( ছান্দারের কাছেই) দাদার ডাক পেলেই, আসার খবর পেলেই, যাই তাঁর কাছে। বাড়তি পাওনা ছিল ছান্দারে গিয়ে উৎপল চক্রবর্তীর (১৩৪৫-১৪২৪) সান্নিধ্য লাভ করা। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর ফাঁক বুঝে আমি প্রভাতদার কাছেও রাখি প্রশ্নটি। প্রভাত বললেন, আমি কিছু জানিনা।আমি হতাশ। আমার মুখ দেখে বোধহয় প্রভাতদার খানিক মায়া হোলো কি না কে জানেতবে , --- বলে প্রভাতদা খানিক থামলেন। আমি বলি, কি, কি তবেপ্রভাতদা তাঁর অতুলনীয় বৈঠকি মেজাজে শুরু করলেন, একটা গল্প শোনো। গল্পটা অবশ্য আমার না। ( খানিক থেমেগল্পটা আমি শুনেছিলাম, মাণিকদার কাছে। মাণিকলাল সিংহ। আমারও তোমার মতোই প্রশ্ন ছিল, ঘোড়ার ঘাড় কেন ওরকম হোলো! তিনি আমাকে যেটা বলেছিলেন সেইটা বলছি শোনো মন দিয়ে।
বাঁকুড়ার মানুষ তো গরীব। অভাব তাদের নিত্যদিন। রোগজ্বালা এসবও ছিল। তখন মানুষ তা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন দেবদেবীর " থানে " মানত করত। তো, এমনি এক গরীব ঠাকুমা মানত করেছেন, কোনো এক লৌকিক দেব বা দেবীর থানে। জোড়া ঘোড়ার মানত।ঠাকুমার সম্বল তো একটি কানা বা ফুটো কড়ি। সেটা নিয়েই তিনি কুমোর বাড়ি গেলেন।কুমোরকে বেশ তোষামোদ- খোষামোদ করে,বাবা- বাছা করে,রাজি করান ঘোড়া তৈরি করে দিতে। ঠাকুমা বাড়ি ফিরে আসেন খুশিখুশি। মানত পূর্ণ হবে তাঁর।
ঠাকুমা রোজ কুমোর বাড়ি গিয়ে ধর্ণা দেন।কুমোরের তৈরি মাটির নানান জিনিষ,হাতি,ঘোড়া সব দেখেন। বসে থাকেন। কুমোরের হাতের জাদু দেখেন।একতাল নরম মাটি নিয়ে গল্প করতে করতে কুমোরের সৃষ্টি দেখেন অবাক হয়ে। আর কুমোরকে কাতর আর্জি জানান,দেখবি বাপধন , থানে  আমার ঘোড়া জোড়াটাই যেন সবার থেকে বড় হয়। রোজ একই কথা বলেন ঠাকুমা। দেখবি বাপ আমার ঘোড়াটা যেন সবার থেকে উঁচু হয়।কুমোরতো জানেন, ঠাকুমার পয়সা নেই অথচ বড় ঘোড়ার শখ। রোজ রোজ ঠাকুমার একই বায়ণা। বায়ণাক্কার ঠেলায় অস্থির কুমোর একদিন ঠাকুমার উপস্থিতিতেই একই পরিমাণ মাটিতে আঙুলের টিপসিতে দিলেন ঘোড়ার ঘাড়টি লম্বা করে।ব্যাস,ঠাকুমা খুশি। তার মানতের ঘোড়া হলো সবার থেকে বড়। সেটা সকলের পছন্দও হলো খুব। সবাই চাইল ঐরকম ঘোড়া।ব্যাস হয়ে গেল ঘোড়ার ঘাড় লম্বা।
গল্পটা শুনে প্রথমে খুব হাসলাম।পরে পরে ভাবলাম, তাই তো, এরকমও হতে পারে। যুক্তি আছে একটা।
তবে কি, ঠাকুমার দাবিতেই একদিন এভাবেই তৈরি হয়ে গেল বিশ্ববিজয়ী বাঁকুড়ার ঘোড়া?
     কাদাকুলি থেকে বেরিয়ে সদ্যপ্রয়াত বহুমুখী ব্যক্তিত্ব উৎপল চক্রবর্তীর শিল্পচর্চা কেন্দ্র ছান্দারে গিয়ে দেখলাম সেখানের লম্বা ঘাড়ের দৃপ্ত দুটি ঘোড়া সামনে না তাকিয়ে ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখছে। থমকে গেলাম।তাই তো,এটাও তো দারুণ।অন্যরকম
.
ভাবছিলাম। বাঁকুড়ার মতো রুখাশুখা একটা জায়গা,দারিদ্র যাদের নিত্যসঙ্গী সেখানকার মানুষের এত ঘোড়ার প্রতি টান কেন! দেবতাদের হাতি ঘোড়া দেওয়ার,মানত করার বাসনা কেন এলএক্ষেত্রে আদিবাসীদের একটা প্রভাব তো আছেই। পিরের দরগা বা থানই হোক বা কবরস্থান, সকলেরই দেবদেবী  থানে গাছতলায় ডাঁই করা নানান সাইজের, রকমের মাটির হাতি ঘোড়া। কিন্তু নিত্যদিনের খরা-দারিদ্র-দুঃখ-যন্ত্রণা-বেদনা উপেক্ষা করে এই যে 'মানত' তাদের--, এর মনটি কোথা থেকে এল? একসময় অরণ্য অধ্যুষিত হওয়ার কারণে অঞ্চলে হাতি ছিল প্রচুর। আজও দলমার দামালরা উৎপাত করেই চলেছেন। রক্ষা পাওয়ার জন্য " হাতিখেদা ঠাকুর " এর কাছেও মানত হচ্ছে, ঠিক আছে, হোক।কিন্তু ঘোড়া! ছিল কিছু,রাজা জমিদাররা ব্যবহার করতো।তাদের হাতিশালে হাতি,ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকত। হ্যাঁ,থাকতো।এখনো বাঁকুড়া শহরের কালিতলায় গার্লস স্কুলের পিছনে হাতিশাল স্থানটি বর্তমান। মালিয়াড়াতে দেখেছি হাতিবাঁধার জন্য লোহার তৈরি মজবুত শিকল।ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ঘোড়া ঘোড়ারগাড়িও ছিল। তবে "আম আদমি" কাছে তা ছিল কি, না, থাকতে পারে?
না থাকতে পারে। কিন্তু আম আদমির মেজাজটা রাজা জমিদারদের চেয়ে কিছু কম ছিল না। নিজেরা না চড়তে পারেন,ব্যবহার না করতে পারেন, তো কি হয়েছে! তাদের মনের বাসনা পূরণ করা প্রিয় দেবতাকে তো মাটির হাতি ঘোড়া দিতেই পারেন
তাই কি 'থানে-থানে' এত হাতি ঘোড়া?
.
সহৃদয় পাঠক,মাফ করবেন। আপনারা যাঁরা বাঁকুড়ায় বাস করেন বা এসেছেন,লক্ষ্য করেছেন ভালো করে। তাঁরা সকলেই জানেন- অনাদরে,গাছের তলায়,ভাঙা খড়ের চালায়  কিংবা ঠা ঠা রোদ্দুরে পড়ে থাকা এই সব শিল্পকর্মের মধ্যে যে কি রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে! ঊষরভূমিতে কোথা থেকে এল এ্যাতো এ্যাতো হাতি ঘোড়া!
রহস্য উন্মোচন হবে হয়ত একদিন। প্রতীক্ষায় থাকলাম গবেষকবৃন্দর গবেষণার জন্য
টেরাকোটা শিল্প নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।এখনো অনেকটাই অনালোকিত।  বাঁকুড়ার পটভূমিকায় সামান্য আলোচনা করার চেষ্টা করলাম মাত্র। জানি,তা পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। আরে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে বিষয়টি। উৎসাহী পাঠকগণ ঠিক পড়বেন,জানবেন, সমৃদ্ধ হবেন অন্যদেরও সমৃদ্ধ করবেন
-------------------------------------------------------------
সহায়ক গ্রন্থ:
-----------------
.
Bankura District  Gazetteers :BANKURA: A.K.Banerjee ( Edited) W.B.Govt.1968.
2.
পশ্চিম বঙ্গ : বাঁকুড়া জেলা সংখ্যা: বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্প :টেরাকোটার কাব্য: রবীন্দ্রনাথ সামন্ত,পঃ বঃ সরকার,( পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭)
.
বাঁকুড়া পরিচয়( - খন্ড),প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স,কোলকাতা ৭৩
.
ভারতের শিল্পসংস্কৃতির পটভূমিকায় বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা : চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত: বিষ্ণুপুর,বাঁকুড়া, পরিবেশক- দাশগুপ্ত এন্ড কোম্পানি প্রাঃ লিঃ,১৪০৭(ইং ২০০০).
.
বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা : চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত : টেরাকোটা, বিষ্ণুপুর,বাঁকুড়া।(প্রথম প্রকাশ ১৩৮৬) টেরাকোটা সং ১৪২২,
(
ইং ২০১৫)
.
বর্ণময় বাঁকুড়ার পথে প্রান্তরে:প্রভাত গোস্বামী :প্রকাশক : দেবীপ্রসাদ পালিত,বাঁকুড়া, জুন ২০০৭
.
পালিতের বাঁকুড়ার ভূগোল ইতিবৃত্ত ( ১৬শ সং) : সুধীর কুমার পালিত, লেখক কতৃক প্রকাশিত, বাঁকুড়া ১৩৭৩( বঙ্গাব্দ)
.
বাঁকুড়ার মন্দির : অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য সংসদ,কোলকাতা, ১৩৭১ ( বঙ্গাব্দ)
.
The Temples of Bankura District,( Re.Edn.)David Mc Cutchion, Writers Workshop Publication, Calcutta, 1972
-------------------------------------------------------------



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন