শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

রীনা রায়


"আলোর প্রতিক্ষায়"(দ্বিতীয় পর্ব)


 
তাদের এই গ্রামটা খুব ছোট, মুখে মুখে চাউর হয়ে গেছে অপুর গ্রামে ফেরার কথাটা অনেকেই দেখা করতে এসেছে, কিন্তু অপু লক্ষ্য করে দেখেছে তার বন্ধুরা বা কোনো মেয়ে তার সাথে দেখা করতে আসেনি বরং ওরা যেন ওকে এড়িয়ে চলছে কিন্তু কেন? যা ঘটেছে তাতে ওর নিজের তো কোনো দোষ ছিলোনা, তবে? ওর সমবয়সীদের না হয় বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু বাকিরা, যাদের সাথে ওর বড়ো হয়ে ওঠা তারাও তাকে দূরে ঠেলে দিল
একটু বেলার দিকে সে বাবার সাথে তাদের গ্রামের হাইস্কুলের হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেল  
বাবা এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন আর এখন যিনি প্রধান শিক্ষক , তিনি তখন উপ প্রধান শিক্ষক ছিলেন। 
ওরা ঘরে ঢুকতেই তিনি নিজে উঠে দাড়িয়ে 'আসুন স্যার, ভেতরে আসুন ' বলে বাবাকে বসতে বললেন
প্রাথমিক কথাবার্তার পর অপর্ণা বলল, ' স্যার, আপনি বাবার কাছে আমার প্রস্তাবটা শুনেছেন নিশ্চয়ই,,,,,,, ' 
'
হ্যাঁ, কিন্তু কেউ তো রাজী হচ্ছে না। কি জানো তো, আমাদের দেশটাকে আমরাই এগোতে দিইনা। দেশ তো তখনই এগোবে , যখন আমরা আমাদের বাড়ীর মেয়েদের সঠিকভাবে মানুষ করতে পারবো। আর মেয়েরা যদি স্বনির্ভর না হয়,,,,, শুধু আর্থিকভাবে নয়, তারা শারীরিকভাবেও সক্ষম হলে তবেই দেশের উন্নতি হবে'
অপর্ণার প্রস্তাবটা ছিল এই যে, স্কুলের ছুটির পর সব ছেলে মেয়েদের যোগব্যায়াম এবং ক্যারাটে শেখানো সে নিজে প্রথমে এককালীন কিছু অর্থ সাহায্য করবে, যা দিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হবে আর যিনি শেখাবেন তাঁর বেতন অন্তত একবছর টাকা থেকেই দেওয়া হবে। তারপর সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকেই খুব সামান্য বেতন নেওয়া হবে
কিন্তু , এদের কাছে এইসব শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়।পয়সা খরচ করে শরীরচর্চার কথা ওরা ভাবতেই পারে না। ছেলেরা তো তবু মাঠে ফুটবল খেলে, তাও ছেলেদের ব্যাপারে ওরা নিমরাজী হয়েছিল, কিন্তু মেয়েদের বেলায় কিছুতেই রাজী করানো যাচ্ছেনা আর অপর্ণার বেশি আগ্রহ মেয়েদের জন্যই।
অপর্ণার মনে হয় এই গ্রামের মানুষগুলো কি মধ্যযুগে বাস করে? এদের কাছে পড়াশোনা শেখানো হয়, শুধু ভাল বিয়ে দেওয়ার জন্য! স্কুলে পাঠানো হচ্ছে এই যেন অনেক স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সংসারের কাজকর্ম করুক , মানে বিয়ের পর যাতে শ্বশুরবাড়ীতে সুনাম অর্জন করতে পারে তারজন্য এখন থেকেই ট্রেনিং দেওয়া আর কি! অপর্ণার হতাশ লাগছিল তবু ঠিক করলো সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাল করে বুঝিয়ে বলবে
পরের কয়েকটা দিন সে মান্তু, বুবুন, রিম্পি, টিকলি, সোমা, চম্পা সবার বাড়িতেই গেল, কিন্তু আশার আলো কেউই দেখালোনা।
এদিক থেকে দেখতে গেলে তার নিজের বাড়ি অত্যন্ত আধুনিক মনোভাবাসম্পন্ন তার বাবা ইংলিশ এম পাশ করেছেন। অবশ্য সেদিক থেকে ভাবতে গেলে বাবা তো এই গ্রামের ছেলেই নয় বাবার তো এটা মামার বাড়ি বাবার মা ছোটবেলায় মারা যাওয়াতে দাদু নাকি আবার বিয়ে করেন তখন বাবার মামা মামি বাবাকে নিজেদের কাছে এনে মানুষ করেন বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, নিজের স্কলারশিপের টাকা থেকে উচচশিক্ষার খরচ চালিয়েছেন। বাবার সৎ ভাই বোনেদের সাথেও তাদের সম্পর্ক খুবই ভাল।মামার একমাত্র মেয়ে এখন দিল্লির বাসিন্দা ঘটনার পর পিসিমণি যদি তাকে না নিয়ে যেতো, তাহলে সে হয়তো বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলতো।
যাই হোক, এই করে করে বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেল, অপর্ণা ঠিক করলো কাল নয়নাদের বাড়ি একবার যাবে নয়নার ঠাকুমাকে গ্রামের অনেকেই খুব মান্য করে।প্রায় আশি বছরের একজন বয়স্কা মহিলা, তাকে রাজী করানো গেলে পরের ধাপ গূলো অনেক সহজ হবে।
পরেরদিন সকালে সে নয়নাদের বাড়ি গেল নয়নার মা দরজা খুলে তাকে দেখে একটু বিরক্ত হয়েছে মনে হল। 'কাকিমা, ভেতরে আসবো
'
কি ব্যাপার? ' 
'
এই এলাম একটু
'
, আয়'
অপর্ণা এই কদিনে এইরকম ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো বাড়িতেই সে উষ্ণ অভ্যর্থনা পায়নি। সে কিছু না বলে বাড়ির ভেতরে পা দিল। 
ভেতরে ঢুকেই দেখে নয়নার ঠাকুমা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে যাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন 'কেমন আছো ঠাকুমা? আমি অপু, চিনতে পারছো? ' বলে সে এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। ঠাকুমা প্রথমে তার আপাদমস্তক দেখেন, তারপর বলেন, ', বউমার লগে শুনি তোর কথা। তা আমাগো সনে কি কাম তোর?'
নয়নার মা কথার মাঝেই বলে ওঠেন, 'শোন অপু, তুই বিদেশে থাকিস, ওখানে কি করছিস আমরা দেখতে যাই না। তুই নিজে তো নষ্ট হয়ে গেছিস। আমরা গাঁ গজ্ঞে থাকি, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।তুই বাপু আমাদের বাড়িতে আসিস না।'
অপু কিছু বলতে পারে না, স্তব্ধ হয়ে যায় তার মাথাটা কেমন দুলে ওঠে,,, সে নষ্ট মেয়ে,,, নষ্ট? সেই দিনটা যেন অপর্ণার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। 
তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী মেধাবী ছাত্রী হিসাবে বরাবরই তার সুনাম ছিল। 
তাদের গ্রামে দোল উৎসব বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়। অনেকের বাড়িতেই আত্মীয়- বন্ধু ওইসময় আসেন দোল উৎসব উপলক্ষে মেলাও বসে সেবারেও বাইরে থেকে অনেকেই এসেছিলেন। অভিদার কলেজের দুজন বন্ধুও এসেছিল। তাদের হাবভাব অপর্ণার একটুও পছন্দ হয়নি। 
কয়েকদিন কলেজ যাওয়া হয়নি, সেদিন ফিজিক্স এর প্রাকটিক্যাল ছিল, আর দুটো ইমপরট্যান্ট ক্লাস ছিল, তাই সে ঠিক করেছিল সেদিন কলেজ যাবে মা বলেছিলো ফেরার পথে কয়েকটা জিনিস কিনে আনার জন্য। অপর্ণা বাড়িতে বলে গেছিলো যে ফিরতে দেরি হতে পারে কারণ, যেদিনই ফিজিক্স এর প্রাকটিক্যাল ক্লাস টা শেষ পিরিয়ড থাকে, সেদিন কিছুতেই ওই পাঁচটার বাসটা ধরতে পারে না। বাড়িতে এটা সবাই জানে, কিন্তু কিছু তো করার নেই পরের বাসটা প্রায় দু ঘন্টা পরে। অনেকেই ফেরে, তাই অপর্ণা ক্লাস শেষ করে পরের বাসটাই ধরে। 
সেদিনও অপর্ণা বাসটাই ধরেছিল
কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য যে সেদিন বাসে উঠে গ্রামের কাউকেই দেখতে পেলনা। মনের মধ্যে একটু খচখচ করলেও নিজেকে ক্রমাগত সাহস দিয়ে যাচ্ছিল কেন জানিনা ওর মন কু ডাকছিল।
অনেকটা রাত হয়ে গেছিলো। বাস থেকে নেমে দেখলো আটটা কুড়ি বাজে। রাস্তা বেশি না হলেও কোনো আলো নেই ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে দ্রুতপায়ে হাঁটা শুরু করলো।
গ্রামের মোড়টা আসতেই কতকগুলো আগুনের ফুলকি ওর নজরে পড়লো। একটু নিশ্চিন্ত হল। যাক্, এখানে আড্ডাটা আজকেও বসেছে একটু এগোতেই কতকগুলো ফিসফিস আওয়াজ যেন ওর দিকেই এগিয়ে আসছে থমকালো, কি হলো, ওকে কি কিছু বলবে ওরা?
-------ক্রমশঃ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন