শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


স্বনির্ভরতা এবং  আজকের নারী


এই বিষয়টি নিয়ে  ধারাবাহিক ভাবেই আমাকে লিখতে হচ্ছে  কিছু কথা । ধারাবাহিক লেখা যে কত কষ্টের এবং শ্রমসাধ্য তা বুঝতে পারছি এখন । একের পর এক মুখ এসে  ভিড় করছে করছে চারপাশে । যাদের নিয়ে একসময় লিখতে চেয়েছি কিছু কথা । পারিনি । পিছিয়ে এসেছি নানা কারণে । অথচ আমি তো আমার চারপাশে দেখেছি আপোষহীন লড়াকু কত মহিলা যারা আত্মমর্যাদার প্রশ্নে ত্যাগ করেছে নিজের সংসার , নিজের ভালোবাসা এমনকী নিজের জীবনও । প্রথমেই মনে পড়ছে চন্দনাদির কথা । যৌথ পরিবার ছিল তাঁদের । বাবা কাকা জেঠা মিলে সাত সাতটা ভাই । এক বিশাল উঠোন । সেখানে একান্নটা থালা পড়ত । একটু প্রাচীনপন্থী ধারণা ছিল । মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ ছিলনা তাঁদের । ফলে কোন মেয়েই প্রাথমিকের পর আর হাই স্কুল যাওয়ার সুযোগ পায়নি । চন্দনাদি ছিল খুব মেধাবী । মুখে মুখে চটপট অঙ্ক করে দিতে পারত । এসব গল্প আমার শোনা । আমি তার বাল্যকাল দেখিনি । বুড়ো হয়ে যাওয়া চন্দনাদিকে দেখতাম । শিথিল চামড়া তবু কি টানটান মেরুদণ্ড । মৃত্যুর আগের দিন অবধি এই শিরদাঁড়া বাঁকা হয়নি । ঋজুতা হারায় নি । মেধাবী হওয়া সত্তেও তার পড়াশোনা থেমে গিয়েছিল মাঝপথে । মাঝপথে ঠিক নয় , পথের শুরুতেই । গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল হাই স্কুল । নদী পেরিয়ে , ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে শরবনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সেই রাস্তা পেরিয়ে । চন্দনা জেদ ধরেছিল – আমি যাবই স্কুলে । বাবা কাকারা ধমকে উঠেছিল – অতদূর । কার সাথে যাবি শুনি ?   কোন মেয়েকে দেখেছিস ইস্কুলে যেতে ?
-          কেউ না যাক , আমি যাব ।
- কে তোকে দিয়ে আসবে ওই দূরের স্কুলে ?
  – কেন ছেলেদের সাথে যাব ?
ঘরের সবাই চমকে উঠেছিল তার কথায় – মেয়ের আস্পর্ধা তো কম নয়  । বন্ধ হয়ে গেল চন্দনাদির পড়াশোনা । শুধু বন্ধই হল না  , অল্পবয়সে তের কি চৌদ্দ বছরে বিয়েও হয়ে গেল তার । বিশাল অবস্থাপন্ন শ্বশুরবাড়ি ।চারদিকে ঐশ্বর্য । আঁটাকল তেলকল থেকে আরম্ভ করে খান দশ বারো বিজনেস । তবু   বিয়ের সাত বছরের মাথায় চন্দনাদি ফিরে এল  বাপের বাড়িতে ।  বর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে । চন্দনাদি শুধু মৃদু প্রতিবাদ করে বলছিল – তুমি তো একবারটি আমাকে জানাতে পারতে ?
-          কি লাভ হত শুনি তুই কি বাচ্চা  বিয়োতে পারবি ? সে মুরাদ কি তোর আছে ? 
-          এখনই তো সময় চলে যায়নি ।
-          তোকে তো তাড়িয়ে দিচ্ছি নে বাপু , থাক , আরাম করে রাজরাণীর মতো থাক । বাড়ির কাজকম্ম দেখাশোনা কর ।
রাজরানী হয়ে থাকা আর চন্দনাদির হয়নি । শূন্য স্তব্ধতার ভেতর সে জানত একটিই আশ্রয়- মা । তাই মায়ের কাছেই ফিরে এসেছিল । ততদিনে পরিবার ভেঙে গেছে । বাবা ত্যগ করেছেন ইহলোকের মায়া ।ছিন্নবিচ্ছিন্ন পরিবারে আর্থিক অবস্থাও নড়বরে । আজ জুটেছে কাল কি খাবে কালের ঘরে শনি । সেলাই দিদিমণি নয় এমনকী ভাইয়েদের সংসারেও নয় , একান্ত নিভৃত আশ্রয়ে  মা কে নিয়েই শুরু হয়েছিল তার সংসার । মুড়ি ভেজে , ছোলা ভাজা  মটর ভাজা বিক্রি করেই দিনাতিপাত করত । তবু ঠোঁটের কোণে সবসময় লেগে থাকত এক চিলতে হাসি । আমি যখন একটু বড় হলাম । যখন অল্প স্বল্প লিখতে শুরু করলাম । তখন মনে হল চন্দনাদিকে নিয়েও একটা গল্প হয় । সে গল্প লেখা হয়নি । কিন্তু তাকে দেখার চেষ্টা করতাম । কখনও সরাসরি , কখনও আড়াল থেকে । কখনও শব্দের ভেতর থেকে বিযুক্ত নিঃশ্বাসের শব্দে । না , কখনোই কোন আফসোস দেখিনি তার মধ্যে । ছোট খাটো যোগ বিয়োগ বা সরলের অঙ্কগুলো ঝটপট করে দিত এক নিমেষে । আমি তাকিয়ে থাকতাম তার চোখদুটোর দিকে যেখানে হিরে মাণিক জ্বলত । হাসতে হাসতে বলত – কতদিন আগে শিখেছি , এখনও মনে আছে , বল ।
-          তুমি আর পড়াশোনা করলে না কেন ?
-           কি হত , আমার কি ল্যাজ গজাত ? 
না , মানে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে ...... কথাগুলো মুখের ভেতর এলেও বলতে পারিনি । আত্মমর্যাদা এবং স্বনির্ভরতার এত জ্বলন্ত নমুনাকে  কি এসব কথা বলা মানায় ?  আমি শুধু প্রণত ভঙ্গিমায় তার পায়ের কাছে এসে দাঁড়াই । এই স্বনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী নারী তো আবহমান সময়ের ।

      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন