শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

তুষার সরদার


                               পরিচয়
                                                                
                                                
      যথোচিত সাজগোজ এবং যথাসম্ভব গোছগাছ করে জান্‌কী দুবে ওরফে জান্‌কী দেবী অপেক্ষা করছিল তার কোয়ার্টারের বারান্দায়। জান্‌কী কিন্তু পঢ়ি-লিখি আউরত। যার খুশি সে অবিশ্বাস করুক, জান্‌কী কিন্তু চার-পাঁচ কিলাস তক পড়েছেই পড়েছে। সে দস্তুরমতো নামসইও করতে পারে – হিন্দিতে।
      জান্‌কী তেমন বেশি বুড়বাকও নয়। পরতে ভালো লাগলেও সে কিন্তু আজ লাল-ছাপা শাড়িটা পরেই নি। খুব হালকা নীল-ছাপা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরেছে। বারান্দায় পাতা চৌপাইতে প্রথমে কম্বল তার ওপর কাচা চাদর বিছিয়েছে। ঘরদোর সাফ-সুতরো করিয়েছে। দিগেন্দরকে দিয়ে লাড্ডু আর গরম সামোসা পর্যন্ত আনিয়ে রেখেছে।
     
      প্রায় দু’মাস হয়ে গেল জান্‌কীর মরদ ভরত দুবে মারা গেছে। পাঁড় নেশাখোর ছিল ভরত। আর ভীষণ বদমেজাজি। যতদিন বেঁচেছিল জান্‌কীকে হাড়েমাসে জ্বালাতন করেছে। দিগেন্দরের মুখ চেয়ে সেসব অতিকষ্টে সহ্য করে আসছিল জান্‌কী। তাছাড়া এমনিতেই সে বড় নিরীহ স্বভাবের। তারপর তো শেষপর্যন্ত মা সন্তোষী মুখ তুলে চাইলো। চড়া ডায়াবেটিসের রোগী হয়েও ভরত চোলাই মদে ডুবে থাকতো। সেরিব্র্যাল স্ট্রোকের প্রথম ডাকেই খুব বিশ্বস্ত ভাবে পুরো সাড়া দিয়ে দিল সে।
      মদ্যপ ভরতের চাকরিটা দৈবক্রমে ছিল সরকারী। নিয়মমাফিক সরকারী কর্মচারীর ‘মৃত্যু-পরবর্তী অনুসন্ধান’এর জন্য হেডঅফিস থেকে একজন সাহেব (ঊচ্চপদস্থ কর্মচারী) আজকে দুপুরের পর জান্‌কীর এখানে আসছেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। সেইজন্য জান্‌কী আজ জলদি জলদি কোনমতে নাহানা-খানা সেরে নিয়ে দুপুর থেকেই বারান্দায় তাঁর অপেক্ষায় বসে আছে। দিগেন্দরও তার সংগে আছে।
      কাগজপত্র অনুযায়ী বয়স চৌতাল্লিশ হলেও জান্‌কী সবসময়েই তার বয়স উন্‌চালিশ বা চালিশের মধ্যেই রাখার চেষ্টা করে। অবশ্য তাকে দেখলে উন্‌চালিশ বা চালিশের কম বলেই মনে হয়। সে যাই হোক জান্‌কী হোল ভরতের আস্‌লি এবং পহেলি জেনানা। অবশ্য দুসরা কোনো জেনানা ভরতের আছে কিনা তা এখনো পর্যন্ত জানা যায় নি। সুতরাং সরকারী আইনমাফিক ভরতের প্রাপ্য টাকাপয়সা সবই সে-ই পাবে। তাছাড়া একটা সরকারী নোকরি পাবারও হক আছে। তবে চাকরিটা সে নিজে করতে চায় না। যদি সে না করতে চায় তাহলে নাকি সরকারী নিয়ম অনুযায়ী চাকরিটা তার ছেলে দিগেন্দর পাবে।
      তবুও জান্‌কী বেশ খানিক চিন্তার মধ্যে আছে। সরকারী কাজের চলন বড়ই ঢিমে। যতক্ষণ না টাকা-পয়সা, পেনশন্‌, চাকরি সবকিছু তার হাতে আসছে ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হওয়া কঠিন। দিগেন্দরও তাই মনে করে। তবে জান্‌কীর তুলনায় সে একটু বেশি চিন্তিত। তবুও সে ঠিকমত দাড়ি কামিয়েছে, নাহানার আগে চুলে ভালো করে নারিয়ল তেল মেখেছে। ধোবির বাড়ি থেকে আসা জামা প্যান্ট পরে নিয়েছে।
     
      সাহেব অর্থাৎ অরণ্য যখন এলো তখন তিনটে বাজতে যায়। এত দেরি করে আসার ফলে গরম সামোসা প্রায় ঠান্ডা হতে চলেছে।  অরণ্য এসেই বড্ড হুটোপাটি বাধিয়ে দিলো। ভালো করে খাতির করে -‘আইয়ে সরকার – নমস্তে সরকার – তশরীফ রাখিয়ে –’ এসব কেতামাফিক ঠিকমত বলে উঠতে না উঠতেই অরণ্য একেবারে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিল,-
-তোমার নাম কী?
-জান্‌কী দেবী, সরকার। আমি -
-তুমি ভরত দুবের জেনানা?
-জী সরকার। আমি -
-তোমার সঙ্গে শাদির আগে ভরতের আর কোন শাদিটাদি হয়েছিল?
-জী না সরকার। আমি পহেলি -
-আমার খুব তাড়া আছে। ঝটপট কাগজ-পত্রটত্র সব কিছু এখানে নিয়ে এসো।
      জান্‌কী আর দিগেন্দর মিলে খুব ঝটপট করেই লাড্ডু, সামোসা আর কাচের গেলাসে ঠান্ডা পানি সযত্নে নিয়ে এলো। বিগলিত ভাবে সেসব অরণ্যের সামনে রাখা টুলে রাখতে গেল –’  
-এসব কী? বললাম তো কাগজপত্র আনতে – হটাও এসব। আচ্ছা থামো, – জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খালি করে দিয়ে অরণ্য বললো – এবার সব হটাও। আর জলদি কাগজপত্র আনো।

      অগত্যা ক্ষুন্ন লাড্ডু আর বিমর্ষ সামোসা ঘরের ভিতর ফিরে যায়। কাগজপত্র অর্থাৎ মৃত ভরতের ডেথ সার্টিফিকেট, পরিবারের সদস্যদের পরিচয় সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র যা যা আছে সেগুলো নিয়ে আসে জান্‌কী। সেসব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে অরণ্য বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। জান্‌কী অত্যন্ত বিনয়ে লতিয়ে লতিয়ে সে সবের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে একটুআধটু গুলিয়ে ফেললেও মোটামুটি ঠিকঠাক উত্তর দিচ্ছিল সে। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে এসে বড্ড বেশি ঝামেলা হয়ে গেল। এরকম যে হতে পারে তা ভাবতেই পারেনি জান্‌কী। সব কাগজপত্র ভালো করে দেখা-টেখা হয়ে যাবার পর অরণ্য জান্‌কীর দিকে তাকিয়ে বললো,-
-তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তোমার দু’টি মেয়ে আছে এবং তারা দুজনেই বিবাহিত –এখন তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। এছাড়া তোমার একটি ছেলেও আছে, - তার নাম দিগেন্দর দুবে - তাই তো?
-জী সরকার।
-এই তিনজন ছাড়া তোমার অন্য কোনো ছেলেমেয়ে নেই তো?
-জী না, আর কোই না আছে। দিগেন্দর মেরা এক হি লড়কা। সবসে বড়া ভি আছে।
-দিগেন্দরের শাদি হয়ে গেছে নাকি?
-জী না সরকার।
-দিগেন্দর তাহলে তোমার কাছেই থাকে?
-হঁ সরকার, নোকরিটা আমি করবে না। মেরা লড়কা দিগেন্দর নোকরি করবে।
-তুমি নিজে যদি চাকরিটা না করতে চাও, সেক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হতে পারে। তার আগে ঠিক করে ভেবেটেবে বলো তোমার ছেলে দিগেন্দর তোমাকে ভালো করে দেখভাল করবে বলে তোমার মনে হয়?
-হঁ হঁ সরকার, দিগেন্দর হমার দেখভাল করবে....জরুর করবে!
-বেশ, এবার তাহলে দিগেন্দরকে এখানে ডাকো। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
-জী সরকার – ওহি তো দিগেন্দর খাড়া আছে, - মেরা লড়কা  - মেরা লাল্লা!
-এ-ই- দিগেন্দর!’ – বছর চল্লিশের দিগেন্দরের দিকে তাকিয়ে মহবিস্ময়ে অরণ্য বললো, -‘এই তোমার সেই লড়কা - দিগেন্দর দুবে!!
-হঁ হঁ সরকার। ইসিকো নোকরিটা বানিয়ে দিন। দিগেন্দরকে চোখের ইঙ্গিত করে জান্‌কী। দিগেন্দর তৎক্ষণাৎ সাড়ম্বরে এবং সবিনয়ে একটি যথোচিত ভূলুণ্ঠিত প্রণাম লাগিয়ে দেয় অরণ্যকে।
      ধাতস্থ হতে প্রায় মিনিট খানেক সময় নিল অরণ্য। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, -‘আচ্ছা, এখানকার পুলিশ ফাঁড়িটা তো খুব কাছেই আছে, তাই না?
-জী সরকার, নজদিগেই আছে। মগর কিঁউ? 
-পুলিশ ডেকে এনে এক্ষুণি ধরিয়ে দেব তোমাদের – দুটোকেই! কম করেও দশ বছরের জেল! আজ থেকেই শুরু হয়ে যাবে। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে তো ফাঁসি হবেই – দুজনেরই হবে!
       
     নিতান্তই এক সরল সিধা দেহাতি মেয়ে জান্‌কী। সত্য অনাড়ম্বর হয় - মিথ্যা মোটেই তা নয়। মিথ্যাকে অনেক সাড়ম্বর আর শৈল্পিক হতে হয়। এসব কথা জান্‌কীর উপলব্ধির অনেক বাইরে। সেজন্য পরিপাটি, টেকসই, রিহার্সাল-দেওয়া মিথ্যার বেসাতি সে এখনো রপ্ত করতে পারেনি। দিগেন্দরও তাই। দুজনেই কেঁপে ওঠে, শাস্তির বহর শুনে চোখ-মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। মুখে কোন কথা জোগায় না। এইবার সময় হয়েছে বুঝে অরণ্য কড়া ধমক দেয়,-
-‘তোমার লড়কা আসল দিগেন্দর কোথায় আছে ঠিকঠাক বলে ফেল, তাহলে এবারে কোনমতে বেঁচে যেতেও পারো’। হাস্যকর রকমের নির্বোধ অপটু মিথ্যা একেবারেই ধ্বসে যায়. পুরোটাই ভেঙে পড়ে জান্‌কী,-
-সে দেহাতে অপনা গাঁওমে আছে। খেতি-বাড়ি দেখাশোনা করে। শাদি-উদি ভি করে নিয়েছে। লড়কার বহু ভি গাঁওমে ইস্‌কুল কা মাস্টারনী আছে। সে নোকরি করবে না সরকার। অপনা গাঁও ছোড়কর তারা ইখানে জিন্দেগি-ভর কভি ভি -
-এই লোকটা তাহলে কে? এর আসল নাম কী?
-উয়ো – উয়ো – রামবলী আছে সরকার।
-রামবলী তোমার কে হয়?
-হামার মরদ আছে সরকার –’
-সে কী – ঈ! ভরত দুবে তাহলে তোমার মরদ ছিল না?
-হঁ হঁ, ভরতহি হমার মরদ তো পহ্‌লে ছিল। বহোত শরাবি ছিল, দিনরাত দারু পিতো। কাম কাজে যেত না। যখন মর্জি হত আমাকে গালি দিত, ধরে ধরে মারতো – ডান্ডা, লকড়ি, যা হাতের কাছে পেত তাই দিয়ে পেটাতো – জানবর কী মাফিক। খেতে দিতো না। নিজে ভুখা থেকে রামবলী হমাকে খেতে দিত। কতবার মারের চোটে হমার কত জায়গায় কেটে ফেটে গেছে, ফুলে গেছে – রামবলী সেজন্য দাওয়াই কিনে এনে দিত। মলম ভি লাগিয়ে দিতো....’
     তখন জেল বা ফাঁসি হবার ভয়েও কাঁদে নি জান্‌কী। এখন রামবলীর কথা বলতে গিয়ে চোখে জল উপচে আসে জান্‌কীর - ‘অপনা লড়কা ভি হমার কোই দেখভাল করে না। কিত্‌না দিন, মাহিনা, বরষ বিত্ গয়ি, রামবলী আমার জন্যে শাদি ভি করেনি সরকার। কুছদিন পহ্‌লে বজরংবলী কা মন্দির যাকে হমলোগ শাদি কর্‌ লিয়া। মাফি মাংতা সরকার! ইস্‌ বার কে লিয়ে ছোড় দিজিয়ে, উসকা নোকরি নেহি চাহিয়ে, হমকো ভি নোকরি নেহি চাহিয়ে – মাফ কিজিয়ে সরকার। রামবলী বহোত বড়া দিলকা আদমি আছে, – উস্‌কা দিল মে প্যার আছে - উস্‌কা আঁখ মে পানি আছে.... সির্ফ মেরে লিয়ে সরকার....’
_____________________

             প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু                                                                         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন