শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ফাল্গুনী ঘোষ


পঞ্চ নদের দেশ
         খুব ছোটো থেকেই ঘুরে বেড়ানোর সখ আমার প্রবল। কোনোমতে দু-একদিন বা এক আধটা বিকেলও যদি ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মত জুটত, মন ফুরফুরে পাখী হয়ে যেত। এ হেন আমি ফেবু’র ওয়ালে লোকের ঘুরতে যাওয়ার ছবি ও বর্ণনা দেখি এবং মুখ নামিয়ে বসে থাকি। কারণ ঘুরতে যাওয়ার দুটো প্রধান প্রয়োজন—সময় ও সঙ্গ। সময় যদি বা মেলে সঙ্গী’র বড় অভাব। কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্রী নই তাই গত বছর (২০১৬ সালে)শুরু থেকেই আঠঘাঁট বাঁধতে শুরু করি। চেষ্টায় কি না হয়! আমিও আমার এই ছোট্টো মফস্বল শহরে খুঁজে পেয়ে গেলাম ততোধিক ছোটো অচেনা/ আধাচেনা ট্যুর গ্রুপ। মা’কে সঙ্গী  করে থোড়- বড়ি- খাড়া’র জীবনকে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বোঁচকা বেঁধে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান রেডি হয়ে গেল। যেহেতু জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণ আমাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, মে মাসের সময়টা না বেছে উপায়ও ছিল না। তাই উত্তর পশ্চিম ভারতে সেসময় চাঁদিজ্বলা গরম হলেও অমৃতসর তালিকায় ঢুকে পড়েছিল। হাতের কাছে স্বর্ণমন্দিরটা কিছুতেই ছাড়া যায় না।  

        গরমের ছুটি পড়লে রোদ গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল আমার উত্তেজনার পারদ। ধীরে ধীরে এল সেই নির্ধারিত দিন। দুটি মানুষ ততোধিক লোটাকম্বল(৩টে) নিয়ে বর্ধমানগামী শহীদ এক্সপ্রেসে চেপে বসা গেল। সহযাত্রী ভ্রমণসঙ্গী এক দাদা বৌদির সাথে আলাপ দিয়ে যাত্রা শুরু এবং বর্ধমান পৌঁছাতে পৌঁছাতে গরম চা আর ঝালমুড়ির সাথে তাদের ৭-৮ বছরের কন্যারত্ন আমার মায়ের নাতনী’র পদ অধিকার করে বসল এরপর বর্ধমানে রাত্রি আটটায় অমৃতসর মেল এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট এসি কুপেতে সংসার পেতে বসলাম আয়েস করে। ছত্রিশ ঘন্টা যেতে হবে, সে তো সোজা নয়। আর ‘বিশ্বজোড়া আমার আপনজন’ মনোভাবেই সেই কুপেতে কলকাতার আরেকটি অচেনা পরিবারের সাথে আমাদের জবরদস্ত আলাপ হয়ে গেল। পরের দিন কাশীর ঘাট পেরিয়ে লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত রেল গাড়ির তালে তালে সেই কুপেতে যেন বিশ্ববাংলার আসর বসে গেল। কিন্তু হায়! সুখ মানুষের কপালে বেশিক্ষণ জোটে না। লক্ষ্ণৌ স্টেশনে সেই বাঙালি পরিবারের স্থান অধিকার করল দশাসই পাঞ্জাবি, মাঝবয়সী ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা! যাদের সাথে শুধু কৌতুহলী দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া সে রাতের মত আর কিছুই হল না। তাছাড়া পরের দিন সকালেই আবার আমাদের নামতে হবে। তাই রুটি চিকেন খেয়ে রাতের মত চোখ বোজা গেল।  

‘এলাইচি চায়েএএএ’ – হাঁকে পরদিন সকালে চোখ মেলে দেখি লুধিয়ানা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে। জানলার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটাতে সূর্যের রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। প্ল্যাটফর্ম চত্বরে পশমি পোশাকের পসরা। তাহলে তো পঞ্চনদের দেশে পা রেখেছি! কিন্তু নদীগুলো কই? মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে কানে এল-“অমৃতসর পৌঁহুছনেসে প্যাহেলে বিয়াস আয়েগা।“ দেখি গতকালের সেই পাঞ্জাবী মহিলা।সে নাকি  কলকাতায় গেছে, কালীঘাট দেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙালি আর যাই হোক আড্ডা জমাতে ওস্তাদ। হলই বা একজন হিন্দিভাষী আরেকজন বাঙালি, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সুতরাং দুই অসমভাষী গৃহবধূর আলাপচারীতা জমে উঠল। এদিকে দুপাশের চলন্ত দৃশ্য থেকে উঠে আসছে একটি বা দুটি ক্ষেতের মধ্যে একটি করে বাড়ি। যে ক্ষেতের যে মালিক সে নাকি সেখানেই বাড়ি করে থাকে এটাই দস্তুর। আর গমের পলুইগুলি সব শিবলিঙ্গাকৃতি। গম, যব, মকাই-এর হরিয়ালি ক্ষেত! হঠাৎ চোখে পড়ল চকচকে সাদা জলের রাশি। দু চোখ ভরে শুষে নিলাম বিপাশাকে। অবশেষে হাঁকডাক, হৈ চৈ-এর মাধ্যমে নেমে পড়া গেল অমৃতসর স্টেশনে।
    আমাদের ট্যুর গ্রুপের গাইড কাকুর পূর্ব পরিকল্পনামাফিক টাটা সুমোতে করে হোটেল সীতা নিবাস-এ পৌঁছালাম। আগের রাতে প্রবল ঝড় বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া আরামদায়ক ছিল। শুনলাম যে হোটেল থেকে মাত্র দু-মিনিটের হাঁটা পথে অমৃতসরের অন্যতম আকর্ষণ ‘স্বর্ণমন্দির’শুনেই প্রায় দুদিনের জার্নির ধকল কোথায় উধাও হয়ে গেল! এখন শুধু স্নান খাওয়া করে বিকেল হওয়ার অপেক্ষা। বিকেল ছ’টায়(এখানে আটটায় সন্ধ্যে লাগে) ছোটো ছোটো দলে নিজেদের মনের মত করে বেড়িয়ে পড়া গেল। ছোটোখাটো বাজারের গলিপথ ধরে কয়েক পা হাঁটতেই সামনে সেই কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণমন্দিরের দরজা। পূর্ব দিকের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে এর বিশালত্ব মালুম পড়ল। মন্দিরে ঢোকার মুখেই সারি সারি জুতো রাখার জায়গায় টোকেন নিয়ে খালি পায়ে প্রবেশ। শীতকালে গরম আর গরমকালে শীতল স্বচ্ছ্ব একটি জলধারা আপনার পা ধুইয়ে দেবে। এরপর মাথায় কাপড় দিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ। যাদের কাপড় বা ওড়না নেই তাদের জন্য মন্দিরে প্রবেশের মুখে বিভিন্ন রঙের টুকরো রুমাল পাওয়া যাচ্ছিল। যাই হোক নারী পুরুষ নির্বিশেষে মাথার কাপড় যেন না সরে এরজন্য হাট্টাকাট্টা শিখ পালোয়ানেরা লাঠি ঠকঠকিয়ে নজরদারি করে বেড়াচ্ছে।

সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরে মোড়া, মধ্যে স্বচ্ছ্ব সুন্দর বিরাট জলাধার। পূর্বদিকে ঢুকে পশ্চিম পর্যন্ত যাতায়াতের পথ কার্পেট মোড়া। পশ্চিম প্রান্ত থেকে আবার সরোবরের মধ্যে পূর্ব পর্যন্ত একটি সেতুর মধ্যে দিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশের রাস্তা। সেই মন্দির যার চূড়াটি সুদৃশ্য সোনার পাতে মোড়া। চারদিকে চারটি দরজা – জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সাদর আমন্ত্রণ সেখানে। মূল মন্দিরের বাঁধানো বেদির মধ্যে রয়েছেন ‘গ্রন্থসাহিব’। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ । কিন্তু কি অদ্ভুত শান্ত কোলাহলহীন স্থান! গোটা এলাকা জুড়ে শুধু মধুর স্বরে অনুরণিত হচ্ছে নানক ও কবীরের দোঁহা। শিখদের সব থেকে বড় এই ধর্মস্থান হরমন্দির সাহিব বা ভগবানের দরবার। শিখগুরু পঞ্চম অর্জুন ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরীর কাজ শুরু করেন পরে ১৬০৪ সালে আদি গ্রন্থকে এখানে স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে দশজন শিখ গুরুর বাণী সম্বলিত এই আদি গ্রন্থই ‘গ্রন্থসাহিব’ নামে খ্যাত হয়।
       অমৃত সরোবর থেকে ‘অমৃতসর’। এই সরোবরের জল শিখদের কাছে পরম পবিত্র। তাঁরা মাথায় ছোঁয়াচ্ছেন দেখলাম। আর আমার মত দর্শন পিপাসুর কাছে শান্ত, স্বচ্ছ্ব, শীতল, গভীর এই জলে লাল, কমলা, সাদা, ঘন শ্যাওলা রঙের নাম জানা/অজানা মাছের খেলা আর জলের উপরের স্তরে স্বর্ণমন্দির ও সূর্যের গোধূলিবেলার ছটার যে লুকোচুরি তা এক পরম প্রাপ্তি। মন্দিরের দোতলায় অকাল তখত, গুরু গ্রন্থসাহিবের রাত্রিকালীন আবাস। প্রতিরাত্রে সোনার পাল্কিতে করে বাদ্য সহকারে তাঁকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার সেভাবেই ভোর রাত্রে নামিয়ে আনা হয়। এখানে প্রহরের পর প্রহর কেটে গেলেও স্থানমাহাত্ম্য আপনাকে  সমাহিত করে রাখবে। তাছাড়া ভুখা পেটে থাকারও প্রশ্ন নেই। লঙ্গরখানায় পাত পেড়ে উৎকৃষ্ট মানের খাবার খান। এছাড়াও কয়েকহাত অন্তর জলদান ও সুজির হালুয়া বিতরণের ব্যবস্থা র‍য়েছে। দুহাত জোড় করে ভক্তিভরে সেই হালুয়া মুখে দিলেই হুশশশ করে কোথায় মিলিয়ে যাবে আর অপূর্ব স্বাদের জোয়ারে আপনার মন পুলকিত হয়ে উঠবে।  
      চারিদিকে এইসব দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। নক্ষত্রখচিত পরিষ্কার আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝিকমিকে আলো মেখে স্বর্ণমন্দির এক স্বর্গীয় রূপ ধারণ করল। কি অনাবিল দৃশ্য সুখ! কি অপরিমিত শান্ত, আধ্যাত্মিক পরিবেশ। হাজার হাজার শিখ সম্প্রদায়ের শৃঙ্খলাপরায়নতা, ত্যাগ, ধৈর্য, সেবাদানের মনোবৃত্তি—শিক্ষনীয় বিষয় যে কোনো মানুষের কাছে। তিন চার ঘন্টা ওখানে সময় কাটানোর পর দলের ডাকে ফিরতে ফিরতে এক ভাবগম্ভীর আধ্যাত্মিকতা সবার মনে ভর করে ছিল। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন