রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                                       


পরাগ 




মৎস্যকন্যার হিজাবের নিচে প্রেতমুখের অতিরিক্ত কিছু ছিলো না- এই সিদ্ধান্ত স্বধার মস্তিস্ক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর গতিবেগের লাজ রাখতে আধা পাথুরে প্রায় জোলো উপত্যকার প্রতিটি বৃক্ষ ফিসফিসিয়ে উঠলো- আদেশ ... আদেশ...


যে তাকে প্রথম জানিয়েছিলো এই প্রদেশের কথা, তার কথা স্বধার সম্যক মনে আছে। সে কৃতজ্ঞতা ধারণ করে পর্যাপ্ত কিন্তু সিসিফাসের স্ত্রী লিঙ্গের ভূমিকায় নিজেকে মনোনীত করার বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই বলে ছাই আর আঁশবটি- দুইকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। 'সংসার' আর 'সম্পর্ক' এই দুই সংগ্রামে 'সার' ঠিক ততোটুকু যতখানি পরমহংস বৃত্তি, বাকিটা 'সংনামা'। হা হা করে হেসে উঠলো সে। প্রতিধ্বনি এলো না কারণ শুধুমাত্র তার কাছেই, তার জন্যেই আসা ক্ষতখচিত পাঁজরকে প্রকৃতি যখন আশ্রয় দেয়, মানুষের মতো লবণ লীলা করে না। 



বড় আশ্চর্য রূপ এই ময়ূর পাহাড়ের। সে বর্ষায় এসেছে, চ্যাপলিন মনে পড়েনি। পদ্মবিল দেখার সময় শ্যাম-নৌকা ভেসেছে। তার কিছু ব্যাক্তিগত রূপকল্প আছে যেগুলো ঘুমিয়ে থাকে অন্যসময় কিন্তু রিপ ভ্যান হতে পারে না। যখন একটিও দূর্বা পা ছুঁয়ে বলে ওঠে লেলিহা মুদ্রায় "অস্যৈ প্রাণা: প্রতিষ্ঠন্তু অস্যৈ প্রাণা: ক্ষরন্তু চ", মুহূর্তে চরাচর তার কবিতা বোধ হয়- 'অবাঙমানসগোচরম' ।


স্বধার মনে পড়তে থাকে শৈবলিনীর কথা। এই একজনই এখনো অবধি জীবিত অথবা একমাত্র প্রাণ যে তাকে 'স্বাধীনতা' শব্দের সংজ্ঞায় কোনো সৌজন্যসূচক ঝরোখা রাখতে শেখায়নি। একবার, মাত্র একবারই তিনি বেনারসে পা রেখেছিলেন তার বন্ধুর ডাক ফেরাতে না পেরে। সেইবার জন্মইস্তক স্বীয় করতলের মতো চেনা বেনারসকে স্বধার অপরিচিত লেগেছিলো বিস্ময়ে। এমনকী, সে যার পৌত্রী, তারও। কে না জানে (অন্তত তখনো অব্দি অবশ্যই জানত) লক্ষ্ণৌ-বেনারসে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঈজীদের মহল্লা। সময় শুধু স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দেয় না, লঘু করে তোলে গভীরতা। নাহলে জ্ঞান, নৈপুণ্য, শিক্ষা, তালিম, নিষ্ঠা সমস্ত কিছু নিংড়ে যে অসামান্য শিল্পীদের নির্মাণ করা হতো অভিজাত হাভেলি গুলিতে, তাদের পরিচয় ধীরে 'তবায়েফ', আরও হীনতায় 'দেহপসারিণী' হয়ে যাবে কেন? শৈবলিনীর সঙ্গে তারা দুইজন ঘুরে বেড়াতো ভোরের আলো ঠিকঠাক ফুটে ওঠার আগে। একমাত্র এইসময়েই এই এলাকা নিস্তব্ধ থাকে। বাসিন্দারা হয় নিদ্রিত নাহয় ঘাটে। শৈবলিনী কথা বলতেন বৃদ্ধা কাউকে পেলে, আনমনে সিঁড়িতে বসা, অতীতের ফুলকারিটি গায়ে জড়িয়ে। জানতে চাইতেন ইতিহাস। বাড়ি ফিরে স্তব্ধ হয়ে থাকতেন। সন্ধ্যায় গঙ্গারতি দেখতে দেখতে উদাস হয়ে যেতেন। পরে, বহু পরে স্বধাকে বলেছিলেন-


--" আগুনের দুর্ভাগ্য অসীম না ভাই যদি ভাগ্য মানি? যত তীব্র তত উজ্জ্বলতা। যারা জ্বালায় কেউ জ্বলে না। কেউ উত্তাপ নেয়, কেউ আলো, কেউ পবিত্র হয়, কেউ শুদ্ধ, কেউ মুক্তি নেয়, কেউ শান্তি। সরে যায়। আগুন নিজে কী পায়, কাকে পায় বলতে পারো? আগুন একা, শুরু থেকে শেষ। তবু যদি তার স্বাধীনতা টুকুও থাকত। সে কি নিজের ইচ্ছেয় জ্বলে? কেউ দাবী তোলে শিখায় আদরের আঙ্গুল রেখে, অস্বীকার করো দাহ্যকে? আগুনের কি ব্যথা নেই? ভাই, বড়ো মিল, বড়ো মিল, প্রতিটি নারীই কি আগুনপাখি?"


গতরাতে দাবানলের খবর পেয়ে পৌঁছানো স্বধার অযোধ্যার দিকে তাকিয়ে খেয়াল হলো, তার কখনো তমাল দেখা হয়নি। এতো এতো অরণ্যে ঘুরেছে সে, এই মুহূর্তেও তো হাঁটছেই, তবুও হয়নি কখনো। অথবা এও হতে পারে, চেনেনা বলে অধরা রয়ে গেছে। শৈবলিনী বলতেন সপ্তপর্ণার কথা। তাও দেখা হয়নি। আবারও হাসতে ইচ্ছে হলো তার। বহু আগে লিখেছিলো- পালক খেললে ময়ূর তুমি, কৃষ্ণ জানলে না। তার শুধু খুঁজে বেড়ানোই হলো। জল কি কখনো ভেজে?


স্বধা গবেষণার জন্য প্রথম বেছেছিলো একটি অদ্ভুত বিষয়- 'ধর্মরূপ ও উত্তরসত্য' । যেভাবে একটি নদীখাতের উৎস থেকে মোহনা অবধি উপ আর শাখাতে বিভাজিত ও যুক্ত হতে হতে অস্তিত্বহীন হয়ে ওঠে মূলধারাটি, তেমনই তো যে কোনো মিথ, মিথ্যের সিনোনিম। কিন্তু বিশ্বাসকে ডিগ্রিতে রূপান্তরিত করতে যে তথ্য ও যুক্তির নিপুণ কৌশল লাগে, তা করায়ত্ত না হওয়ায় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে অন্বেষণ। একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া যাক? কীভাবে সে উপড়ে দেবে কোটি কোটি চার্চ থেকে অদ্ভুত সুদর্শন ক্রাইস্টের রেপ্লিকা? মুভমেন্ট করবে? রক্তে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাসের কী হবে? আরবীতে যে স্থানের নাম 'মাংসের বাড়ি', হিব্রুতে 'রুটির ঘর', সেই বেথলেহেম শহরের ভৌগোলিক অবস্থান বিচার করলে কী দাঁড়ায়? ভূ-মধ্যসাগরীয় উপকূল- ইজরায়েল- ঈজিপ্ট- জর্ডন-  এই তো? ন্যূনতম চিন্তা করলে যে কোনো মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা এই অঞ্চলে জন্মানো কারোর সোনালি চুল হয় না, বরফশুভ্র ত্বকও নয়। সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ক্লিওপেট্রাও তা ছিলেন না। অথচ, ক্রাইস্টকে স্মরণ করলেই যে আদল মাথায় ভেসে আসে সে পেন্টিং আর ভাস্কর্যের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ মডেল। স্বধারও তাই ই আসে। কেন অস্বীকার করবে? সত্য সম্ভবত তা নয়। জন্ম, নাসা, কাঁটা, ক্রুশ সমস্ত কিছুই এক মানবসন্তানকে অলৌকিক করে তোলার অনুপান মাত্র। 


মানুষ তার শরীরে মানুষ খোঁজে, মাথা নিচু করতে আর হৃদয়ে বসাতে চায় অতিমানুষ। "ম্যান" তার কাছে প্রশংসার শব্দ, ফ্যান্টাসিতে রাজ করে সুপারম্যান'ই। স্বধা অপেক্ষা করে থাকত কখন অরণ্যদেব মুখোশ খুলে নার্দার সঙ্গে দেখা করবে, ব্যাটম্যান কখন ক্যাটউমেনকে ভেবে মুখ গুঁজবে জাল ছিঁড়ে। উলটে যেতো পরপর পাতা। তার ভীষণ মনে হতো এই সব চরিত্র আসলে নিখুঁত উদাহরণ মানুষ আর ঈশ্বরের শতরঞ্জের। মায়ামুখোশ টুকুই আড়াল মাঝের ঝিল্লির। কখনো কখনো স্ট্রিপ শেষ হয়ে যেতো, পর্দাটা উঠতো না। প্রতিটা যাপন সম্ভবত এই উৎকণ্ঠার নাম। বিরাট হাঙর। ধরতেই হবে। জয় আসে। অথচ উপভোগ্য স্তর পাড়ে টেনে আনতে আনতে সে কঙ্কাল। "রাইডারস টু দ্যা সি"- এর মতো করে জীবন চেনাতে কেই ই বা পারলো আর। স্বধা কিছুটা পার্সোন্যালাইজড করে নিয়েছে এর ব্যাখ্যা। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা- নারী মাত্রেই জানে লিঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের বানান ঠিক কী। পূর্বরাগে প্রেমিকেরা উত্তাল, কেন না মায়াঅন্ধত্বে তাদের ভিতর বসত গড়ে ঈশ্বরসত্ত্বা, শোনপুর মেলার বিক্রির আগের চোখ সেলাই করা বাজপাখি। সময় পেরোলে হাতে থাকে শুধু করোটির পানপাত্রটি। আজ প্রচন্ড হাসি আসছে স্বধার, প্রেতের হাসি-

-- শৈবলিনী, সত্য তুমিই ছিলে। আগুনের ব্যথা হতে নেই। জলের ভিজতে নেই। যে ঈশ্বরীয় রূপ মানুষের ফ্যান্টাসি, তার মুখোশও নামিয়ে নিতে নেই।

ঘোর আঁধারে কোথাও তক্ষক ডাকছে। স্বধা চিনতে পারে যেমত সে সর্পযোনি। আজ নগ্নিকা তার এই অরণ্যে চন্দ্রপানের তিথি, ইস্তার জন্মের দায়...

ছবি- অন্তর্জাল

৬টি মন্তব্য:

  1. একটা একটা করে কিস্তি এগোচ্ছে, লেখা মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে, এই গদ্যের শব্দেরা শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে, আর গদ্যের যে ঘোর, তা ধূপের গন্ধের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে আনাচে কানাচে।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার গদ্য সত্যিই অন্যরকম। এ যেন কোন কবিতার ঘোর, আচ্ছন্ন করে রাখছে কী এক মাদকতায়!

    উত্তরমুছুন
  3. আমি সত্যিই অনেকদিন বাঁচবো একটা ঘোরের মধ্যে।

    উত্তরমুছুন
  4. স্তব্ধ করে দেন আপনি, কোনো এক ঘোরের মাঝে ভেসে যাই...

    উত্তরমুছুন