শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ঋতুপর্ণা রুদ্র

চেনা অচেনা

দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে ঢুকে শম্পা দেখল চোখের সামনে দিয়ে  লোকাল টা বেরিয়ে গেল। এই সময় টা বড় অসহায় লাগে, এখন বসে থাকো পরের ট্রেনের জন্য। শাশুড়ির একটা কবিরাজি ওষুধ আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল, সেই বড়বাজারে কবিরাজের চেম্বার,  অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়েও সময় মত ট্রেন ধরা গেল না। আজ আবার মেয়ের ক্যারাটে ক্লাস থাকে, কে নিয়ে যাবে যদি শ্বশুর মশাই নিয়ে যান। বসে বসে শম্পা একটু ঝালমুড়ি কিনে খায়, আজ টিফিনে বিশেষ কিছু খাওয়া হয় নি। মেয়ের অবশ্য তের বছর হোলো, একাই যেতে পারে বাড়ির কাছেই ক্লাস তবুও ওর ঠাম্মা কিছুতেই একা ছাড়তে চান না,  দিন কাল বড়ই খারাপ, ট্রেন আসতে এখোনও প্রায় দশ মিনিট বাকি,  আগে এরকম সময় নীল কে ফোন করত শম্পা কিন্তু এখন আর করে না।  কেবলই কথা শুনতে হোতো সে নাকি কেবল নিজের সময়।মতই ফোন করে তাই আজ চুপ করে কেবল ভাবে, নীলের কথাই মনে পড়তে থাকে।
শম্পার বিয়ে হয়েছিলো বছর পনেরো আগে, রজত তার থেকে বছর দুএকের বড় দিব্বি স্বাস্থ্য খুব হাসিখুশী মানুষ ছিল, শম্পা তখন সবে সরকারি চাকরি তে ঢুকেছে। বিয়ের পর প্রথম দেড় বছর খুব ভাল ছিল শম্পা,
  শাশুড়ি ও শম্পাকে তখন খুব আদর করতেন,  দেড় বছরের মাথায় পেটে এল তিন্নি,  দু বাড়িতেই খুশীর বান ডেকেছিল। তারপর একদিন, বাড়িতে সেদিন প্রচুর লোক সমাগম, রজত সকাল থেকে দোকান বাজার কাজ সারতে গিয়ে জলখাবার খায় নি,  চা আর সিগারেটের ওপরেই ছিল, বেলার দিকে ভাত খেয়ে শম্পাকে বলল এত বেলায় ভাত খেয়ে শরীরটা ভাল লাগছেনা, শম্পা একটু জোয়ানের আরক দিল।  কলকাতা থেকে ছোটো পিসি এসেছিল তাদের ট্রেনে তুলতে বেরিয়ে গেল রজত,  শম্পারও তখন ভারি মাস খুব ক্লান্ত লাগছিল বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল,  রজত ফিরে এসে বলল একটু চা খাওয়াবে? সেটাই শেষ কথা তারপর হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ে গেল,  বাড়িশুদ্ধ লোক ছুটে এসে ডাক্তার ডাকার আগেই সব শেষ।
শম্পা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেছিল, কি ঘটছিলো চারপাশে কিছুই বুঝতে পারছিল না। রজত, তার স্বামী আর নেই! তার সন্তান কোনদিন বাবাকে দেখতে পাবে না, রজত আর কখনো ভালবাসবে না,  আদর করবে না তাকে এ কি সত্যি না কোন দু:স্বপ্ন। কিন্তু সত্যিটাকে মানতেই হোল। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে, রক্তচাপ বেড়ে শেষ কয়েক মাস ডাক্তার বেডরেস্ট বলেছিলেন। প্রচন্ড মোটা হয়ে গিয়েছিল ,কিছু ভাল লাগত না, তিন্নি হবার পরে আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। তারপর কেটেও গেছে প্রায় তের বছর।  রজত চলে যাবার পরে শ্বশুর শাশুড়ি ও খুব ভেঙে পড়েছিলেন, মা এর মনে কি জানি কেন শম্পার ওপর একটা চাপা রাগ, সেই যেন দায়ী। তিন্নি হবার আগে অসুস্থ শম্পাকে দেখতে এসেছে মাসি শাশুড়ি,  খাটে শুয়ে স্পষ্ট শোনে সে মা বলছেন এই অপয়া বৌ এসে জলজ্যান্ত ছেলে টাকে খেল। খুব কষ্ট হলেও শম্পা কখনো ঝগড়া করেনি, একমাত্র সন্তান হারা মা কে, ক্ষমা করে দিয়েছে। ছোটোবেলায় মাতৃহারা শম্পার বাবা থাকেন বেনারসে ভাইপোর কাছে। বেশিরভাগ সময়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান,  সাধুসঙ্গ করেন, তাই দুদিন কোথাও গিয়ে জুড়োনোর জায়গাও শম্পার নেই। ট্রেন এসে গেছে, লেডিস এও খুব ভিড়, দাঁড়িয়ে কোনমতে যেতে হবে। শম্পা পা বাড়ায়।
পর্ব ২
শম্পার জীবনে নীলের আগমন বছর দুএক আগে। ফেসবুকে হঠাৎ একটা মেসেজ,  সে কেমন আছে,  আবৃত্তি করে কিনা এখনো,  এরকম দু এক টা লাইন। শম্পা ভাল ভাবে দেখে প্রোফাইল টা, বেশ ভাল ভদ্রলোকের মতই চেহারা, বৌ আর ছেলের ছবিও  বর্তমান কিন্তু একদমই চিনতে পারল না সে। তবুও উত্তর দিল। উত্তর আবার এল অবিলম্বে। একই কোচিং ক্লাসে পড়ত তারা যদিও শম্পার কিছু মনে পড়ে না,  কিন্তু অল্পদিনে ফেসবুকে চমৎকার একটা বন্ধুত্ব্ব তৈরি হোল। সারাদিনে অন্তত একবার সব কথা গল্প না করলে যেন ভাল লাগত না। কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে গল্প গুলো পালটে যাচ্ছিল। প্রেমের কবিতা বিনিময়,  একদিন কথা না বললে অভিমানের সুর,  শম্পার নিজের মধ্যেও চাপা কষ্ট,  সারাদিন মাথায় শুধু নীলেরই চিন্তা, নিজেকে অচেনা ঠেকছিল। তারপর একদিন দেখা করল তারা শম্পার সেই প্রথম দেখা, গল্প হোল খাওয়া ও হোল কিছু, দুজনেই যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। এত ভালবাসা শম্পা রজতকে বেসেছিল কী? নিজের কাজ সংসার সব সামলে শম্পার নিজস্ব সময় বড় কম,  কিন্ত সবেতেই যেন ফাঁক পড়ে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ এই নবলব্ধ ভালবাসা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত তার সাথে ছিল একটা অপরাধবোধ। তারা কি ঠিক করছে? এটা কি অন্যায়?  নীল জোর দিয়ে বলে না অন্যায় নয়। ভালবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। কিন্তু মন থেকে এটা সরাতে পারে না সে। রজত না হয় আকাশের তারা হয়ে গেছে কিন্তু নীলের স্ত্রী স্বাতী?  তার প্রতি কি অন্যায় হচ্ছেনা কোনো? স্বাতী আর নীলের সম্পর্ক আসলে বহুদিন ধরেই নাকি ঠান্ডা বরফ। কোন রকম উত্তাপ সেখানে আর নেই, মাসে দু একবার বাঁধাধরা শারীরিক  সম্পর্ক ছাড়া। ছেলের জন্যই হয়তো দুজনে এখনো একসাথে আছে, নীলের কোন খেয়ালই স্বাতী আর রাখে না,  সে কি খেলো কোথায় গেল তাতে স্বাতী র কিছু আসে যায় না। নিজের বাপের বাড়ির লোকেদের নিয়ে সে বেশি ব্যাস্ত।
বাড়ি ঢুকে শম্পা দেখল মেয়ে তার দাদুর সাথে ক্যারাটে শিখতে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যায় সে। শাশুড়ি দিনের বেলা সামলালেও রাতে টিভির সামনে থেকে নড়বেন না। প্রথমে চা বানায় শম্পা, সবাইকে দিয়ে নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে আটা মাখে। রাত্তিরে চিকেন করবে আর রুটি। ওবেলার তরকারী আছে। রান্নার লোক রাখার কথা শম্পা অনেকবার তো বলেছে কিন্তু কেউ রাজি নয়। বাড়ির খরচ প্রায় পুরোটাই শম্পার ওপর, মাইনে খারাপ পায় না সে কিন্তু জমাতে পারে না তেমন, শ্বশুর মশাই বেসরকারি চাকরি করতেন পেনশন এর সুবিধে নেই,  নিজেদের হাতখরচ,  ডাক্তার ওষুধ, বাড়ির ট্যাক্স বা সারানো এসব অবশ্য ওনারাই চালান শম্পাকে দিতে হয় না কিন্তু খাওয়া খরচ ও বাকি সব শম্পার দায়িত্ব। -চিলি চিকেন করবে আজকে, তিন্নি খুব ভালবাসে।  
রাতে শুয়ে একটু বই পড়ে শম্পা,
  তিন্নি এগারোটা অবধি দিদার সাথে কখোনো টিভি দেখে কখোনো মাএর সাথে গল্প করে তারপর ঘুমোয়,  শম্পা বারোটা পর্যন্ত জাগেই, আগে এই সময়টাতে নীলের সংগে কথা হোত এখন আর শম্পা ফোনে নেট অন করে না। 
কি জানি শম্পার কপালটাই এত খারাপ কেন,  যাকে এত ভালবাসল সে কিছুতে কেন ওকে একটুও বুঝল না। মাস কয়েক আগে শম্পা নীলের সাথে একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিল,  সেখানেই মাসতুতো ননদ আর তার মেয়ে তাদের দেখেছিল, ওরা থাকে কলকাতায়,  শম্পা আর নীলের হাত ধরে হলে ঢোকা আর ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে সিনেমা দেখা কিছুই বোধহয় ওদের নজর এড়ায় নি।  বাড়ি ফিরে শম্পা যেন ঝড়ের মুখোমুখি হোল, শ্বশুর শাশুড়ি এমনকি তিন্নিও তার কাজে স্তম্ভিত।  তিন্নি যদিও কারুর সামনে কিছু বলেনি কিন্তু তার কান্না থামানো মুশকিল হয়েছিল শম্পার। এর কিছু দিন আগে থেকেই শম্পার চালচলনে একটা পরিবর্তন নজরে এসেছিল সবারই। সবসময়ে মোবাইল নিয়ে বসে থাকা, অফিস থেকে ফিরতে দেরি,  সাজগোজেও কিছু পারিপাট্য এসে থাকবে, এসবই বাড়িতে একটু সন্দেহর বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছিল। সেদিন আবার ফিরে শম্পা একটা মিথ্যে কথা বলে তারপরই বোঝে যে সবটাই সবাই জেনে গেছে।
পর্ব ৩
রাতে চিলি চিকেন আর রুটি সবাই বেশ উপভোগ করে খেল। অথচ এই কদিন আগেই শ্বশুর মশাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন বলেছিলেন। প্রথমে খানিকক্ষণ অস্বীকার করলেও পরে শম্পা স্বীকার করে নিয়েছিল যে হ্যাঁ সে নীলকে বিয়ে করতে চায়। শুনে শ্বশুর শাশুড়ি প্রায় ভিরমি খান,  গালাগালি,  পুলিশে যাবার হুমকি,  তিন্নিকে সে আর পাবে না,  কিছুদিন বাদে নীল তাকে ছেড়ে পালাবে, কি না শুনতে হয়েছে তাকে। তিন্নির তখন পরীক্ষা, মেয়ে আর কিছুতেই পড়তে পারে না। শম্পা র জীবনে যেন কি খারাপ সময় একটা, একদিকে অফিস, সমস্ত কাজ,  প্রতিদিনের ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা,  নিজের মনের উথাল পাথাল,  তিন্নি,  এত অশান্তি আর যেন বইতে পারছিল না। আর আশ্চর্য ব্যাপার নীল কেও একদম পাশে পেল না সে। এই ঝামেলার পরে শম্পা প্রথমে ভেবেছিল এই সম্পর্ক ভেঙে দেবে সে কিন্তু পেরে উঠল না,  নীল কে তখন বোঝাতে গেল, যে যদি যোগাযোগ রাখতেই হয় তবে খুবই সাবধানে সেটা করতে হবে। নীল কোন ফোন করতে পারবে না শম্পাকে,  বাড়িতে সবাই সন্দেহ করছে। সময় সুযোগ মতো শম্পাই বরং করে নেবে,  দেখা করাও খুব কমিয়ে দিতে হবে, মাসে একবারও হয় কি না হয়। নীল কিন্তু বুঝতে চাইলো না। তার মনে হোলো শম্পা প্রচন্ড স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের কথাই ভাবছে। নীলের কথা একবারও ভাবছে না। নীল শম্পা কে সপ্তাহে দুদিন না দেখে থাকতে পারবে না,  ইচ্ছে হলে ফোন ও করবে।
শম্পা কি করবে ভেবে পায় না। সপ্তাহে দুদিনই বা কি,  রোজ দেখা হলে তার নিজেরই কত ভালো লাগে কিন্তু বাস্তব কে তো মানিয়ে নিতে হবে।  তাকে তো থাকতে হবে শ্বশুর শাশুড়ি কে মানিয়ে নিয়ে,  তিন্নির কথাও তো ভাবতে হবে, সে তো মা। আজকাল দেখা হলে বা ফোনে কেবলই ঝগড়া হয়,  শম্পার ক্লান্ত লাগে।  একটু গল্প একটু হাসি আনন্দ, বন্ধুতা ভালোবাসা এর জন্যই তো এত কষ্ট করে আসা,  তার বদলে যদি তিক্ততা হয় তবে কিসের জন্য কি।
প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত। নীল অনেক শান্ত হয়েছে এখন, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে শম্পার, অনেক ভাবল ও,  দুটো ঘর , দুটো বাচ্চার ভবিষ্যৎ  সব কিছুই নিয়েই ভেবেছে সে। আর এই দুজন বুড়ো বুড়ি,  তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়েই তো বেঁচে আছেন তারা।  আজ তাই নীলের সাথে শেষ দেখা।  নীলের চোখে জল,  একটা ফুল দিলো ও শম্পাকে। শম্পা ওর প্রিয় খাবার বানিয়ে এনেছিল সেটাই দিল। তারপর উঠে পড়ল, মায়া বাড়িয়ে লাভ কি, শম্পার দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু ওকে ফিরতেই হবে তিন্নির কাছে বাবা মা এর কাছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন