শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শর্মিষ্ঠা দত্ত


পরম্পরা 
__________



অম্বালিকা ছিলেন আমার ঠাম্মার ছোটবোন ; ছোটবেলায় তাঁকে কয়েকবার আমাদের বাড়িতে আসতে দেখেছি l প্রবাস থেকে দু-তিন বছর অন্তর কলকাতায় এলে একবেলার জন্য কখনও কখনও নিজের দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন l ফর্সা ধবধবে রং আর খয়েরি  ববকাট  চুলে তাঁকে মেমসাহেব বলে মনে হত আমার ...কথার মধ্যে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন l এন্টালির ওই এঁদো গলির মধ্যে  শ্যাওলাধরা উঠোনের ধারে রংচটা ,প্লাস্টার খসে যাওয়া  তিন কামরার  বাড়িটাতে নেহাতই বেমানান ছিলেন তিনি ; অবশ্য তিনি বলতেনও সেকথা ...কলকাতায় বিশেষ করে আমাদের  বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকলে নাকি তাঁর দমবন্ধ হয়ে আসে ; তাই কোনমতে একটি বেলা দিদির জন্য বরাদ্দ ছিল তাঁর l   তাঁর স্বামীকে আমরা কোনদিন দেখিনি ...তিনি কখনোই আসতেন না এ বাড়িতে l শুধু শুনেছিলাম তিনি নাকি এক মাল্টিন্যাশনাল  কম্পানির মস্ত অফিসার l  স্বামীর কর্মস্থল বম্বেতেই পাকাপাকিভাবে বসবাস করতেন তাঁরা ...কালেভদ্রে কলকাতায় এলে থাকতেন নিউ আলিপুরের শ্বশুরবাড়িতে l 

আমার ঠাম্মা অম্বিকা  ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে গ্রাম্য  মহিলা ; বোনের মত রূপের জোর ছিল না তাঁর , তাই বিয়েও হয়েছিল এক সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ... আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন রাজ্য সরকারী অফিসের একজন  নিম্নপদস্থ কেরানি l আমার  বাবা-কাকারাও খুব সাধারণ চাকরি করতেন ...স্কুলে মাস্টারি আর  রেলের গার্ড l  দীর্ঘদিন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় বসবাস করলেও ঠাম্মা  শহুরে  ভাষা ও আচরণ রপ্ত করে উঠতে পারেননি আজীবন l বড়ি -কাসুন্দি আর কাঁথা সেলাইয়ের ব্যস্ততার ফাঁকে নাতি-নাতনিদের জন্য ছিল অফুরন্ত গল্পের স্টক l রান্না করতে খুব ভালবাসতেন  ঠাম্মা ; লোকজনকে খাওয়াতেও...  খুব সীমিত সাধারণ উপকরণ দিয়েও  রেঁধে ফেলতে পারতেন  জিভে জল আনা অপূর্ব স্বাদের নানারকম পদ ...বাড়িতে কেউ এলে তাকে না খাইয়ে ছাড়তেন না ঠাম্মা l আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন মহলে ঠাম্মার হাতের রান্নার ভূয়সী  প্রশংসা শুনতাম  l 

অম্বালিকা  আমাদের বাড়িতে একাই আসতেন ট্যাক্সিতে l আমরা ভিড় করে বসে শুনতাম বম্বেতে  তাঁর স্বচ্ছল-সাজানো সংসার আর পরীর মত রূপবতী মেয়ে রানীপিসির গল্প ; আমার তখন বড়জোর বছর চারেক বয়েস ...মনের মধ্যে রূপকথার মত আঁকা হয়ে গিয়েছিল ছোটঠাম্মার রাজপ্রাসাদ আর রাজকন্যার ছবি l রানীপিসির তখন সদ্য  বিয়ে হয়েছিল একটি গুজরাটি ব্যবসায়ী  পরিবারে ...স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন  তিনি ...সেখানে রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছিল তাঁদের  l  আমাদের তিনকূলে আর কেউ কোনদিন বিদেশে যায়নি ...তাই রানীপিসির অস্তিত্বটা আমার কাছে রূপকথার মতই অলীক ছিল l 

বছর দুয়েক বাদে  সেই রানীপিসি একবার কলকাতায় এলেন ...আমি তখন ক্লাস টুতে পড়ি l নিউ আলিপুর থেকে একটা সাদা রাজহাঁসের মত সেডান গাড়িতে একদিন বিকেলে মায়ের সঙ্গে  রানীপিসি এলেন তাঁর  একমাত্র মাসির সঙ্গে দেখা করতে ...সেই কোন ছোটবেলায় মাসিকে দেখেছিলেন ; এত বছর বাদে কলকাতায় এসেও মাসির সঙ্গে দেখা করবেন না ...তাও কি হয় ! আমাদের  গলিতে এর আগে ট্যাক্সি ছাড়া আর কোনো গাড়ি ঢোকেনি ;  এই প্রথম এত বড় একটা গাড়িতে  খাস বিলেত থেকে  মেমসাহেব আসছে  আমাদের বাড়ি ...সবাই উত্তেজনায় টানটান l সবাই ভেবেছিল গাউন অথবা অন্য কোনো বিদেশী পোষাক পরা কোনো অহংকারী  মেমসাহেব আসবে বুঝি ...কিণ্তু দেখা গেল পরীর মত ফুটফুটে চাঁদের জ্যোত্স্নামাখা শরীরে সাধারণ সিল্কের শাড়ী পরা একমুখ মিষ্টি হাসি নিয়ে এক অপরূপা লাবণ্যময়ী  নেমে এল  গাড়ি থেকে ; মা-কাকিমা অনায়াসে মিশে গেল তার সঙ্গে ...আমরাও l  অচেনা বোনঝিকে পেয়ে ঠাম্মা খুশিতে আত্মহারা ...বুকে জড়িয়ে ধরে  কত যে আদর আর আশীর্বাদ করলেন ... কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বেন না তাঁকে l সারাদিন ধরে কতকিছু যে রান্না করেছিলেন সেদিন ! ...অম্বালিকা  তো দেখেই আঁতকে উঠলেন , "কি করেছিস দিদি ... রানী কি এসব খায় ! ...দেখছিস না ওর চেহারা ....ও স্ট্রিক্ট ডায়েট মেনটেইন করে , সব বিদেশী খাবার খায় ..."
ঠাম্মার মুখের আলোটা নিভে যাওয়ার আগেই রানীপিসি বলে উঠল ,"মাসি , আমি কিণ্তু সব টেস্ট করব...তোমার রান্না  আগে কখনও খাইনি l "

সব খাবারগুলো শুধু চেটেপুটে খাওয়াই নয় ; এরপর যে কদিন কলকাতায় ছিল প্রতিদিন এসে ঠাম্মার কাছে রান্না শিখত রানীপিসি l খাতা বোঝাই করে লিখে নিয়েছিল ঠাম্মার সিগনেচার রেসিপি l আমাদের সকলের  জন্য বিদেশ থেকে  কতরকম  যে  গিফট এনেছিল রানীপিসি ; খুব সংকুচিত হয়ে কাকিমা  একটা লাল রঙের জামদানি দিয়েছিল ;  আর মা  একজোড়া কানের দুল ... পরের দিনই সেসব  পরে এসেছিল আমাদের বাড়ি...ঠিক  দুর্গা ঠাকুরের মত লাগছিল রানীপিসিকে l রানীপিসি এলেই আমাদের বিবর্ণ বাড়িটা যেন রঙিন হয়ে উঠত নিমেষে ...গানে- গল্পে -খুশিতে l অম্বালিকার মেয়ে হিসেবে রানীপিসিকে কিছুতেই মেলাতে পারিনি আমরা l  সেই অবশ্য একবারই তার  কলকাতায় আসা l আমাদের বাড়িতে তখন  টেলিফোনও ছিল না ,তাই  দু-চার বার চিঠি লেখা আর  পাশের বাড়িতে টেলিফোন করলেও যোগাযোগটা শেষ পর্যন্ত  বন্ধই হয়ে গিয়েছিল রানীপিসির সঙ্গে  l 

অম্বিকা মারা গিয়েছেন প্রায় বাইশ  বছর হলো ...অম্বালিকাও বোধহয় তার কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ...তাঁর পরিবারের সঙ্গে ক্ষীণ বন্ধনটাও বিচ্ছিন্ন এখন l রানীপিসিদের কোনো খবরই জানি না আমরা l এন্টালির সেই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে আমরাও গড়িয়ার কাছে বাড়ি করে উঠে এসেছি প্রায় ষোল বছর আগে ...বাবা বেঁচে থাকতেই বাড়িটা কমপ্লিট করে গিয়েছিলেন ...আমি আর মা থাকি এখন , মাকে ছেড়ে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারি না l যদিও এ নিয়ে কাকা- কাকিমা বা মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত  নেই l  কাকাও  নিজের বাড়ি করে নিয়েছেন আমাদের একেবারে পাশেই...খুড়তুতো বোনের বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতেই ; খুড়তুতো  ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দুর্গাপুরে l  রোজই কাকা-কাকিমা নিয়ম করে আসে এ বাড়িতে ...আমি না পারলেও মা যায় ও বাড়িতে l 

আজকাল  টেলিভিশনে একটা রান্নার শো বেশ জনপ্রিয় হয়েছে , মা এই শোয়ের নিয়মিত দর্শক l বিকেলবেলা টেলিকাস্টের সময় আমি অফিসে থাকি ; তাই কোনদিনই দেখিনি অনুষ্ঠানটা l কাল রাতে খেতে বসে  মা বলল ,"আগামীকাল একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি বুবুল ...রান্নার শোয়ের কালকের এপিসোডটা তোকে দেখতেই হবে ...আজ প্রোমো দেখিয়েছে ..." বলেই হঠাতই চুপ করে গেল l  আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম ...কস্মিনকালেও আমার রান্নাবান্নায় কোনো উত্সাহ নেই ...মাও কখনও আমায় অনুষ্ঠানটা দেখতে বলেনি ; বেশ কৌতুহল হলো , "কেন বল তো ?" মা আলতো হেসে বলল ,"সারপ্রাইজ থাক ...এখন বলব না ..."

আজ লাঞ্চের ঘন্টাখানেক পরেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম l প্রবল কৌতুহল মনে l বাড়িতে এসে ওপরে  নিজের ঘরে একটু রেস্ট নিচ্ছি ...মা ডাকল "বুবুল নীচে আয় ...এবার শুরু হবে ..." নীচে এসে দেখি কাকা-কাকিমাও এসে বসে রয়েছে l 

শো শুরু হতেই দেখলাম ক্যাপশন ..."প্রবাসে দেশি স্বাদ " ...রান্না করতে এসেছেন ইংল্যান্ড-প্রবাসী জনৈক গুজরাটি মহিলা ...রাধিকা যোশি l  মহিলা না বলে মেয়েই বলা ভাল ; বড়জোর কুড়ি-একুশ  বছর বয়েস ...মুখের আদলটা বেশ চেনা চেনা l যে পদটি রান্না করবে সেটি বাংলার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় রান্না , সে  শিখেছে তার মায়ের কাছে l রান্নার সঙ্গে সঙ্গে তার নেপথ্যের কিছু গল্পও চলতে থাকল টুকটাক l মাকে জিজ্ঞেস করলাম ,"মা , ঠিক এই রকম একটা নারকেলের পুর-ভরা পটলের দোলমা ঠাম্মা রান্না করত না ? " কাকিমা বললো ,"ঠিক বলেছিস বুবুল , আমিও তো মায়ের কাছেই এই রান্নাটা শিখেছিলাম ...এটা মায়ের নিজস্ব রান্না ..." মা একটু হাসল , "চুপ করে দেখ না , কি বলে ..." মেয়েটি  ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে যাচ্ছে ...তার মা বাঙালি ; এই অসাধারণ রেসিপিটি মা  শিখেছিলেন তাঁর মাসির কাছে ...সেই মাসি নাকি রান্নাকে  শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন , কিণ্তু কোনদিন কোনো প্রচারই পাননি  l মাসির কাছে শেখা  মায়ের আস্ত একটি রেসিপির খাতা এখনও তাঁর  কাছে যত্ন করে রাখা আছে ...তার সবকটিই মাউথ-ওয়াটারিং রেসিপি  এবং এই রান্নাগুলোর জন্য  তিনি বিদেশীদের কাছেও  অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন l লন্ডনে তাদের পরিবারিক  রেস্তোরাঁয় এই খাবারগুলোর এখন  প্রচন্ড  চাহিদা ... বলতে গেলে এই সিগনেচার রেসিপিগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তাদের ব্যবসা ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠেছে l সেই গ্র্যানির কাছে সে  ও তার পরিবার এখনও কৃতজ্ঞ l মায়ের সঙ্গে তাঁর মাসির তেইশ  বছর  আগের  একটি রঙিন   ফটোগ্রাফ এখনও সযত্নে রাখা আছে তার কাছে...সে সেটা নিয়েও এসেছে  সঙ্গে l সঞ্চালিকা ছবিটি তুলে ধরলেন ...ক্যামেরা জুম হলো ...রানীপিসি আর আমার  ঠাম্মা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে ; মাসি-বোনঝি দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি l মেয়েটি বলে চলেছে ...যদি ওই গ্র্যানির  পরিবারের কেউ শো টা দেখেন  ,তাহলে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন  ...তার  মা এখন  খুবই অসুস্থ এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য  উত্সুক...  টিভি চ্যানেলে তার ফোন নম্বর দেওয়া রইল l 

রানীপিসির বিদেশী ক্যামেরায় আমিই সেদিন তুলে দিয়েছিলাম এই ফটোটা l এই ফটোটা ছাড়াও আমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে তোলা  আরো একগুচ্ছ ফটো রানীপিসি পাঠিয়েছিল বিদেশ থেকে ...মায়ের  অ্যালবামে এখনও সেগুলো  সযত্নে সাজানো ....তাকিয়ে দেখলাম আমার সঙ্গে সঙ্গে মা-কাকিমার চোখও জলে ভরে উঠেছে l অনুষ্ঠান শেষে চ্যানেলের ফোন নম্বরটা স্ক্রিন থেকে সেভ করলাম ...এবার ফোন করে রাধিকার নম্বরটা নিতে হবে ...রানীপিসি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য l

প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন