শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শৌনক দত্ত

মন চায় মন চায় না 




বাইরে বৃষ্টি অঝোর ধারায় ঝরছে।এমন সময় অবসর ঠেলে ঘিরে আসে একরাশ স্মৃতি,অব্যক্ত অনেক কথা যা কখনো বলা হয়না।বৃষ্টিদিনের অলসতার এই এক ধারা বুঝি সবার থাকে।প্রতিটি মানুষের মাঝে যে মানুষের বাস সে এমন ধারা বৃষ্টির দিনে কখন বেরিয়ে আসে তা ঐ রক্তমাংসের মানুষটি বুঝতে পারেনা আর পারেনা বলেই হয়ত বৃষ্টির মতো ঝরে যায় মেঘ থেকে পৃথিবীর বুকে। 
মানিয়া... 
মানিয়া সাধারন মানুষগুলোর চেয়ে আলাদা।পেশায় শিক্ষক হলেও কোমল এই নারীর ভেতর কঠিন এক মানবীর বাস।ছাত্র রাজনীতি কিংবা ছোট্টবেলা থেকে বড় হবার সময় পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার পাশে আবেগ বলে কিছু ছিলো না সেই কারণেই কিনা কে জানে মানিয়া আর পাঁচ দশটা মানুষের চেয়ে একেবারেই আলাদা।তাই বলে এমন ভাবার ও উপায় নেই সে পাথর!সে যেমন ভাল শিক্ষক তেমনি দক্ষ গৃহী।রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার আছে ভীষন দূর্বলতা।তার অবসর যদিও খুব কম তবু কখনো যদি অবসর মিলে যায় মানিয়া সাহিত্যে ডুবে যায়,গান শোনে।তার লেখার হাতটি শ্লোগানের সাথে আকাশের দিকে তোলা হাতের মতই বিপ্লবী,আস্থাশীল ও স্বপ্নময়।ছিপছিপে শরীরের মানিয়া শাড়িতে যতটা মমতাময়ী,সালোয়ার কামিজে ততটাই তন্বী।প্রখর মেধাবী মানিয়া চাইলেই ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য যেকোনে পেশায় নিজেকে দেখতে পেতো কিন্তু অন্যসব পেশাকে কেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিক্ষকতা বেছে নিলো এই প্রশ্নটা আজো তার বন্ধু বা সহপাঠীদের কাছে বড় বিস্ময়।ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতি করা মানিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানও খুব দৃঢ় কিন্তু কোনদিন সে কোন পদ দখল করেনি।সুযোগ যে আসেনি তা কিন্তু নয় দলের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলকর্মীরা বারবার চেয়েছে,চায় সে তার জনপ্রিয়তা,দক্ষতা ও রাজনৈতিক মেধাকে কাজে লাগিয়ে সামনে থাকুক।মানিয়া তা কখনো করেনি।নিভৃতপ্রেমী মানিয়া রাজনীতির মতো ব্যক্তিগত এবং পেশাজীবনেও নিভৃতচারী অথচ খুব জনপ্রিয়! 
বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে।আকাশ এখন আগের চেয়ে বেশ পরিষ্কার।এখন যে ছন্দে বৃষ্টি ঝরছে তা যত না ভাবাতুর করে তার চেয়ে ঢের বেশি করে লোভী,বৃষ্টি মাখতে।একদল পাখি ভেজা পালক থেকে বৃষ্টি ঝেরে উড়ে যায় আবার পালকে বৃষ্টি মেখে দূরে হয়তবা আপন আশ্রয়ে। 
নিনাদ... 
নিনাদ পৃথিবীর আবেগময় মানুষদের একজন।অলস ও আরামপ্রিয়।মেঘের মতো অস্থির কোন কিছুই বেশিদিন ধরে রাখতে সে পারেনি কিংবা পারেনা।ছোট্টবেলা থেকে বাবা মা ছেড়ে বর্ডিং স্কুল কলেজের কঠোরতার ভেতর থাকা মানুষ যে এমন উদভ্রান্ত ছন্নছাড়া হতে পারে তা নিনাদ কে না দেখলে হয়ত বিশ্বাসই হবে না।রাজনীতি তাকে কখনো টানেনি,বোর্ডস্ট্যান্ড করা নিনাদ সবসময় ডুবে থাকে সাহিত্যে।অথচ বিজ্ঞান নিয়ে পড়া নিনাদের সাহিত্য প্রীতি খুব অস্বাভাবিক লাগে অনেকের কাছে।এমন একজন তুখুর মেধাবী কেন কোন চাকরী নিলো না এটা নিয়ে অনেক রকম গুঞ্জন থাকলে ও নিনাদ তা কখনো গায়ে মাখেনা,সে আছে তার খেয়ালে এক মফস্বল জেলা শহরে একান্তে।সব ছেড়ে গেলেও সাহিত্যসৃষ্টি তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি কিংবা সব ছেড়ে দিলেও নিনাদ কখনো সাহিত্য ছাড়তে পারেনি।সাহিত্যে নিনাদ পাহাড় পবর্ত ভেঙ্গেছে তেমন কিন্তু নয় বরং নদীর মতো টিকে আছে!জীবনানন্দ দাশের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরা নিনাদ প্রথাগত সাহিত্যিকদের মতো নয়। 
আপন খেয়ালে চলছে তার সৃষ্টি,রাজহাসের মতো সারা গায়ে জল মেখেও কোথাও সে নেই।নিনাদের পরিচিতির গন্ডি বেশ লম্বাচওড়া হলেও তার উপর কখনো সাহিত্যসম্পাদকের সুনজর পড়তে দেখা যায়নি।সেও তার ব্যক্তিত্বের ঘোরটোপ পেরিয়ে কাউকে কখনো বলেনা।কেউ স্ব তাগিদে লেখা চাইলে নিনাদ তাকে লেখা দেয়।বাজারে গোটাকতক বই থাকলেও নিনাদ সেরকম বহুলপঠিত সাহিত্যিক নয়। 
বৃষ্টি থেমে গেছে।মাছরাঙার মতো বর্ণিল রোদ ঝিলিক দিচ্ছে।বেলা শেষের আকাশে ফুটে উঠেছে রঙধনু।দুধ কফি রঙের মতো জমে থাকা জল পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষ। 

মানিয়া এবং নিনাদ... 

দুইপ্রান্তের দুটি মানুষ মানিয়া ও নিনাদ তাদের মাঝে সেতু গড়ে তোলে কবিতা।একটি বিশেষ দিনের উপর নিনাদের কবিতা পড়ে মানিয়ার আগ্রহ বাড়ে নিনাদের প্রতি।বয়সে কয়েক বছরের ছোট নিনাদের সাথে মানিয়ার সখ্যতা গড়ে তোলে নিনাদের লেখা আর মানিয়ার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করে নিনাদকে।বেশ কতক অমিলের মাঝেও যে এমন বন্ধুত্বতা গড়ে ওঠতে পারে তা হয়ত মানিয়া ও নিনাদ কে দেখলেই বোঝা যায়।পলকের সাথে সময় যায়।বন্ধুত্বতা গাঢ় হয়।নিনাদের বুকের কোণে মানিয়ার মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায় ভালোবাসায়।নিনাদ নিজেকে নিজেই বোঝায় অসম এ ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না তাই এই ভালোবাসা নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখা হবে বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু মন মানবে কেন?মানিয়ার কাছ থেকে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরী করে নিনাদ,এদিকে নিনাদের নিখাদ বন্ধুত্বতা, ম্যাচুরিটি মানিয়ার মনে দাগ কাটে ছেলেদের মাঝে মেয়ে দিয়ে যে ধরনের ভাবনা থাকে মানিয়া তা কখনো নিনাদের মাঝে দেখেনি আর তাই নিনাদকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা মনে হয় মানিয়ার।
নিনাদের কাছে ভালোবাসা আর প্রেমের সংজ্ঞা আলাদা।নিনাদের মনে হয় ভালোবাসা মানে ভালো লাগার সাথে বসবাস আর প্রেম মানে প্রেষিত কাম।এই জায়গা থেকে নিনাদের কখনো কখনো মনে হয় মানিয়া কে ভালোবাসায় কোন পাপ নেই কোন দায়বদ্ধতা কিংবা পাওয়া না পাওয়ার কোন টানাপোড়েন নেই।মানিয়ার ভালো যেসব সেসবের সঙ্গে কাটিয়ে দেয়ার নামই ভালোবাসা।নিনাদের ভেতর মানিয়ার জন্য প্রেম যে একেবারেই কাজ করে না তেমনটি নয় কিন্তু নিনাদ জানে প্রেমের চেয়ে মানিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা অনেক বেশি। 

মানিয়ার ভেতরে যে আরেকটি মানিয়ার বসবাস তাকে মানিয়াই চেনে।বাইরে সে মানিয়া বড় অপরিচিত বড্ড বেমানান।শ্রাবণ শেষের এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে মানিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে সহসা অপরিচিত মানিয়াকে খুঁজে পায় নিনাদ।বৃষ্টির ঘোরে নিনাদ কথার ফাঁকে একসময় বহুবছরের পুরোনো শিলালিপির পাঠ উদ্ধারের আনন্দের মতো অন্য এক মানিয়াকে খুঁজে পেয়ে নিজের অব্যক্ত ভালোবাসা ব্যক্ত করে মানিয়ার কাছে।মানিয়া জানে নিনাদ খুব মজা করতে ভালোবাসে আর তাই প্রথমে শোনার পর তার মনে হয় নিনাদ মজা করছে।সে বিশ্বাস করতে পারেনি নিনাদের মনে তার জন্য এমন পাগলামী থাকতে পারে।নিনাদ মাথা নিচু করে বসে থাকে।তার মনে হয় বাইরের আকাশের মেঘ ভেঙে পড়ার চেয়ে বেশি আওয়াজ তার ভেতরে।সম্পর্কটা কি ভেঙে যাবে?বলাটা কি উচিত হলো মানিয়াকে?এমন হাজারো প্রশ্নের ভেতর কতক্ষণ নিজের সাথে নিনাদের কথোপকথন হয়েছে নিনাদ তা বলতে পারবেনা। 

বাইরের বৃষ্টির ঘোর ঘরেও ছড়িয়ে গেছে।মানিয়ার চোখে মুখে বৃষ্টি শেষের নীরবতা। 

দূরের কোনো মসজিদ থেকে সন্ধ্যার আযান ভেসে আসে।পাশের কোনো বাসার উল্লুধ্বনি আর শাঁঙ কাসরের শব্দে নিমগ্নতা ভেঙে যায় ঘরময় ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার ভেঙে চুরমার করে মানিয়া আলো জ্বালে।দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে নিনাদ উঠে দাঁড়ায়।মনে মনে খুব,খুব চায় মানিয়া কিছু একটা বলুক।
বাইরের অন্ধকার বেশ গাঢ়।অমাবস্যা নাকি মেঘ নিনাদ ঠিক বোঝেনা।মানিয়ার সাথে সব সম্পর্কের ইতি টেনেই হয়ত এই শেষ মানিয়ার কাছে থেকে বেরিয়ে যাওয়া।মানিয়া দীর্ঘ নীরবতার গুমোট কাটিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলে- 
-নিনাদ এটা কতদিন ধরে তোমার মনে চলছে? 
-অনেকদিন। 
-কাকে কাকে বলেছো তোমার প্রেমকাহিনী? 
-কাউকে না। 
-তা ভাই নিনাদ তুমি আমাকে বা আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো? 
-এই কয়বছরে যতটুকু জেনেছি 
-তাতে কি ভালোবাসা সম্ভব? 
-আমি জানিয়া মানিয়া। 
-আমার মনে হয় চাওয়াটা তোমার শরীরের। 
-না তা নয়। 
-তা নয় তো কি? 
-হয়ত কিছুটা শারীরিক তবে তা গৌন। 
-ভাই এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।মনে করো আমি কিছু শুনিনি তুমিও কিছু বলোনি। 
-কিন্তু মানিয়া 
-কোনো কিন্তু টিন্তু নেই নিনাদ। 

নিনাদ সেদিন খুব রাগেই বেরিয়ে আসে।এভাবে কেউ তাকে ফেরাতে পারে সে ভাবতে পারেনি।প্রত্যাখানের ভয়েই সে সব সময় দূরে থেকেছে।জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে কি দরকার ছিলো এই প্রস্তাবনার নিজেকে খুব ছোট মনে হয় নিনাদের।পরক্ষণেই নিনাদ হেসে ওঠে।তার মনে হয় সে মানিয়াকে ভালোবাসে।মানিয়ার যা কিছু ভালো তার সাথেই তার বসবাস এখানে দুঃখ বা প্রত্যাখান বলে কিছু নেই। 

নিনাদ বেরিয়ে যাবার পর মানিয়ার মনে হলো নিনাদকে এভাবে না বললেও হতো।নিনাদ হয়ত কষ্ট পেয়েছে।নিনাদের ভেতর অনেক ছেলেমানুষী আছে।আবেগে নিনাদ যদি কিছু একটা করে বসে।মানিয়ার চোখ মুখ অস্থির হয়ে ওঠে। 

আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে জোছনা ছড়িয়ে পড়ে।জল মেশানো দুধের মতো চাঁদ জেগে থাকে একা।জানালার গ্রীল গলে ঢুকে পড়ে জোছনা,আর মায়াবী রাত প্রশয় খোঁজে।একা.. 




প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন