শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অন্বেষা রায়




পর্দা
-------

(১)

"এক একটা পর্দা চার ফুট জাগা কোভার করবে।তার মানে ইস খিড়কির লিয়ে আপনার লাগবে তিনটে পর্দা।না না মাপের হিসাব করে কম কাপড়ে পর্দা বানাবেন না ছোটে সরকার,ইটা পর্দা, বিছানার চাদর থোড়ি না আছে যে একদোম টানটান, ভাঁজ ছাড়া হোবে। যত কুচি পোড়বে তোতো ভাল দিখাবে। কামরার শান বাড়বে।নতুন দুলহানিয়া একদম তাজ্জব বনে যাবেন।"

একদমে কথা কটি বলে একটু থামলেন বৃদ্ধ দর্জি মোহনলাল। সাহাবাড়িতে গত চল্লিশ বছর ধরে কাজ করছে সে। শুধু কি পর্দা! বৌদিদিদের জামা, দাদাবাবুদের পায়জামা পাঞ্জাবী, খোকাবাবুদের বাহারি পোশাক সব নিজে হাতে সেলাই করে সে।কোন ছোট্টবেলা থেকে সেলাই শিখেছে। শামসুর মিঞার সাগরেদ, সেলাই তার ধমনীতে। উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল এই সাহা বাড়ির অন্দরমহলে হাতে গোনা যে কয়েকজন বহিরাগত পুরুষের প্রবেশের অনুমতি আছে মোহনলাল তাদের মধ্যে পয়লা নম্বর। শুধু অন্দরমহলই নয় ভেতরবাড়ির দালানের শেষঘরটাতেও বারদুয়েক ঢুকেছে সে।সেটা অবশ্য খোদ বড়কর্তার সংগে নয়ত বাড়ির বড় ছেলে বিক্রম সাহার পাহারায়। খুব সম্ভবত আজও যেতে হবে দোতলার বারান্দার শেষে গাছ ঘেরা ওই ঘরে।ভাবতেই বুকের ভেতরটা ছমছম করে ওঠে মোহনলালের।
ছোট খোকাবাবুকে সে স্নেহের প্রশ্রয়ে ছোটে সরকার ডাকে।সেই ছোট সাহার বিয়ে আগামী মাসে।পাত্রীও বড়ঘরের মেয়ে।বিখ্যাত গাইয়ে দেবকুমার মল্লিকের একমাত্র কন্যা।সারাবাড়িতে সাজ সাজ রব।প্রতিটি ঘর,দালান,খিড়কি,দুয়ার নতুন করে রঙ হচ্ছে। আধুনিক সব রকমারি আসবাব আসছে। সজ্জার অংশ হিসেবে ঘরে ঘরে লাগছে বাহারি পর্দা।
স্পাইরাল করা ছোট্ট নোটবইতে জানলার মাপ লিখে নেয় মোহনলাল। সাতবছর আগে বিক্রম সাহার ছেলে হওয়ার পর এমন হৈ হৈ আনন্দ হয়েছিল সাহাবাড়িতে।বিয়ের পাঁচ বছর পর সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছিল সুভদ্রা।আগের দুইবার বাচ্চাদুটোকে মাস তিনেকের বেশি শরীরে রাখতে পারেনি মেয়েটা।
মনে পড়তেই শোক ছুঁয়ে যায় মোহনলাল কে।শান্ত, ধীর  সুভদ্রার মুখখানি চোখে ভাসে তার।ছেলে কোলে পেয়ে এখন বুঝি কিছুটা দুখ ভুলতে পেরেছে।এই পরিবারে মহিলা বলতে সুভদ্রা একা। তার শাশু মা মানে বড়ে ভাবির দিমাগ কি বিমারি। শেষ ঘরটার দিকে দৃষ্টি পড়ে মোহনলালের।বড় ভাবীর ঘর।বাড়ির বহু বলে পাগলখানায় দাখিলা করায়নি সাহাবাবুরা।নয়ত একদম পুরা পাগল হয়ে গিয়েছেন বড়ে ভাবি। ঘরের কাছে কেউ গেলেই জানলা দিয়ে ডাকবে.....
     " জাম গাছের গোড়াটা একটু খুঁড়ে দেবে???
      দাও না গো।"

থলে থেকে নমুনার খাতাটা বার করে সম্রাট সাহার সামনে ধরে মোহনলাল।
"এই লিন ছোটে সরকার। কালার বলেন।বেডরুম কে লিয়ে কটন কাপড়া লিন,গরমি কম লাগবে।পিলা দিওয়ারের উপর এই রংটা দেখেন,বড়িয়া দিখাবে।"
  পাত্রী অভিজাত বাড়ি থেকে আসছে তার ওপর লেখাপড়া জানা। পর্দার রঙ সচেতন হয়ে বাছে। শুধু কি সেলাই! কোন দেওয়ালে কি পর্দা মানাবে সেই ব্যাপারেও ওস্তাদ মানুষ এই মোহনলাল।বসারঘরের জন্য ফ্রিল দেওয়া জমকালো নীল কাপড় টিক দিয়ে রাখে।স্টাডির জানলায় হাল্কা সবজেটে শেড আর বড়কর্তার অফিসে খয়েরি চেক কাপড়।এত বছর ধরে এইবাড়ির শুধু জানলার পর্দাই কি লাগিয়েছে সে! বড়লোক বাড়ি, বৌবাজারে দুটো সোনার দোকান। অন্ধকার পর্ব কি নেই। আর সেইসব আঁধার কোষ্ঠের প্রতি সাধারণ মানুষের অপার কৌতুহল।

বড়কর্তা বারিদবরণ সাহার বদমেজাজি ছোটভাই কে খুনের অভিযোগে পুলিশ তুলে নিয়েগিয়েছিল মাঝরাতে। বড়ছেলে বিক্রমের জন্মের দুবছর পরের ঘটনা।সম্রাট তখনো জন্মায়নি।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, তাড়া তাড়া নোট ছড়িয়ে ভাইকে ফিরিয়ে এনেছিলেন বড়কর্তা।কার খুন,কিভাবে খুন সব খবরের ফিসফিসানি কানে এসেছিল মোহনলালের, সে পর্দা দিয়ে রেখেছে।জুবান খোলেনি।এমনকি নিজের স্ত্রীর কাছেও উচ্চারণ করেনি একটি শব্দ।কিন্ত ভেতরে শিহরিত হয়েছে।হে ভগবান এরা কি ইনসান!

"বড়ী ভাবী যব শাদি করকে আয়ী বিশ সাল কে থে হম।কিতনি পেয়ারি থি।একদম দুর্গা মা কি তরহা।ওউর স্বোয়াভাব তো পুরি আপনি মা জ্যায়সি।বাড়িতে কোই ভি আয়ে ভাবী নাস্তা না করিয়ে ছোড়বেন না।"

চা দিতে আসা ভৃত্যটিকেই বলতে থাকে  মোহনলাল। দরজা জানলার মাপ নেওয়া শেষ।এখন শুধু বাকি দালানের শেষ ঘরটা।
বয়স শরীরের সাথে সাথে মনকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।মাঝে মাঝে আচমকা ঘূর্ণিঝড়ের মতন হানা দেয় একরাশ স্মৃতি আর অনুভূতিগুলোকে ঘেঁটে ঘুরিয়ে সৃষ্টি করে যায়  বিভ্রান্তির। তার কি কিছু করার ছিল? তার কি কিছুই করার ছিল না!
কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ভেতর থেকে চোখ চায় বাগানের দিকে।কলকাতার বুকে এমন বাগান সচরাচর মেলে না। সারি সারি আম, কাঁঠাল,কালোজাম আর নারকেল গাছ।নিস্তব্ধ, গম্ভীর।শুকনো পাতার সরসরানিতেও যেন জবাবদিহির গুঞ্জন। "আমাদের কি করার ছিল বলো?"
ও বাগানে ঢুকলেই নিশির মতন ডাকে সে।উন্মাদিনী বড়ে ভাবি।
"এই শুনছ,এদিকে এসো একবার। দক্ষিণের জাম গাছটার গোড়াটা খুড়ে দেখোনা...."

    (২)

মাধবী মোহনলালের থেকে ছোট হলে কি সম্মান ভরে তাকে দিদি ডাকত সে। বারিদবরণের একমাত্র বোন।বিক্রম, সম্রাটের না দেখা পিসি। 
"শাদি! মালতি বোল রহি থি সহেলী কে ভাইকে সাথ প্যায়ার চল রাহা হ্যায় উসকা? 
তাওয়ায় রুটি সেঁকতে সেঁকতে স্বামীকে প্রশ্ন করেছিল রাধা।"
মুখ খোলেনি মোহনলাল। বিরাট পরিবারে বিয়ে করতে রাজি নয় বলেই ভাইদের অগোচরে পালাবার পরিকল্পনা করেছিল মাধবী।প্রেমিকের সাথে। সহায় ছিল বড়ে ভাবি দীপালী আর স্নেহের মোহনদাদা। বড়বৌ  তখন সন্তানসম্ভবা।বারিদবরণ প্রথমবার পিতা হতে চলেছেন।পরবর্তী প্রজন্মের আগমনের দিকে  তাকিয়ে সাহাবাড়ি।বংশের প্রদীপ আসছে।
    পর্দা,পর্দা,পর্দা......কত গোপন প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর পর্দা দিয়ে এসেছে মোহনলাল।একি বিশ্বস্ততা নাকি ভয়? নাকি নিকমহারামির হুমকি দিয়ে সৎসাহস কে দাবিয়ে রাখা?এত ভাবনা ভারী হয়ে চাপ দেয় ধূসর কোষগুলোতে।
"কি করে দাদাবাবুরা টের পেলেন পতা হি নেহি চলা ভাবীজি।"
উৎকণ্ঠিত, হতাশ বড়গিন্নির সামনে ব্যার্থ মোহনলালের অসহায় উত্তর। পালাবার সময় হাতেনাতে দাদাদের কাছে ধরা পড়েছিলেন মাধবী। প্রেম পরিণতি পায়নি তার।তবে
মাধবীকে গৃহবন্দি করে রাখা যায়নি বেশিদিন।তৃতীয় রাত্রে পরিধানের শাড়ি খুলে পাখা থেকে ঝুলে পড়ে সে।
সেই বোধহয় শুরু।অন্ধকার দিনের।টাকার জোয়ারে মাধবীর মৃত্যুটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।তবে তার প্রেমিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর।
ঘটনার কয়েকমাস পরে  মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে একেবারে বোবা হয়ে গেল বড়বৌ দীপালী। 
"চাচা।মোহনচাচা। মায়ের ঘরে চলুন।"

সুভদ্রার কন্ঠে চমকে তাকায় মোহন। চিন্তারসূত্র ধরে কোন সুদূর অতীতে চলে গিয়েছিল সে।সুভদ্রাকে দেখে অবাক হয়।
তার হাতে বারান্দার শেষ ঘরের চাবি।এই চাবি বাড়ির পুরুষরা কাছ ছাড়া করেনা।

"দোকানে কি জরুরি দরকার কাকা ফোন করেছিলেন।বাবা, উনি,ভাই সব্বাই দেখি বেরুলো। যাওয়ার আগে ভাই চাবি দিয়ে গেল।আপনি পর্দার মাপ নেবেন তো? আসুন।"


বিক্রম জন্ম নেওয়ার পর প্রথম সন্তান শোক একটু একটু করে কাটিয়ে উঠলেও  হঠাৎ ই পাগলামীর লক্ষণ দেখা যায় দীপালীর মধ্যে। মাঝে মাঝেই চিৎকার আর কান্না শোনা যেত ওপরমহল থেকে। উগ্র হাসি, আর 'খুনি খুনি' বলে আর্তনাদ। বাইরের লোকের সাথে তখন থেকেই বড়ে ভাবির দেখা করা নিষেধ। 

এরই মধ্যে ছোটকর্তাকে পুলিশ গ্রেফতার করল।পুলিশের গাড়ি রওনা দিতেই দোতালা থেকে উল্লসিত হাসি আর করতালির শব্দ পেয়েছিল সারা পাড়া।কিন্ত বড় গিন্নির উন্মাদিনী রূপ দেখেনি কেউ।চিরদিনের জন্য বন্দিনী হয়ে গিয়েছিল সে।

(৩)

"আবার পর্দা বানাবি! হি হি হি হি। 
 আরো পর্দা বানাতে বলেছেন বুঝি তোর কর্তামশাই? হি হি হি হি হি.......পা আ প।
পাপ লুকাচ্ছিস মোহন,পারবি?কিছুতেই পারবিনা।সব ফাঁস করে দেব আমি।"

ফ্যাসফ্যাসে গলায় দ্বেষ ঝরে পড়ে।
স্বল্পালোকিত ঘরটায় ঢুকে নিঃশব্দে দরজা দেয় সুভদ্রা।এই ঘরে তার আসা নিষেধ।আজ বহুকষ্টে একরকম চুরিই করেছে সে বেখেয়ালে ফেলে রাখা চাবিটা।

বাগানে যেতে যে আকুল আহ্বান তার কানে গেছে এতদিন,কেমন করে উপেক্ষা করবে তাকে? 
"দক্ষিণ দিকের জাম গাছটার গোড়াটা একটু দেখ না মা..... "
অপ্রকৃতস্থ মানুষটার সামনে জড়সড় মোহনলাল ঝোলা থেকে ফিতে বার করে। ঈষৎ অপরিছন্ন পোশাক আর আলুথালু চুলে আগের দীপালী কে চেনা যায়না।বিবেকের মতন সোজা চোখে মোহনলালের দিকে তাকায় সে।
এবারও কিছু করবি না? আবার মরতে দিবি আরেকটাকে?
আচমকাই সুভদ্রাকে মোহনের প্রায় গায়ের ওপর ঠেলে দেয় সে।অপ্রস্তুত সুভদ্রার চোখে ভয় মিশ্রিত বিস্ময়।
"এই দেখ।জ্যান্ত লাশ। পেটের দুটো মেয়ে বলে খুন করে দিল তোমার বড়ে সাহেব।কিছু করতে পারলি তোরা? পর্দা টানাচ্ছে।হি হি হি।পাপ ঢাকছে।কিন্ত আমারটা!"

মোহনলাল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পা জড়িয়ে লুটিয়ে পড়েছে দীপালী।
"আমার মেয়েটা তো এসেছিল।আমি নিজে কানে কান্না শুনেছি। মেরে ফেলল আমার মেয়েকে ওরা।ওই জামগাছের তলায় ঘুমাচ্ছে আমার মেয়ে।মা রে.......মা ........
"শান্ত ভাবীজি।উঠিয়ে।"
অশান্ত শরীরটাকে তুলতে পারেনা দুজনে।
"এই সাহাবাড়িকে বেপর্দা করে দে মোহন।বিয়েটা ভেঙে দে বাছা।আরেকটা মেয়ের বলি দিসনা।ওরা খুনি। ওরা খুনি।"

(৪)

সিঁদুর হলুদের ফোঁটা দেওয়া কার্ডে লেখা মল্লিকবাড়ির ঠিকানাটা আরেকবার মিলিয়ে নিল মোহনলাল।দেবকুমার মল্লিকের আবাস।ছোটে সরকারের হবু শ্বশুরঘর। 
সত্যিগুলো তো মোহনলাল জানত।পর্দার নীচে চাপা রেখে ছিল।

অদ্ভুত এক ব্যবসায়ী বাড়ি এই সাহাদের।এমনটা দ্বিতীয় দেখেনি মোহনলাল।লক্ষী এখানে কেবলই মৃন্ময়ী মূর্তি।
প্রসব যন্ত্রণায় প্রায় অচৈতন্য দীপালীর কানে গিয়েছিল নবজাতিকার কান্না তাই মৃত সন্তানের কাহিনি বিশ্বাস হয়নি তার। একটু সুস্থ হতেই সে চেপে ধরে স্বামীকে। তর্কের মধ্যেই ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাটার আঁচ পায় সে। তারপর শুরু হয় খোঁজ।ধাইমা, চাকরানি গোপনে স্বীকার করে সবাই।সদ্যজাত কন্যাটিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল ছোট কর্তার হাতে।বাড়ির চৌহদ্দি পেরোয়নি ছোট্ট প্রাণটি।কান্না থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার।
কাঁপা কাঁপা হাতে বেল বাজায় মোহনলাল।
নিজের চেষ্টায় অনেকদূর এগিয়েছিল তার ভাবীজী।ছোট সাহার গ্রেফতারি অবধি। কিন্ত আর পারেনি।সত্যি ই কি পারেনি?
কারুকাজ করা সদর দরজা খুলে যেতেই নিজেকে গুছিয়ে নেয় বৃদ্ধ দর্জি মোহনলাল।আজ সে পর্দা খুলতে এসেছে।লক্ষী মা কে বাঁচাতে এসেছে।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন