একটিমাত্র উপন্যাস রচনার সুবাদেই
যিনি অমরত্বের মর্যাদা পেয়েছেন
[ বাংলা সাহিত্যের এক বিরল প্রতিভা কিন্তু স্বল্প আলোচিত
অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম শতবর্ষে (২০১৪) তাঁর জীবন ও সৃষ্টির সঙ্গে এই প্রজন্মের
পরিচিতি ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছিলাম নানান গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অদ্বৈতচর্চার
সূত্রগুলি অবলম্বন করে । অদ্বৈতচর্চার যশস্বী ব্যক্তিত্ব দেবপ্রসাদ ঘোষ, সুশান্ত
হালদার, শান্তনু কায়সার প্রমুখের লেখা আমার এই নিবন্ধের সহায়ক সূত্র ]
একটি মাত্র উপন্যাস লেখার সুবাদে বাংলা সাহিত্যে
স্থায়ী আসন লাভের কথা আর কোন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে হয়েছে কিনা জানা নেই । তাও সেই
উপন্যাস তাঁর মৃত্যুর চারবছর পরে প্রকাশিত হয়েছিল । বাংলা সাহিত্যের এক বিরল
প্রতিভা কিন্তু স্বল্প আলোচিত অদ্বৈত
মল্লবর্মণ একটিমাত্র উপন্যাস – ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ রচনার সুবাদে বাংলা সাহিত্যে
স্থায়ী আসন পেয়েছেন । কাঁচরাপাড়া যক্ষা হাসপাতালে ভর্তির পূর্বে বন্ধুর কাছে
তিতাসের পান্ডুলিপিটি রেখে যান, যেটি তাঁর মৃত্যুর চারবছর পরে প্রকাশিত হয় ।
অদ্বৈতের অনেক আগে ১৯৩৬এ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়
নদীজীবি দরিদ্র মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে লেখা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আজও পাঠককুলকে আলোড়িত
করে । সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ও মাছমারাদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে লেখা বাংলাসাহিত্যের
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি । নদীজীবি মানুষদের
কাহিনী শিবশঙ্কর পিল্লাইএর ‘চেম্মিন’ (চিংড়ি) ভারতীয় সাহিত্যের এক মহৎ সৃষ্টি
। তা সত্তেও ‘তিতাস...’ অন্যতর বৈশিষ্ট্যে
উজ্বল হতে পেরেছে । পেরেছে, কারণ উপন্যাসে মালো সমাজের যে ছবি, তাদের জীবনের যে
পাওয়া না-পাওয়া, যে ভাঙ্গা-গড়ার বৃত্তান্ত এঁকেছেন অদ্বৈত তা একেবারে ভেতর থেকে
দেখা, তাতে কোন কল্পনার মিশেল নেই ।
তিতাস পারের মালোপাড়ার যে দরিদ্র মানুষদের
শীত-গৃস্ম-বর্ষার যাপনচিত্র এঁকেছেন,অদ্বৈত সেই মালোপাড়ার দরিদ্র ধীবর পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন ।
তিতাস – “তার কূলজোড়া জল। বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস । স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায় । ভোরের হাওয়ায় তার
তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম
পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না” । তিতাস নদীর তীরে মালোপাড়া – জেলেদের গ্রাম
সে গাঁয়ে তারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে। অদ্বৈতের বর্ণনায় “মালোদের ঘরের আঙ্গিনা
থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে” । মালোদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের যাপন তিতাসকে ঘিরেই
আর তাদের জীবিকা আসে তিতাসের বুক থেকে। দরিদ্র
অবহেলিত মালোদের জীবন, পুরাতন সমাজের ভাঙন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, তাদের জীবনে
শোষণের চরিত্র বিশ্লেষিত ‘তিতাস’এ । ‘তিতাস’ যেন দৃশ্যমান বিষয়ের প্রতিচ্ছবি ।
জন্ম তখনকার কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণ বেড়িয়া মহকুমার
কোকর্ণঘাট গ্রামের এক ধীবর পরিবারে, ১৯১৪র ১লা জানুয়ারি । পিতা অধরচন্দ্র বর্মণ । সেই সময় তিতাস তীরের অস্পৃশ্য মালোপাড়ায়
লেখাপড়ার পরিবেশ থাকার কথা নয়, ছিলও না । সেই দরিদ্র মালোপাড়ায় নিতান্ত শৈশবে
পিতৃ-মাতৃহীন অদ্বৈতের মনে জ্ঞাণার্জনের স্পৃহা জাগ্রত হয়েছিল কি করে, সে বড়
বিস্ময় ! ব্রাহ্মণবেড়িয়ার অন্নদা উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে
মেট্রিকুলেশন পাশ করে প্রতিবেশিরা চাঁদা তুলে কলেজে ভর্তি করেছিলেন । কিন্তু
আর্থিক অনটনে অদ্বৈতের কলেজশিক্ষা
অসম্পূর্ণ থেকে যায় । জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় চলে আসেন ১৯৩৪এ । তখন তাঁর
বয়স ২০বছর । কলকাতায় অদ্বৈত সাংবাদিকের পেশা গ্রহণ করেন । মাসিক ত্রিপুরা পত্রিকার
সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের শুরু । এরপর প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত
‘নবশক্তি’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন । তারপরে ‘মুহম্মদি’, বিশ্বভারতী প্রকাশণা
বিভাগ ও ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যুক্ত হয়েছিলেন ।
মাত্র ৩৭বছরের আয়ু ছিল অদ্বৈতের, তাও শেষ
কটা বছর কেটেছে যক্ষার কীটদ্রষ্ট শরীর নিয়ে । কবিতা লেখা দিয়েই তাঁর সাহিত্যজীবনের
শুরু । তারপর যে সমাজকে তিনি দেখেছেন, যে সমাজের গ্লানিময় দিবা-রাত্রে বড় হয়েছেন
তাদের কথা লিখেছেন তাঁর মহত্তর সৃষ্টি তিতাস’এ । ২১ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসা
জীবিকার সন্ধানে, আর মৃত্যু পর্যন্ত এই বারো বছরেই তার যা কিছু মহৎ সৃষ্টি । তখনও
অদ্বৈতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি ‘তিতাস...’ এর কথা জানা যায়নি, ‘দেশ’ পত্রিকায়
বিশ্ববিশ্রুত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগখের জীবনকাহিনী অবলম্বনে লেখা আরভিং
স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’এর অদ্বৈত কৃত বঙ্গানুবাদ ‘জীবনতৃষা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল
। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯এর মার্চ থেকে ১৯৫০এর
মে পর্যন্ত । আরভিংস্টোন ‘লাস্ট ফর লাইফ’ উপন্যাসে ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট
ভ্যানগখের যন্ত্রণাময় জীবন ও বর্ণময় ব্যক্তিসত্বার পুনর্নির্মাণ করেছিলেন । অদ্বৈত
এই উপন্যাসটিকে বঙ্গানুবাদ করার জন্য বেছে নিলেন কেন ? নিয়েছিলেন, কারণ একজন
শিল্পীর জীবনকে দেখা ও বোঝার যে অন্তর্দৃষ্টি ‘লাস্ট ফর লাইফে’ আরভিংস্টোনের মধ্যে
পেয়েছিলেন সেটিই তাকে প্রাণিত করেছিল । এ যেন চিত্র ও কথায় শিল্পের অভিন্ন
আত্মীয়তা ।
জীবিতাবস্থায় অদ্বৈতের একমাত্র প্রকাশিত
গ্রন্থ – কোন উপন্যাস বা গল্প নয়, ক্ষুদ্র অবয়বে একত্রিশ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ
‘ভারতের চিঠিঃপার্লবাক’কে’ । প্রবন্ধটি সম্ভবত
১৯৩৯/৪০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । অদ্বৈত তখন কলকাতায় সাংবাদিকতার চাকরীতে ২৫/২৬এর
তরুণ । বইটির উৎসর্গ পত্রে অদ্বৈত লিখেছিলেন –
“ছায়াঘেরা পল্লীর সজলতা মাড়িয়ে এসে ক্ষমাহীন
নাগরিক রুক্ষতার ধূসর রূপের আগুনে জ্বলেই
যেতুম যদি না......”
উৎসর্গপত্রের দুটি শব্দ খুবই তাৎপর্যপূর্ন
মনে হবে । লিখেছেন ‘ছায়াঘেরা পল্লীর সজলতা ‘মাড়িয়ে’ ফেলে আসা নয়, ‘মাড়িয়ে’ আসা,
এবং ‘ক্ষমাহীন নাগরিক রুক্ষতার ধূসর আগুনে’ । শব্দগুলিতে নিশ্চিতভাবেই তিতাস পারের মালোপাড়ার তার
আপনজনদের ফেলে আসার বেদনাবোধ, তিনি যে তাদেরই একজন, এই আর্তিই রয়েছে ঐ শব্দটির
ব্যঞ্জনায় । এই বোধই তাঁকে তাড়িত করেছিল
‘তিতাস...’ লিখতে । অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, ‘গুড আর্থ’এ চীনা কৃষকদের দুর্দশার
বৃত্তান্ত পড়ে নিজের মালো সম্প্রদায়ের কথাও ভেসে এসেছিল তাঁর মনে । জীবিকার
সন্ধানে কলকাতায় এসে তিতার পারের পিছুটান এড়ানো সম্ভব ছিলো না সংবেদনশীল অদ্বৈতের
। আধুনিক নগরজীবনের নির্জিবতা তাঁকে পীড়িত করেছিল ;তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংবেদনশীলতা
ছিল তিতাসপারের মানুষজনের সঙ্গে । অদ্বৈতের কলকাতা জীবনে দেখা ‘ক্ষমাহীন নাগরিক
রুক্ষতার ধূসর রূপের’ অনুষঙ্গে তাঁর অনুভবের একটি স্তর আমাদের অতয়েব জানা হয়ে যায়,
যখন লেখেন “আজকের দিনে ব্যক্তিত্বের বড় দুর্দশা; মহাস্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দাও,
দেখবে সে স্রোত আবর্তের বুকেও তোমার ব্যক্তিত্বকে করুণায় ঠিক রাখছে; বেঁকে বসো
তাহলে দেখবে সে ব্যক্তিত্ব খন্ড খন্ড হয়ে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে” (ভারতের
চিঠিঃপার্লবাক’কে) ।
অদ্বৈত যখন কলকাতায় সাংবাদিকতার পেশায়,
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । সাংবাদিকতার ও নিজের জ্ঞানলিপ্সার সূত্রে
বিশ্ব ঘটনার খবরাখবর তাঁর অজানা ছিলনা ।
রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র সম্পর্কে তরুণ অদ্বৈতের স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল
। সেই ধারণার ভিত্তিতে ‘গুড আর্থ’ পাঠের প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহসী হয়েছিলেন । ‘গুড
আর্থ’এর লেখিকার স্বদেশ যে সাম্রাজ্যবাদেরই বড় তরফ সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে অদ্বৈত
লিখেছিলেন “এক একটা মহাযুদ্ধ অনেককিছু ওলটপালট করে । এবারের মহাযুদ্ধের পরেও কি
বিজ্ঞান, কি সংস্কৃতি, কি সমাজ, কি মানুষের বিধি ব্যবস্থা সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে
একটা নূতন রূপ নেবে একথা ঠিক এবং সেই পরিবর্তিত রূপের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে
নেবার জন্য হয়তো তাকে আরো মার্জিত, আরো পালিশসহনশীল, আরো আপাত দৃষ্টি সুখকর
পরিচ্ছদ ধারণ করতে হবে... তবু তো সে হবে আদিম বর্বরতারই উত্তরাধিকারী – নয় কি ?
মানুষের বা জাতীর উপর কর্তৃত্ব করা এবং সে কর্তৃত্ব অব্যাহত
রাখবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করাকে বর্বরতা বললে তুমি যদি ব্যথা পাও,
তাহলে তোমাদের কাছে ও বস্তুটিকে বর্বরতা না বলে সভ্যতাই না হয় বলবো” [ভারতের চিঠিঃপার্লবাককে]
মালো সমাজ থেকে উঠে আসা অদ্বৈতের আদর্শগত
দিকটি বেশি আলোচিত নয় । কলকাতায় সাংবাদিক অদ্বৈত যে সময় লেখালেখি শুরু করেছেন, তখন
কলকাতা আলোড়িত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অভিঘাতে । তারই পাশাপাশি সমাজসচেতন শিল্পী-সাহিত্যিক শিল্পীরা সমবেত
হচ্ছিলেন বামপন্থী আদর্শের টানে । সমাজ সচেতন হয়েও অদ্বৈত সক্রিয় বামপন্থী
ভাবধারায় নিজেকে জড়ালেন না কেন, আদর্শের আকর্ষণ তাঁকে টানলোনা কেন, কেন তিনি
বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেন, সেই প্রশ্ন থেকে যায় । ‘ভারতের চিঠিঃপার্লবাক’কে’
বইটিতে নিজেকে কিছুটা মেলে ধরেছেন অদ্বৈত
। এই বিশ্বাসের একটা ভিত্তি তাঁর মধ্যে তৈরি হচ্ছিল যে মানুষের সম্মিলিত শক্তিই
জাতীর ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারে ।
পার্লবাক’কে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন “যদি
আসতে একবার আমাদের দেশে, তবে দেখতে পেতে বই লেখার কি চমৎকার উপাদান – রাশি আশি
জমাট বাঁধা মালমশলা এখানে পড়ে আছে । আমাদের তেমন দৃষ্টিশক্তি নেই । তাই এত সব
দৃশ্যকে উপেক্ষা করে আমরা ঠিক বেলা দশটায় আহার সমাধা করি, রাইটার্স বিল্ডিংগামী
ট্রামে পান চিবুতে চিবুতে উঠে, ‘আনন্দবাজারের’ ভাঁজ খুলি । বেশ আছি আমরা” । তীব্র শ্লেষ ভরা এই কটি বাক্য থেকে স্পষ্ট
হয়ে যায় তাঁর আদর্শগত অবস্থান ।
পীড়িত, শোষিত মানুষের পাশে থাকা, মাটির
কাছে থাকা ভিন্ন অন্য কোন ভাবনা অদ্বৈতের ছিল না । সেই ভাবনা থেকেই পথের সন্ধান
করতে চেয়েছিলেন আপন অভিজ্ঞতার জমিনে, সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর অনন্য সাহিত্য সৃজন
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ।
‘তিতাস...’এর প্রথম সংস্করণের ভুমিকায়
প্রকাশক লিখেছিলেন “আমাদের বন্ধু অদ্বৈত দীর্ঘজীবী হন নাই, হয়তো তাঁহার তিতাসের
কাহিনী দীর্গজীবী হইবে” ।
হ্যাঁ, মরণোত্তর প্রকাশ
একটিমাত্র উপন্যাস রচনার সুবাদেই অদ্বৈত মল্লবর্মন বাংলা সাহিত্যে অমরত্বের
মর্যাদা পেয়েছেন ।
প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন