শনিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২২

অমিতাভ সরকার

                


।।পোড়া_দাগ।। 
                                       
 
টেবিলের সামনে পুরোনো গোল ঘন্টাটা চাপড় মেরে ডাক্তার'দি বললেন; "পরেরজনকে পাঠিয়ে দাও..."  
“কেমন আছেন গো দিদি?” এক গাল হেসে দরজা খুলে ঢুকলেন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা, সঙ্গে চকলেট রঙের বোরখা পরা একজন। চেম্বারে ঢুকে মুখের ওপর কাপড় সরাতেই দোলনচাঁপা রঙের ঢলঢলে ডাগরচোখের একটি মুখ দেখা গেল। খুব চেনা চেনা মনে হলো ডাক্তার'দির। কোথায় যেন দেখেছি… কোথায় যেন দেখেছি… ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল, কিছুদিন আগেই দেখেছে তাকে। তখন অবশ্য কনের সাজে ছিল মেয়েটি। 
“ভালো আছি গো। ছেলের বউ না? প্রথমে ঠিক চিনতে পারিনি!” হাসলেন ডাক্তার'দি। 
“হ্যাঁ গো দিদি, আপনি তো গিয়েছিলেন…” 
 # 
ডাক্তার'দি এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সপ্তাহে দু'দিন এই চেম্বারে বসেন। বেশিরভাগ মানুষের, বিশেষতঃ আশপাশের অঞ্চলের মহিলাদের ভরসা এই ডাক্তার'দি। এমবিবিএস পাশ করে পরিচিত একজনের সুত্রে এই অঞ্চলে এসে প্র্যাকটিস করা শুরু করেন তিনি। তারপর সকলের ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে যান। প্রায় কুড়িটা বছর নানান প্রলোভন সত্বেও চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি। এলাকার মানুষও আপন করে নিয়েছেন তাঁকে। বাড়ির সবজি বাগানের প্রথম ফলন, উৎসবে সিমাই-পায়েস, পিঠে-পুলি, তালের বড়া ডাক্তার'দিকে না দিলে মন ভরে না তাঁদের।   
ডাক্তার'দি এখান থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে থাকেন। স্বাভাবিক ভাবে ইচ্ছে থাকলেও প্রতিদিন আসা সম্ভব হয় না। এই দুইদিন সকালে চেম্বার খোলামাত্র নাম লেখা শুরু হয়। জেলা শহর থেকে ডাক্তার'দির আসতে আসতে প্রায় সকাল দশটা-সাড়েদশটা বেজে যায়। সারাদিন রুগী দেখা শেষ করে রাত্রি সাতটার আগে বেরতে পারেন না।  
এলাকাটি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের সংখ্যাধিক্য। মহিলারা নিছক দায়ে পড়া ছাড়া দেখান না পুরুষ ডাক্তারদের। সেরকম প্রয়োজন হলে মহিলারা এই ডাক্তার'দিকে দেখানোর জন্য জেলা সদরে বাড়িতে হাজির হন। 
#
ডাক্তার'দি সাদরে মহিলাকে উল্টোদিকের চেয়ারে এবং পুত্রবধূকে পাশের চেয়ারে বসতে বললেন;
“বলুন বৌদি, এবারে কার সমস্যা? আপনার, না ছেলের বৌয়ের?”  
“না দিদি, আমারই। বেশ কিছুদিন হলো…”। প্রাথমিক সমস্যা এবং উপসর্গ জানার পর ডাক্তার'দি পাশের ছোট্ট এন্টিচেম্বারে অবজারভেশন টেবিলে শুয়ে পড়তে বললেন ভদ্রমহিলাকে। পর্দাটা টেনে দিয়ে ভদ্রমহিলার সামনে এসে পেট থেকে কাপড় সরিয়ে মন দিলেন পরীক্ষায়। পেটের উপর একটা হাতের তালু রেখে তার ওপর আর এক হাতের তালু দিয়ে চেপে টিপে টিপে  দেখতে দেখতে হঠাৎ পেটিকোটের কাছে দাগটা দেখতে পেলেন! পুড়ে যাওয়ার মতো কালচে দাগ! এটা কিসের দাগ? এতো সন্তানধারনের দাগ নয়, তাহলে…?  
“এটা কিসের দাগ? ভালো করে দেখি…"। পেটিকোটটা নামাতে যেতেই চকিতে উঠে বসলেন ভদ্রমহিলা। 
“ও কিছু নয় দিদি, ওটা অনেকদিনের…”। ডাক্তার'দিদি ভদ্রমহিলার আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলেন। প্রায় জোর করে আবার শুইয়ে দিলেন তাঁকে। বেশ কিছুক্ষণ বুঝিয়ে, কাউকে বলবেন না কথা নিয়ে শোনালেন বিবাহের পরের সেইসব দিনের কথা। 
#
আঠারো বছর পেরোতে না পরোতেই পাশের গ্রামের অবস্থাপন্ন যৌথ পরিবারে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। একবছরের মধ্যেই গর্ভে সন্তান এসেছিল। পরিবারে খুশীর হাওয়ায় যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি ছিল না। নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের দাইকে ডেকে বাড়িতেই ভুমিষ্ট হল সন্তান। সন্তান জন্মানোর পরই সকলের ব্যবহার গেল পাল্টে। পরিবারের মানুষজন অনেক আশা করেছিলেন, পুত্রসন্তান হবে তাঁর। কিন্তু সকলকে হতাশ করে কন্যাসন্তান হল তাঁর। এরপর থেকে ধীরে ধীরে রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া… একে একে সংসারের সব কাজ চাপতে লাগল তাঁর ঘাড়ে। কাজের চাপে খাওয়ার সময় হত না তাঁর। পরিবারের কেউ, এমনকি স্বামীও তাঁকে খাওয়ার কথা বলার সাহস করেননি কোনোদিন। ভেবেছিলেন আব্বুজানের কাছে চলে যাবেন। কিন্তু কন্যাসন্তানের কথা ভেবে আব্বুজানের কাছে যাওয়া হয়নি। এখানেই কিছু একটা করতে হবে তাকে। অনেক ভেবে একটা ফন্দি বের করলেন তিনি। সারাদিনের মধ্যে দুই থেকে তিন বার কন্যাসন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য সামান্য সময় বরাদ্দ ছিল তাঁর। সকাল, রান্নাবান্নার পর দুপুরে আর রাতে । দুপুর আর রাতের সেই সময়টাকে কাজে লাগালেন। 

পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করার পর হাঁড়িতে ভাত করতে হত তাঁকে, বাড়ির এটাই দস্তুর। ভাতের হাঁড়ি উপুড় করে কন্যাসন্তানকে বুকের দুধ খাইয়ে এসে সকলকে খেতে দিতেন। কন্যাকে খাওয়াতে যাওয়ার আগে সকলের অলক্ষ্যে দুমুঠো গরম ভাত, সামান্য সবজি আর একটু লবন কোঁচড়ে নিয়ে তলপেটে বেঁধে নিতেন। প্রথম প্রথম গরমভাতের স্পর্শে তলপেটে জ্বালা হলেও পরে সয়ে গিয়েছিল। আসলে ক্ষিদের জ্বালা থেকে বড় জ্বালা কিছু নেই। প্রায় একবছর পর তাঁর কোলে এলো দ্বিতীয় সন্তান, পুত্রসন্তান। বংশধরকে পেয়ে পরিবারে খুশির হাওয়ায় সকলে ভুলে গেলেন সব।

এতক্ষণ বাকরূদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলার কথা শুনছিলেন ডাক্তার’দি, কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। কি নিদারুণ  যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হয়েছিল ভদ্রমহিলাকে! একটু হেসে শাড়ি ঠিক করতে করতে উঠে পড়লেন তিনি। ডাক্তার’দির পেছন পেছন পর্দা ঠেলে বাইরে এসে বসলেন। ডাক্তার’দি আড় চোখে সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূকে দেখলেন তিনি। খুব জানতে ইচ্ছে করল, তাকেও হয়তো এইভাবেই সহ্য করতে হবে, যদি...। পরিবারের পরিস্থিতি কি পাল্টেছে আদৌ? প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে একবার তাকিয়ে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললেন ডাক্তার’দিদি। প্রশ্ন শুনে একটু ইতস্তত করলেন ভদ্রমহিলা, বললেন; 
“না দিদি, আমি যেভাবে যন্ত্রণা সয়েছি, আমার বৌমাকে অতটা সইতে দেব না। ‘অতটা’! ডাক্তার’দিদি কৌতুকের হাসি হেসে একবার তাকালেন সদ্য বিবাহিতা কন্যাটির দিকে। মনে হল হিজাবের মাঝে তার নিষ্পাপ ঢলঢলে মুখমণ্ডলে চকচকে চোখ আর ম্লান হাসি যেন কিছু বলতে চায়।
                      .....................................


২টি মন্তব্য: