সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮

শর্মিষ্টা দত্ত


অভিযোজন (৬)

আশ্বিনের সোনা রোদে ভেসে যাচ্ছে সবুজ ঘাসজমি। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । বাতাসে পূজোর গন্ধ। দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলে  এখনো জনবসতি তেমন বেশী নয়।বাড়িগুলোও বেশ ফাঁকা ফাঁকা ,সামনে  বড় বড় মাঠ-পুকুর-বাগান নিয়ে  বেশ খোলামেলা পরিবেশ। পাপাইয়ের জন্মদিনে সকালেই তিতলি আর তিতিরকে নিয়ে প্রভা এসেছেন বড় ছেলের বাড়ি। উমার স্কুল আছে ,সে আসতে পারবে না।মল্লিকাও খুব ব্যস্ত ,পূজো আসছে। ওরা দুজন সন্ধ্যেবেলায় আসবে। 

তিতলি এবছর উমার স্কুলেই  ভর্তি হয়েছে ,সকালবেলা পিসির সঙ্গেই স্কুলে যায় ,একসঙ্গেই ফেরে । সাড়ে তিন বছরের তিতিরের সঙ্গে সারাদিন বকবক  করে সময় কেটে যায় প্রভার।আজ তিতলি স্কুলে যায়নি,দাদার জন্মদিনে নেমন্তন্ন খাওয়ার উৎসাহে দুইবোনই রীতিমত উত্তেজিত । পাপাইও খুব খুশি , বোন দুটো খুব মিষ্টি আর বাধ্য । সেও  আজ স্কুলে যায়নি , বাড়ির সামনের মাঠে তিন ভাইবোন আপাতত খেলায় মগ্ন।কালই গড়িয়াহাটের একটা বড় দোকান  থেকে পাপাইয়ের জন্য একটা জামাপ্যান্টের সেট কিনে এনেছিল মল্লিকা। হালকা হলুদ রঙের টি-শার্ট আর নেভি-ব্লু প্যান্ট। “মা ,এটা আপনি নাতিকে উপহার দেবেন জন্মদিনে ”। প্রভার বুকের কাছটা চিনচিন করে ওঠে।মল্লিকা এখন প্রতিমাসে তাঁর হাতে সংসারখরচের নাম করে বেশ কিছু টাকা দেয়। তাছাড়াও বাড়ির সকলের জন্য এটাসেটা তো আনেই।শুধু প্রণবের নামটাই এবাড়ি থেকে মুছে গেছে চিরতরে । 

বছরখানেক হল  মল্লিকা গড়িয়াহাটে একটা ছোট্ট  শাড়ীর দোকান  করেছে। সকাল দশটা থেকে রাত প্রায় আটটা অবধি দোকানেই থাকে সে । সকালে উঠে উনুন ধরিয়ে রান্নাবান্না সেরে ভাত খেয়ে টিফিনবক্সে রুটিতরকারি ভরে  নিয়ে সে বেরিয়ে যায়।

প্রণব মারা যাওয়ার পরে ভারতীর সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ করতে করতেই ব্যবসার চেষ্টা করছিল মল্লিকা।প্রভাকে না বলেই যৎসামান্য যা গয়না ছিল ,তাই বেচে মূলধন যোগাড় করেছিল। বড়বাজার থেকে সস্তায়  শাড়ী কিনে পাড়াপ্রতিবেশী ,আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে দু-চারখানা বিক্রি হতে না হতেই উৎসাহ বেড়ে গেল। ভারতীকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপুর-ফুলিয়া থেকেও শাড়ী আনতে শুরু করল সে। তাঁতীদের বাড়ি গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হতে হতেই তাঁতে ওদের কাজ দেখে নানারকম ডিজাইনের আইডিয়া আসে মল্লিকার মাথায়।কয়েকদিন ওদের সঙ্গে বসে, ডিজাইন  এঁকে বুঝিয়ে, সামনে দাঁড়িয়ে  থেকে কয়েকটা শাড়ী তৈরী করে আনতেই হটকেকের মত বিক্রী হয়ে গেল সেগুলো। আরও উৎসাহ পেয়ে গেল মল্লিকা। হাতে মূলধনও জমল কিছু। বছরখানেকের মধ্যেই গড়িয়াহাটে বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে সস্তায় একটা ছোট্ট ঘরও পেয়ে গেল। অল্পসময়ের মধ্যেই বেশ নাম হয়েছে তার দোকানের।দুটি মেয়েকেও সেলসগার্ল হিসেবে রাখতে হয়েছে। এবার পূজোর আগে বহরমপুর থেকে কিছু সিল্কের শাড়ী এনেছিল,এরমধ্যেই সব বিক্রি হয়ে গেছে। কসবায় একটা ছোট ঘরে চার -পাঁচটা মেয়ে সুতি আর সিল্কের ওপর ব্লকপ্রিন্ট করে।নিজের ডিজাইনে  কিছু কাঠের ব্লক বানিয়ে ওদের দিয়েও কয়েকটা শাড়ী বানিয়েছিল,ওগুলোরও খুব ডিমান্ড। মল্লিকা ভেবেছে এবার ম্যাড্রাস আর ব্যাঙ্গালোর যাবে একবার ,ওখান থেকে নিজে পছন্দ করে শাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু অচেনা জায়গা ,প্রভা বা ভারতী কি একা যাওয়ার অনুমতি দেবেন ! 

সকালে প্রসূন ওদের পৌঁছে দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে ,সেও ইউনিয়নের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যেবেলাতেই আসবে। রেখা আজকাল ওবাড়ির সবাইকে বেশ সমঝে চলে ,এটা বেশ বুঝতে পারেন প্রভা। দুপুরে বেশ কয়েকপদ নিরামিষ রান্না করেছিল। প্রভা বললেন,“এত কিছু রানছ ক্যান বড়বৌমা? আমার তো একটা তরকারী হইলেই খাওয়া হইয়া যায়। ” বাচ্চাদের মাংস-ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে রেখা বলেছিল ,“আমার কাছে তো আর আপনি রোজ খান না মা, মাঝেসাঝে এলে আমারও তো ইচ্ছে করে আপনাকে একটু যত্নআত্তি  করি।চেহারাটা কি খারাপ হয়েছে আপনার , বলুন তো ! সারাদিন দুটো বাচ্চার ঝক্কি ...এখন তো আপনার একটু ভালমন্দ খাওয়া দরকার । তা না ..রোজ একটা তরকারী। ওরা তো মাছটাছ খায় ,আপনার জন্য তো আর একটা তরকারী রান্না করতে পারে । ”  স্পষ্টতই মল্লিকার প্রতি ঠেস ...দেওর মারা যাওয়ার পর তার বৌ যে আমিষ  সবই খায় এটা নিয়ে তার বাপের বাড়ীতেও কম চর্চা হয় না। আজ সন্ধ্যেবেলা তো রেখার দাদা ,বৌদি ,দিদি সবাই আসবে , নিজের চোখেই দেখবে সব ।প্রমোদের প্রমোশন হয়েছে, ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে অফিসার হয়েছে তাই এবার পাপাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি ,বাপেরবাড়ি তো বটেই ,আরও বেশ কিছু লোকজনকে নিমন্ত্রণ করেছে রেখা। 

সন্ধ্যেবেলা মল্লিকার দোকানে চলে এল উমা। দুজনে একসঙ্গে যাদবপুরে যাবে। সঙ্গে একজন  বছর চল্লিশেক বয়সের ভদ্রলোক,আসাযাওয়ার পথে পাড়ায় কয়েকদিন ধরে ওঁকে দেখেছে মল্লিকা। উমা আলাপ করিয়ে দিল। ওঁর নাম তন্ময় সিরাজ ,ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন । কয়েকমাসের জন্য ঢাকা থেকে রিসার্চের কাজে এসেছেন , কলকাতার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপরে কিছু সার্ভে করছেন ।মাসতিনেক আগে  স্কুলেই আলাপ উমার সঙ্গে । ওরা কিছু বলার আগেই মল্লিকা বুঝে গেল কি হতে চলেছে । জীবন তাকে এই বয়েসের মধ্যেই শিখিয়েছে অনেককিছু। তন্ময়কে বসতে বলল মল্লিকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন