সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮

সম্পাদকীয়




আর কটা দিন পরেই পূজো I চারিদিকে মা আসছে মা আসছে গন্ধ ৷ এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশ উত্তাল ৷ মানুষজন বুঝে কিংবা না বুঝে পরকীয়া নিয়ে নানা টিপপনি করছেন । কোনটা স্বকীয়া আর কোনটা পরকীয়া তা নিয়ে চলছে বিস্তর বাদানুবাদ ৷ সকল তর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে সেই নারী । আদি অন্তিম কাল থেকে তাকে নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই ৷ যুগ যুগ ধরে ঘটে চলা শ্বাশত বাণীর মত চিরন্তন ৷ 


 দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে I কিন্তু দুর্গা নিয়ে পুরাণ যা বলেছে তাতে নারী নিয়ে সুচিন্তা বা ভাবনা হয়েছে ইতিহাস তা বলে না ৷
ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষরাজ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শাস্ত্রে আছে শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন।এই প্রথা যেন আজও চলে আসছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ৷ চিরায়িত সত্য এই শ্বশুড় ও জামাইয়ের সম্পর্ক ৷ পুরাণ থেকে অাজও যেন কোথাও এক বিশাল বেড়াজাল । সেই জালের মধ্যে কখনও কোন স্বাভাবিকতা নেই ৷ 



  দক্ষরাজ তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না কখনও । সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষরাজ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। এখানেও কেমন যেন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ছাপ দেখা যায় ৷ অর্থ , প্রতিপত্তি নির্ধারণ করত সামাজিক পরিচয় সেই পুরাণ থেকে আজও  ৷ তাই তিনি  শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষরাজ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। যে যজ্ঞে সমস্ত দেবতা, প্রানী, ঋষি, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর, অসুর, নাগ, অপ্সরা, চারন, নবগ্রহ, সপ্তর্ষি এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু কে পর্যন্ত নিমন্ত্রণ জানালেন ৷সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর।তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। আমাদের তথাকথিত নারীদের এই দোলাচল থেকেই যায়  ৷ বাবা ও স্বামী দুই পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোনদিনই ঘুচবে না ৷ 


দক্ষরাজ জানতেন এই যজ্ঞের  খবর ঠিকই পৌছবে শিব সতীর কাছে এবং তাদের যে না ডাকার কারণটা প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের পরিচিতমহলে ৷ এই বিভেদে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে তাঁর মেয়ে তা যক্ষরাজ হয়ত বোঝেননি বা বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন ৷ কিন্তু সতী পারেননি নিজেকে ধরে রাখতে ৷অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে  প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষরাজ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ এমন কঠিন বাক্য স্ত্রী হয়ে সহ্য করা অসম্ভব ছিল সতী'র কাছে  ৷ একদিকে বাবা অন্যদিকে স্বামী ৷ স্বামী হলেন  তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণে যক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তখন আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।

এই হল পুরাণ ৷ হর পার্বতীর এই প্রেমের গল্প আমরা শুনে আসছি ছোটবেলা থেকেই ৷ কিন্তু সতীর এই যজ্ঞে আহূতি দেবার কারণ কি ! পুরাণে যজ্ঞ হলেই আহূতি দেবার প্রচলন ছিল তা পশু হোক বা মানুষ ৷ তবে কি সতীকে জোড় করা হয়েছিল নিজেকে আহূতি দেবার জন্য ৷ সতীদাহ প্রথার জন্ম তখন থেকেই হয়েছিল ৷ প্রাচীন কালে রাজা মহারাজরা যজ্ঞ করতেন কোন উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য ৷ যক্ষরাজ কোনদিনই শিব - সতীর বিয়েকে  মেনে নিতে পারেননি ৷ যেহেতু শিব দেবমহলে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাই তাকে আক্রমণ করা যক্ষরাজের পক্ষে সম্ভব ছিল না ৷ ফলসরূপ সতী যক্ষরাজের মেয়ে হবার সত্ত্বেও তাকে সেই অসম বিবাহের দায় বহন করতে হয়েছিল ৷ সম ও অসম সম্পর্কের দায়ভার চিরকালই বহন করে চলতে হয়েছে নারীদের ৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক l শিব দেবশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সেই ক্ষমতা বা ব্যবস্থার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি ।তাই তার ক্রোধের উপহারসরূপ যক্ষরাজের মুণ্ডচ্ছেদ করে থাকেন ৷ ক্রোধ ,হিংসা এই রিপুগুলি আমাদের সৎ ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয় ৷মানুষের  অস্তিত্ব ,আশ্রয় বিপন্ন হলে দেবতা'র পায়ে ঠাঁই নেয় ৷ কিন্তু সেই দেবতাগণ লোভ ,হিংসার উর্দ্ধে উঠতে পারে না । তাই তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যায় দেবতা ও মানুষ সমান্তরাল পথে দাঁড়িয়ে থাকে ৷সেখানে নেই কোন বিভেদ নেই দ্বন্দ্ব ৷যে সমাজব্যবস্থা চলে আসছে অতীত কাল থেকে তার কোন শেষ নেই ৷  হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে-তিন প্রধান দেবতার (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বা মহাদেব) অন্যতম। ইনি স্বয়ম্ভূ। ইনি ধ্বংসের অধিকর্তা। এঁর প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল। ধনুকের নাম পিনাক। ইনি বিশ্বধ্বংসকারী পাশুপাত অস্ত্রের অধিকারী। মহাপ্রলয়কালে ইনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে ধ্বংসের সূচনা করেন।এককথায় ধ্বংসের দেবতা বলা যেতে পারে ৷আবার অপরদিকে ইনি মহাযোগী,সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, নির্গুণ ধ্যানের প্রতীক। একই দেহে দুটো সত্ত্বা বহন করে আনেন ৷ একদিকে ত্যাগী অপরদিকে বিনাশী ৷ রক্তমাখা বাঘছাল নিম্নাঙ্গে ধারণ করেন, কিন্তু উর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন। তবে কখনো কখনো কৃষ্ণসার হরিণের চামড়া উত্তরীয় হিসাবে উর্ধ্বাঙ্গে পরিধান করেন। শরীর ভস্ম দ্বারা আবৃত। মাথায় বিশাল জটা। কপালের নিম্নাংশে তৃতীয় নেত্র, উধ্বাংশে অর্ধচন্দ্র ও কণ্ঠে সাপ ও কঙ্কাল মালা।প্রলয় শেষে ধ্বংসের মধ্য থেকেই তাঁর উৎপত্তি ঘটে। সে কারণে শিব, শঙ্কর বা ভৈরব নামে চিহ্নিত। জনন শক্তির পরিচায়ক হিসাবে শিবলিঙ্গ। এর সাথে যোনি প্রতীক যুক্ত হয়ে প্রজনন বা সৃষ্টিশক্তিরূপে হিন্দু ধর্মে পূজিত হয়। ধ্বংস ও সৃষ্টি উভয়েরই কারণ বলে ইনি ঈশ্বর। সুতরাং শিবের পরিধান এবং চরিত্র অনুযায়ী তাকে যৌনসত্ত্বার প্রতীক হিসাবে দেখা যায় ৷ একদিকে সতীর মত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কৈলাসে তাকে সিদ্ধ, চারণ, কিন্তু গন্ধর্ব এবং প্রমথগণ পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় বাস করতে হত ৷ চিরায়ত এই ব্যবস্থা শিখিয়েছে আমাদের শাস্ত্র । সেই ব্যবস্থা আজও চলে আসছে ৷ যে দেবতা পূজীত হন সৃষ্টির ধারক হিসাবে তাঁর পরিধানের মধ্যে এমন অসলগ্নতা থাকবে কেন ! আসলে এই কেন উত্তর পাওয়া যাবে না ৷কারণ আমাদের এই সমাজ বেআব্রু হতে দেখিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সেই প্রাচীনকাল  থেকে ৷দেবতাগণ সর্বদা অপ্সরা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতনে ৷ সুরা , নাচ, গান আমোদ প্রমোদের মধ্যে থাকতেন এনারা ৷ চারিদকে এত আমোদের মধ্যে থেকেও দেবতাগণ পূজীত হতেন ৷ তার ব্যাতিক্রম শিব ছিলেন না । কিন্তু সতী তাঁর স্বামীকে নিজের প্রাণের থেকে বেশী ভালোবাসতেন ৷ তাই নিজের বাবা ,যার কাছে বেড়ে ওঠা তার মুখে পতীর নিন্দা সহ্য করতে পারেন নি ৷ এই চিত্র শিখিয়েছে ভারতীয় নারীদের ৷ "বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে ৷" পতিসেবা পূর্ণ সেবা ৷ এই হল নারীর অভিধান ৷ সতী সেই নিয়মের বাইরে যেতে পারেনি ৷ তাই সতীর এই দেহত্যাগ আমরা শুধু ধর্মের বেড়াজালে আটকে রেখেছি ৷ কিন্তু তার এই দেহত্যাগ আসলে ধনত্যান্ত্রিক , পূজিবাদ ব্যবস্থার বিপরীতে বলিদান বলা চলে ।সে ব্যবস্থায় পূজিবাদ , প্রতিপত্তি মুখ্য ৷সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সতী নিজের জীবন দিয়ে ৷ এই সমাজব্যবস্থা শিখিয়েছে নারীকে অবলা ভাবতে  । পতী সেবা পরম ধর্ম ৷এটাই শিখিয়েছে আমাদের সমাজ নারীদের ৷তাদের চিরকাল পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করেছে ।অপরদিকে পুরুষ একাধিক মহিলা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকাটা আমাদের সামনে এসেছে ৷ তার দেবতাই হোক কিংবা সাধারণ মানুষ ৷ব্রাক্ষণ সমাজে একজন পুরুষ একাধিক বিবাহ প্রথা প্রচলন ছিল । প্রতিদিন এক এক বউ বাড়ি গিয়ে থেকে চব্য - চোষ‍্য- লেহ্য খেয়ে টাকা ,পয়সা নিয়ে বিদায় হতেন ৷


এই সমাজব্যস্থায় দাঁড়িয়ে  একমাত্র সতী না বহু সতী রক্তপাত করেছে সমাজের বেষ্টনীতে ৷ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি ৷ আর রাখে না ৷ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া ঘটনা কখনও লিপিবদ্ধ হয় না ৷ থেকে যায় সহস্র যন্ত্রণার মাঝে , মনের গহীনে ৷ 


"সৃজন " শারদ সংখ্যাটি দ্বিতীয় বর্ষ দশম সংখ্যায় পড়েছে ৷ "সৃজন " সকল পাঠক , লেখক বন্ধুদের জানাই শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা ৷ভালো থাকুন সবাই ৷ 
পারমিতা চক্রবর্ত্তী

সৃজন 
সম্পাদিকা 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন