সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮

পিনাকী মুখোপাধ্যায়



পরকীয়া
 
“ ধূর ! ভাল্লাগে না ! “ স্মার্ট ফোনটা সজোরে বিছানায় ছুঁড়ে স্বগতোক্তি করে উঠল দিয়া ।
কুরুশ দিয়ে একটা টেবিলক্লথ বুনছিলেন সুনয়না । মৃদু হেসে বললেন , “ কী হল ? মোবাইল আবার কী দোষ করল ? “
ভুরু কুঁচকে ঠাম্মির দিকে তাকিয়ে দিয়া বলল , “ ফেসবুক , হোয়াটস অ্যাপ জুড়ে শুধু পরকীয়া আর পরকীয়া । আর যেন কোথাও কোন বিষয় নেই । একটা ইস্যু পেলেই হল ! এদের কি কারো কোন কাজ নেই ? “
সুনয়নার মুখের হাসি আরও একটু প্রসারিত হল । বললেন , “ তুই বুঝিস পরকীয়ার    মানে ? “
ঠোঁট বেঁকিয়ে দিয়া বলল , “ না বোঝার কী আছে ? বিবাহিত হয়েও অন্য একটা সম্পর্ক প্যারালালি চালিয়ে যাওয়া … “
“ তা তোর কী মত ? সেটা ভালো না খারাপ ? “ জিগ্যেস করলেন সুনয়না ।
এতক্ষণ উপুড় হয়ে পা নাচাচ্ছিল দিয়া । এবার উঠে বসে বেশ উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “ অবভিয়াসলি খারাপ । একটা সম্পর্কে লয়ালিটি থাকবে না ? বনিবনা না হলে সেপারেট হয়ে যাও । তারপর অন্য সম্পর্কে যেতেই পার । কিন্তু একসঙ্গে গোপনে একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া ! আমি জাস্ট ভাবতে পারি না । “
সুনয়না স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন দিয়ার দিকে । বললেন , “ জীবনের সব হিসেব অঙ্ক কষে হয় না রে দিদি । দুয়ে দুয়ে সবসময় চার হয় না । “
“ তার মানে তুমিও পরকীয়াকে সাপোর্ট করছ ? আচ্ছা ধর , তুমি জানতে পারলে মা তার কোন অফিস কলিগের সঙ্গে প্রেম করছে , ভালো লাগবে তোমার ? মেনে নেবে তুমি ? রাগ হবে না ? কষ্ট হবে না ? আমি তো তবে কোন সম্পর্কই রাখব না মায়ের সঙ্গে । “
এবার হেসে ফেললেন সুনয়না । বললেন , “ বাপ সোহাগি মেয়ের কথা শোন ! যদি উল্টো টা হয় ? যদি তোর বাবা অমনটা করে ? “
অপ্রতিভ মুখে দিয়া বলে ওঠে , “ ধ্যাত ! বাবা অমন করতেই পারে না । মা ও পারবে না । আমি তো জাস্ট কথার কথা বললাম । তুমি পরকীয়াকে সাপোর্ট করছিলে তাই … “

হাতের বোনাটা একপাশে রেখে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে সুনয়না বললেন , “ আমি সাপোর্ট করি কি করিনা সে কথা বলিনি । আমি বলছি জীবনটা বড্ড জটিল । চলার পথে  অনেক অনেক বাঁক । কোন বাঁকে কী অপেক্ষা করে আছে কিচ্ছু বলা যায় না । আরও জটিল মানুষের মন । কখনো সে প্রবৃত্তির বশীভূত কখনো সে পরিস্থিতির শিকার । “
তর্কের সুরে দিয়া বলল , “ পরিস্থিতির দোষ দিচ্ছ কেন ঠাম্মি ? পরকীয়া যারা করে তারা প্রবৃত্তির জন্যই করে । “
“ বোধহয় সবসময় তা নয় রে দিদি । একটা ঘটনা বলি তবে । শোনার পরে তুই বিচার করিস । “
গল্পের গন্ধ পেয়ে ঠাম্মির কোল ঘেঁসে এল দিয়া । সুনয়না বলতে শুরু করলেন ।
“ আরতি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল । আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না ওদের । কিন্তু পড়াশুনা খুব ভালোবাসত মেয়েটা । টিউশুনি করে নিজের পড়ার খরচা চালাত । এভাবেই ভর্তি হয়েছিল কলেজে । স্বপ্ন ছিল টিচার হওয়ার ।
“ কলেজে যাওয়া আসার পথে তাকে দেখে পছন্দ করেছিল এক অভিজাত বাড়ির সুচাকুরে ছেলে ।প্রস্তাব এল আরতির মা , বাবার কাছে । দাবি দাওয়াহীন এমন সুপাত্র পেয়ে তাঁরা তো হাতে চাঁদ পেলেন ।আরতির কথা কেউ শুনতেই চাইল না । শিক্ষিকা হবার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল । বিয়ে হয়ে গেল আরতির ।
“ বিয়ের পরে পরেই বউকে নিয়ে বর চলে গেল ভিন রাজ্যে তার কর্মক্ষেত্রে ।বিরাট কোয়ার্টার । অনেক ঠাকুর চাকর । তেমন কোন কাজই ছিল না আরতির । সে ভেবেছিল সুযোগ মত  বরকে বলে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করবে ।
“ কিন্তু তার আগেই প্রকাশ হয়ে পড়ল বরের প্রকৃত স্বরূপ । সে ছিল প্রচণ্ড বদমেজাজি আর সন্দেহপ্রবন । তার ওপর যখন সে ড্রিঙ্ক করত তখন আক্ষরিক অর্থেই অমানুষ হয়ে যেত । কাজের লোকেদের নিয়েও নোংরা সন্দেহ করত আরতিকে । মার খেতে খেতে সারা শরীরে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল আরতির ।
“ বাপের বাড়িতে জানিয়ে কোন লাভ হয় নি । তাঁরা বলেছিলেন অ্যাডজাস্ট করে নিতে । আরতি আর পারছিল না ।সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল যেন । আরতি যখন নিজেকে শেষ করে দেবার কথা ভাবছিল তখনই ঠিকে কাজের মেয়ে একটা চিরকুট এনে দিয়েছিল তার হাতে ।
“ পশ্চিম দিকের বন্ধ জানলাটা খুলে সেদিনই প্রথম চোখাচোখি হয়েছিল তার সঙ্গে । অতলান্ত সেই চোখদুটোতে ছিল সমবেদনা আর নির্ভরতার আশ্বাস ।


“ আরতির বরের সাব অরডিনেট ছেলেটি থাকত আরতিদের উল্টোদিকের ব্যাচেলার’স কোয়ার্টারে । বেশ কিছুদিন পরে আরতি আর সেই ছেলেটা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় । শুনেছি পরে বরের থেকে বিচ্ছেদ নিয়েছিল আরতি । সেই ছেলেটার সঙ্গে বিয়েও হয়েছিল । আর শিক্ষিকা হবার স্বপ্নও সত্যি হয়েছিল আরতির । ওঁদের সম্পর্কটা কোন বাড়ি থেকেই কেউ মেনে নেয় নি । ওরা একলা হয়ে গিয়েছিল । তবে ওরা দুজনে খুব সুখী হয়েছিল । “
নিঝুম হয়ে বসে ছিল দিয়া । সুনয়না বললেন , “ আরতি আর ওই ছেলেটার সম্পর্ককেও  তো পরকীয়াই বলবে লোকে । খারাপও বলবে বেশিরভাগ লোক । আরতি যদি বরের অত্যাচার সহ্য করে থেকে যেত হাসিমুখে তবেই হয়ত সমাজ প্রশংসা করত তার।এবার বল তুই কী বলবি?”
“ আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওঁদের । “ ধরা ধরা গলায় দিয়া বলল  , “ কতটা ভালোবাসা আর উদারতা থাকলে তখনকার সময়ে এমন একটা কাজ করতে পারেন কেউ ! সামনে পেলে ভদ্রলোককে একবার প্রনাম করতাম । “
হঠাৎ বুক নিঙরে কান্না উঠে এল সুনয়নার । রুদ্ধ গলায় বলে উঠলেন , “ ওই তো দেওয়ালে ঝুলছে মালা পড়ান আমার ভগবানের ফটো । যা , প্রনাম করে আয় দাদুকে । “


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন