শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

সুতপা সরকার

রম্যরচনা 
দাম্পত্যে উপবাস 

ছোটো বেলায় মাকে দেখেছি তারপর বোনকেও রাগ হলেই খাওয়া বন্ধ। সে এক করুণ এবং সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি। কাজ কম্ম সবই হচ্ছে, এমনকি রান্নাও। কিন্তু কেউ একজন খাবে না ! বাকিরা কি করে তখন ! খেতেও হবে আবার খাওয়াতেও হবে। কোনোক্রমে সেসব মান অভিমান রাগ বিরাগ পর্ব মিটতো। এখন আর এসব তেমন শুনি না, দেখিও না।
অনেকদিন পর এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে এইরকম গুস্সা-উপবাসের এক মজাদার কাহিনী শুনলাম। আর গোঁসা ঘরে খিল দেওয়া নাকি মেয়েদের একচেটিয়া, কিন্তু তার ব্যতিক্রমও দেখলাম। ভারি আমোদ হলো সেই দাম্পত্য উপবাসের হ্যাপী এন্ডিং কাহিনী শুনে। সুরসিকা বন্ধুটির মতো হয়ত অত সুন্দর করে বলতে পারবো না, তবু বলি জম্পেশ করে জব্দ করেছিলো বটে সে তার একরোখা পতিটিকে।
তিনি ছোটো থেকেই নাকি রাগ হলেই না খেয়ে থাকেন - সেটা তাঁর বাবা এবং বোনেরা ইষত্ গর্বের বিষয়ের মতো করেই ব্যক্ত করে থাকেন, কিন্তু আমার বন্ধুটি তার বিবাহের রজতজয়ন্তী পেরিয়ে তিতি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো পতিদেবতার ঐ গোঁসা উপবাসের জ্বালায়। অনুরোধ উপরোধ কান্নাকাটি সাধাসাধি করে ঐ গোঁসা-ভঞ্জন করতে করতে বেচারী ততদিনে ক্লান্ত। মোটামুটি ত্রৈমাসিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়ে ছিলো সেটা। এমনকি কাছের বন্ধু বান্ধবরাও ওয়াকিবহাল ছিলেন তাঁর কর্তার এই একগুঁয়েমি স্বভাবের ব্যাপারে।
তো, গত বছর এমনি বর্ষার মরশুমে এক সকালে কোনো এক ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বিষয়কে কেন্দ্র করে তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন খাবেন না। সকালের বাজার হয়েছে, মাছ সবজি সব রান্নাঘরে, কিছু কাটাবাছার কাজও এগিয়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে সেদিন বন্ধুটিও হুহুঙ্কার ছাড়লো - খাবে না তো আমরাও খাবো না, রান্নাই বন্ধ !! 'আমরা' বলতে তাঁরা দুজন ছাড়াও আমার বন্ধুটির কলেজে পড়া একমাত্র মেয়ে এবং শ্বশুর মশাই (তাঁদের পারমিশন না নিয়েই অবশ্য বন্ধুটি ঐ গন উপবাসের সিদ্ধান্ত জারি করে দেয়)। দিন গড়ায়, বাড়ি শান্ত, রান্নাঘরে তালা। কত্তামশাই বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরে গম্ভীর মুখে পায়চারি জারি রাখেন, বন্ধুটি ঘরের অন্যান্য কাজ সেরে একা শয্যায় শয়ান। মেয়ে পড়ছে, দেখছে, মজাই পাচ্ছে হয়ত। শ্বশুর মশাই কিন্তু পুরোপুরি আতান্তরে। ততক্ষনে রান্নাঘরে মাছ পচে উঠেছে, সবজি শুকিয়ে গড়াগড়ি। একসময়, খবর পেয়ে সবচেয়ে কাছে থাকা ননদ বাড়িতে এসে হাজির । বেচারীর মধ্যস্থতার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কারণ একমাত্র দাদা তাঁর ছোটোবেলার মতই না খেয়ে থাকার তেজ ছাড়লেন না। অতএব শ্বশুর ননদ হাজার বোঝানো স্বত্ত্বেও আমার বন্ধুটি তাঁর শর্ত থেকে টললো না- খেলে সবাই মিলেই খাবে, তবেই রান্না হবে, নইলে রান্নাঘরই বন্ধ। ননদ অগত্যা তাঁর বাবাকে নিয়ে হাঁটা দিলো নিজের বাড়ি। রান্নাঘরে তালা তেমনই রইলো।
পরের দিন মোটামুটি একই রুটিন, শুধু মেয়ে দুয়েকবার বাইরে গেছে ব্যাগ কাঁধে। ফিরেছে বাড়ি হাসিমুখে, খুব একটা কাহিল লাগছে না তাকে। বন্ধুটির গলার স্বরে সামান্য চিঁচিঁ ভাব, কথাবার্তাও কম। কত্তামশাই রাতে একটু নরমে গরমে বললেন, একি কথা- না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে, কে দেখবে তখন !! তোমরা খাও না !!
তা তো হবে না - বন্ধুটিরও এক কথা। সবাই খাও, রাঁধছি।
ফলতঃ রান্নাঘরের তালা খুললো না।
তার পরের দিন দুপুরে একটু অসময়েই তিনি বাড়িতে এলেন, আমার বন্ধু তখন বিছানায় লীন। মেয়ে বই মুখে বসে (সকালে বন্ধুর বাড়ি গেছিলো)। তিনি উচ্চৈস্বরে বললেন জনান্তিকে - আমি হোটেলে যাচ্ছি খেতে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আমার বন্ধু- আরে দাঁড়াও একটু, আমিও যাবো।
পতিদেবতা 'থ - তুমি যাবে !
যাবো না কেন, তুমি যা খেতে পারবে আমি পারবো না ! চলো এক সাথেই খাবো।
পরের দৃশ্য - ভর দুপুরে বাজারের রাস্তায় গম্ভীরমুখ স্বামীর একটু পশ্চাতে স্ত্রী হাঁটছেন, পরিচিত লোকজনের চোখে একটু অবাক দৃষ্টি। পৌঁছলেন একটি ভাতের হোটেলে। দাদার পরিচিত মালিক (প্রায়শই ওখানে উপবাস ভাঙেন কিনা) বৌদিকে দেখে শশব্যস্ত, কি সৌভাগ্য, আজ আপনিও খাবেন আমার এখানে ! কি খাবেন বলুন।
বৌদি চিকেনের ভক্ত, তাই চিকেন অর্ডার দিলেন। দাদা চাইলেন এক প্লেট ডিম। আপ্লুত মালিক দাদাকে ডিমের সাথে চিকেনও ধরিয়ে দিলেন, বললেন আজ স্পেশাল রান্না হয়েছে, আর বৌদি খাবে- আপনি খাবেন না ! সুতরাং ওপাশ থেকে দাদার প্লেটের ডবল ডিমের একটি উঠলো বৌদির পাতে। মেনু নিয়ে অন্ততঃ মতান্তর রইলো না। দুজনেই মুখ বুজে খেয়ে উঠে দাম মিটিয়ে বেরলো রাস্তায় - দামটা দাদাই দিলেন। আবার কিছু কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে দিয়ে বাড়ি ফেরত। কে একবার ডাকলোও মনে হলো যেন পিছন থেকে, দাদার হাঁটার স্পীড বেড়ে গেল .....
রাতে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন বন্ধুর (চিঁচিঁ নয় আর)- রান্না করবো, না হোটেলেই যাবে ? অপেক্ষাকৃত কম গম্ভীর স্বরে জবাব- মেয়েও খাবে তো, আর বাবা ফিরছেন বাড়ি, রান্না করো।
"ঠাকুর ঠাকুর করে আরেক বর্ষা এসে গেল। আমার বাড়িতে পূজোপার্বন ছাড়া আর কেউ না খেয়ে থাকার নামও করেনি" - বন্ধুর সহাস্য উপসংহার।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন