শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

পুষ্পাঞ্জলি বক্সী

বিসর্জন 
   
       
      জীবনটা যেন বড় এলোমেলো লাগছে আজ।এই আশ্বিনেও মন আকাশে কালবৈশাখীর দাপট।মনের অলিন্দের কপাটগুলি উথাল পাতাল। অথচ বাইরে শিউলি গন্ধে ভরা ঝলমলে শরতের নীল আকাশ।আগমণী বার্তা বয়ে আনছে আশ্বিনের দূর বাতাস।অথচ ভেতরে বিসর্জনের প্রলাপ।স্মৃতি বিস্মৃতির মাঝখানে একটা নড়বড়ে সাঁকোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছি।
      একজনের কথা ভাবতে গিয়ে আরেকজন চলে আসে ভাবনায়।ফুরিয়ে যাওয়া হলুদ পাতার মধ্যে কিভাবে যেন মিলেমিশে গেল একটা সবুজ পাতা। শরীর আর মনের ইচ্ছেগুলো যখন তার কাছে আবছা,অবান্তর হয়ে আসে তখনই ঘনিয়ে ওঠে এক দূরন্ত ঘূর্ণি। সাহসী মন নীল আকাশে ডানা মেলে দেবার স্বপ্ন দেখে।সাহস আসে, প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়। ইচ্ছে ডানা প্রসারিত হয়। 
      কিন্তু তার কথা দেওয়া আছে হিমাণীর কাছে।হাতে হাত রেখে পথচলার জীবনদর্শনে ব্রতী হয়েছিলো তারা।আস্তে আস্তে বড় কঠিন হয়ে উঠলো সেই পথ।ঝড়ের মতো বয়ে গিয়েছিলো দিন, মাস, বছর।অবশেষে সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যেবেলায় যখন জীবনপ্রদীপের সলতেটা শেষবার নেভার আগে দপ্ দপ্ করে জ্বলে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো ঠিক সেইসময় কথা দিলাম জীবনবীণায় বাজাবো না কোনো আগমণী সুর।যে তার ছিন্ন হলো নতুন করে বাঁধবো না সেই তার।বাজাবো না ভৈরবী, মেঘমল্লার।সুরহীন তালহীন জীবন বয়ে বেড়াবার অঙ্গীকার করলাম নিজের কাছে।তুমি চলে গেলে। ক্রমশ একাকী হয়ে পড়লাম আমি।আস্তে আস্তে একা থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হলো।একা থাকতে খারাপ লাগতো না আর। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করেও বেঁচে ছিলাম আমি।
     অবশেষে এলো সেই মুক্ত বাতাস দূরন্ত ঘূর্ণি হয়ে।উড়িয়ে নিয়ে গেল আমার একাকী,বিচ্ছিন্ন, নিস্তরঙ্গ জীবনটাকে। বয়ে গেলাম আমি। ভেসে গেলাম আমি।আসার কথা যেন ছিলই। নিভে যাওয়া প্রদীপে তেল ঢেলে সলতেটাকে আর একটু উসকে দিল।আবার প্রদীপ জ্বলে  চারিদিকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।ক্রমশঃ আমি অন্যজায়গায় চলে গেলাম।এলোমেলো অবিন্যস্ত আমি ঢুকে পড়লাম অন্যঘরে।কিছু কিছু অসফল স্বপ্ন নতুন করে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে চলে গেল কয়েকটা দিন, মাস আর একটা বছর।জীবনের সেই দিনগুলি তার ইচ্ছানুযায়ী কাটিয়ে দিলাম স্বেচ্ছায়। আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধ কোনো নাগ।সাপুড়ের বাঁশির তালে নেচে চললাম।আমার জীবন নৌকায় পাল তুলে দিল সে।ভাটার টানে জোয়ার তুললো।শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন নদীতে ঢেউ উঠলো।অশান্ত নদী মিলনের স্বপ্ন দেখলো।গতি দূর্বার হলো।যেন এই মুহূর্তে মিলিত হতে হবে মোহনায়।সময় নেই বেশি।ফুরোবার আগে আবার পরখ করে নেব একবার নিজেকে। 
      আমি ভালোবেসে তাকে নাম দিয়ে ছিলাম সায়ন্তিকা।ডানাকাটা নয়।কিন্তু চোখদুটি ছিল আশ্চর্য রকমের সুন্দর। গভীরতায় একবার ডুব দিলে আর ফেরা হয়না।আটকে পরে থাকি আমি। দিঘীর অতলে ডুবে উদাসীন হয়ে থাকি।ভুলে যাই নিজেকে। 
    একদিন তাল কাটলো বিন্ এর। নাগের নাচন বন্ধ হলো।সাহসীনি এলো আজ বিজয়ীনির মতো।হাতে ধরা শুভ পরিণয় কার্ড।মুখে সেই অনাবিল হাসি।চোখে স্বপ্নপূরণের আনন্দ। স্বপ্নের পুরুষের সাথে দেখা স্বপ্ন সফল হতে চলেছে সামনের অগ্রহায়ণেই। 
     হঠাৎ মনে হলো এতদিন একটা ঝড়ের পিছনে ছুটে চলেছিলাম । হঠাৎ সেই ঝড় গতিপথ পরিবর্তন করে চলে গেল অন্যকোন দিকে।বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল। তছনছ আর লন্ডভন্ড হয়ে গেল সব।
      বিজয়ীনি চলে গেল যেমন এসেছিলো হঠাৎ ঠিক তেমন করেই। সেই তখন থেকেই আমি  হিমানীর ছবির সামনে।মনে হচ্ছে কাঁচ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসবে ভিতরের মানুষটা।এখন কেমনভাবে নেবে তাকে হিমানী।কথার খেলাপ করে পাপ করেছি। আর সৎ নেই আমি।দুশ্চিন্তায় পরে যাই।যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে এলাম ।পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে হিমানীর বিশ্বাস আবার অর্জন করব পণ করেছি আজ।একটা ভদ্র কাপুরুষ আমি আমার ভারসাম্যহীন শরীরে গরল  মিশিয়ে বিষহীন মন, বিষহীন প্রাণ,বিষহীন জীবন ফিরে পাবো এই আশায়।বোধনেই হোক বিসর্জনের আবাহণ।বাজুক প্রাণে আলোর বেণু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন