শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

শর্মিষ্ঠা দত্ত



বিহারীনাথ 


প্রায় বছর তিরিশ ধরে তাঁকে দেখছি , যদিও সরাসরি আলাপসালাপ হয়নি কখনও । বার্ণপুরে রিভারসাইড রোড থেকেই দেখতে পেতাম তাঁর  অটল গাম্ভীর্য ।  টাউনশিপে বসবাসের সূত্রে রোজই সাক্ষাৎ ঘটলেও সেই বিশাল উচ্চতায় বসে আমার মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষকে চোখেই পড়েনি তাঁর , তাই বোধহয় এতদিন কাছে ডাকেননি ।  তবে এতদিন পরে হঠাৎ কেন ! যাইহোক একবার ডাক দিয়েছেন যখন , আজই মন্ত্রমুগ্ধের মত ছুটে গেলাম তাঁর কাছে । 


আসলে এখানকার বন্ধুবান্ধব অনেকের কাছেই গল্প শুনেছিলাম , ছবিও দেখেছিলাম । দূর থেকে দেখা  ধূসর রহস্যময়তার জাল ছিঁড়ে সাদামাটা আন্তরিক চেহারাটা ক্রমশই টানছিল । তার সঙ্গে কোনো গোপন তন্ত্রীতে বেজে উঠেছিল ' দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ...' আসলে কত দূরে দূরেই তো যাই প্রয়োজনে - অপ্রয়োজনে । কালই শুক্লা হুজুগ তুলল আর আজই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম তাঁর উদ্যেশ্যে । হ্যাঁ তিনি বিহারীনাথ , প্রতিবেশী জেলা বাঁকুড়ার শালতোড়া গ্রামে তাঁর অবস্থান । 


সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ চন্দনদার সুইফট ডিজায়ারে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন । রাস্তা সাকুল্যে আট - ন  কিলোমিটার । রিভারসাইড রোড ধরে লা- মেয়ার পার্কের আগেই ডানদিকে বাঁক নিয়ে দু কিলোমিটার এগোলেই দামোদর । কাঠের তক্তা পেতে তৈরী ব্রিজ পেরোলেই বাঁকুড়া জেলা । মাটির চালা দেওয়া ঘরের পাশে  বাঁশের ব্যারিকেড , সেখানে টোল ট্যাক্স দেওয়া হল - আসাযাওয়া মিলে একশ টাকা । এবার আমরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম । দামোদরের বিধ্বংসী রূপ নেই এখানে , মাঝে মাঝেই বিশাল চড়া । বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় মানুষজন হেঁটেই নদী পারাপার করে । নৌকো চলে বর্ষায় । চড়ায় দু একটা নৌকোকে আটকে থাকতে দেখলাম । হাঁটুজলে পুঁটিমাছের চাষ হয় , জেলেরা জাল ফেলছিল ।  চন্দনদা ড্রাইভ করে ব্রিজ পেরোলেন , আমরা পায়ে হেঁটে নড়বড় করতে করতে পেরোনোর আগেই আর একটা গাড়ি উঠে পড়েছে ব্রিজে । ওপারে পৌঁছে আরো পাঁচ - সাত কিলোমিটার রাস্তা , ঈশ্বরদাঁ আর বামুনতোড় গ্রাম পেরিয়ে , ডানদিকে তিলুরি গ্রামের রাস্তা ছেড়ে খানিকটা এগিয়ে বিহারীনাথের পায়ের নীচে পৌঁছলাম । সামনে মন্দির । বাইরে থেকে পুজোর ডালা কিনে মন্দির চত্বরে ঢুকে ডানদিকে তাঁর অবস্থান । সকাল সাড়ে আটটায় প্রায় ফাঁকা মন্দিরে খুব ভালভাবে ধীরে সুস্থে পুজো দিলাম । শুনেছি এখানে শ্রাবণ মাসে বাবার মাথায় জল ঢালার জন্য  মারাত্মক ভিড় হয় ।  পুরোহিত একটা ছোট্ট ছেলে বড়জোর কুড়ি বছর বয়েস । ঘরের মাঝখানে শিবকুণ্ড , একটা গোল গর্তের মধ্যে শিবলিঙ্গ , তার ওপরে একটুকরো পাথর ...তিনি এখানে মাটি থেকে উত্থিত দেবতা বিহারীনাথ । তাঁর নামেই এই পাহাড়ের নাম , এটি বাঁকুড়ার সর্বোচ্চ পাহাড় । উচ্চতা ১৪৮০ ফুট । মন্দিরের সামনে একটা টলটলে জলের দীঘি রয়েছে । আয়নাজলে দীঘির চারপাশ ঘিরে থাকা দেবদারু গাছের প্রতিবিম্ব । বাঁধানো ঘাট থেকে সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে সবুজাভ জলে । ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ে ওঠার রাস্তার ধারে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা সুন্দর রিসর্ট রয়েছে । বাইরে থেকে দেখলাম । পাহাড়ের তলায় ঘুরলাম কিছুক্ষণ । শুক্লা ব্রেকফাস্ট বানিয়েছিল , লুচি - আলুর দম খাওয়া হল গাড়িতে বসে । মন্দিরের গায়ে চায়ের দোকানে বসে গরম গরম চা খেয়ে  ফটোসেশন শুরু হল । পৌনে বারোটা নাগাদ ফিরে এলাম । একবেলার বেড়ানো একরাশ খুশি এনে দিল । জীবনের কাছে এটুকুই তো চাওয়া !



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন