পেট গুড়গুড় /
সকাল
থেকে খিক খিক খুক খুক হাসিতে পেটটা গুড়গুড় করছে। সিঁড়ির কোণে, বাথরুমে গিয়ে গিয়ে
এগারো বার হেসে এলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। ছাদে উঠে কুঁড়িগুলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে বারোতম
হাসিটা হেসেই ফেললাম! ওমা, আর যায় কোথা – প্রশ্ন উড়ে এলো , “ কি হল হাসছ কেন ?”। কী কেলো ! ধরা পড়েই গেলাম শেষ
পর্যন্ত। গম্ভীর
মুখে নেমে ভাবতে বসলাম, এত গুড়গুড়ে হাসির কী কী কারণ থাকতে পারে আমার। ঘণ্টা দুয়েক ভেবেটেবে কারণগুলোকে
লিপিবদ্ধ করে ফেললাম এই ভাবে –
১) চাদ্দিকে লোকজন বেতাল
রেটে কেস খাচ্ছে অথবা খাওয়াচ্ছে ,
২) আমি একসাথে গণ্ডা
চারেককে মুরগী করতে পেরেছি ,
৩) কবিতা টবিতা আর আসছে
না ,
৪) সারাদিন এফবিতে সময়
কাটাতে পারছি ,
৫) আমার এক চরম শত্রু,
যে কিনা আমার ভয়ে এফবি ছেড়ে পালিয়েছে, তারই উক্তি এটা – আমার সামনের দাঁতগুলো বড়
বড় কিনা, তাই ওমনি হাসি হাসি মুখ দেখাচ্ছে,
৬) শেষ হাসিটা আমিই হাসব
ভেবে আগে থেকেই আহ্লাদিত হচ্ছি ।
না , আমি পাগল-ছাগল বা
বোকাসোকা নই মোটেই । দিব্যি জ্ঞান টনটন করছে । যাই হোক , এখনও হাসির বা পেট
গুড়গুড়ের নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাইনি। পেটের গুড়গুড় ও হাসি চলছেই ...
শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের পরামর্শে
সাইকিয়াটিস্টের কাছে গেলাম একবার। যাওয়ার সময়ে মনে মনে নিজেকে সমানে উৎসাহ দিয়ে
গেলাম, ব্রেভো, ওয়েলডান, ইত্যাদি বলতে বলতে। নিজেকে খুব আধুনিক মনের মানুষ মনে
করছিলাম তখন। কেননা, এই যে যাচ্ছি, আমার একবারও সংকোচ হল না, মনে এলো না – ইসস আমি
কি পাগল নাকি! কারণ, আমি আধুনিক মনস্ক মানুষ, আমার মনে যদি কোনো সংশয় আসে, আমি সেই
মনের জট ছাড়াতে মনের ডাক্তারের কাছে যেতে পিছপা হই না। আমি সত্যিই অত্যাধুনিক হয়ে
উঠছি, বুঝতে পারছিলাম নিজেই! যাই হোক, ডাক পড়লে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। খুব
মিষ্টি করে হেসে ডাক্তারবাবু বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন – আপনার সমস্যাটা
কী? আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ, কখন এই প্রশ্ন আসবে। এবার গড়গড় করে আমার
গুড়গুড়ের কথা বলে ফেললাম। ভেবেছিলাম, উনি বোধহয় অবাক হবেন। তো দেখলাম, ওনার মুখের
একটি রেখাও কাঁপল না। আমাকে দেওয়ালে টানানো একটা বোর্ড দেখিয়ে বললেন, সবুজ আলোটা
দেখতে পাচ্ছেন? আমি তো থ! কোথাও কোনো সবুজ আলো নেই এ ঘরে। আর আমি রঙ-কানাও নই,
তাহলে! শেষমেশ বলেই ফেললাম – নাহ, এই ঘরে কোনো সবুজ আলো নেই। এবার উনি আমায়
জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কী কী দেখতে পাচ্ছেন ওই বোর্ডে ?” আমি আবারো খুঁটিয়ে
দেখলাম। দেখলাম – একটা নিরীহ বোর্ডে একটা সাধারণ হলুদ বাল্বের নীচে আরও কয়েকটা অতি
নিরীহ কাগজ বোর্ড-পিনে গেঁথে ঝুলছে। বুঝতে পারছিলাম না ডাক্তার কী চায়। বোর্ড,
বাল্ব না কাগজ! আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে যাওয়ার ভাণ করে, সপাটে গড়গড় করে যা
দেখলাম তাই বলে দিলাম।
ডাক্তার দেখলাম গম্ভীর মুখ করে খসখস করে
প্রেশকিপশান লিখতে লাগলেন। আমি ভেতরে ভেতরে আরও ঘামতে লাগলাম। এরপর মুখ তুলে উনি
আমায় বললেন, আপনার একটা বিরাট গোলমাল হচ্ছে কোথাও। আমি তুতলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
কো...থাথায়? তো তিনি একটা খুব শক্ত রোগের
নাম বললেন। আমি ওরকম সিনড্রোমের নাম আগে কোথাও শুনিনি। যা থাকে কপালে, এই ভেবে
বলেই ফেললাম, ডাক্তার বাবু – আমি কি আর বাঁচবো না! প্লীজ আমায় বাঁচান!! আমি
কিছুতেই ডিপ্রেশানের ওষুধ খাবো না, কিছুতেই ইলেক্ট্রিক শক খাবো নাআআআআআআ...। এবার
বোধহয় ডাক্তারবাবু ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন, ডোন্ট ওরি,
আপনাকে এসব কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু সপ্তাহে একবার আমার চেম্বারে আসবেন, এসে
আমার সাথে একটু গল্পটল্প করে যাবেন। আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম – ব্যাস এতেই হবে!
একমুখ হাসি নিয়ে তিনি ঘাড় নাড়লেন। আমিও ওনার ফিজ দিয়ে চলে এলাম। পরের সপ্তাহে এলে,
উনি আবার সেই বোর্ড আর সবুজ আলোর খেলায় মাতলেন। এবারও যথারীতি আমি সবুজ আলো দেখতে
পেলাম না। তার পরের সপ্তাহেও তাই, তার পরেও তাই।
হঠাৎ রাতে শুয়ে আমার মাথায় এলো, আরে এভাবে
ডাক্তার ব্যাটা আমায় উল্লু বানাচ্ছে না তো! শুধুশুধু আমার কিছু পয়সা খসিয়ে দিল!
ঠিক আছে আবার গেলে আমি বলে দেবো – হ্যাঁ আমি সবুজ আলো দেখতে পাচ্ছি। ব্যাস যেমন
ভাবা তেমনই কাজ। গটগট
করে চেম্বারে ঢুকে প্রশ্নের অপেক্ষায় বসে রইলাম। অবশেষে প্রশ্ন এলো – সবুজ আলো দেখতে
পাচ্ছেন? আমি উত্তর নিয়েই বসে ছিলাম, ফটাস করে ছিটকে বেরোল উত্তর – হ্যাঁ। আবার
জিজ্ঞেস করলেন, আমি আবার বললাম – হ্যাঁ। এইবার উনি বললেন, আর আসতে হবে না আপনাকে। আপনার রোগ সেরে
গেছে। ঠিক
একমাস পরে এসে আমায় রিপোর্ট করবেন, এর মধ্যে আপনার পেট গুড়গুড় আর করেছে কিনা। আমার
ঠিক বিশ্বাস হল না, তবুও ভাবলাম দেখাই যাক না, কী হয় একমাসে ! একমাসের মধ্যে যখনই
পেট গুড়গুড়ের কথা মনে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের সবুজ আলোর প্রশ্নটাও মাথায়
ধাক্কা মেরেছে। ফলে
পেট আর মাথার ভীষণ ঠোকাঠুকিতে গুড়গুড় আর সবুজ আলো দুটোই ভ্যানিশ! নাহ আমার আর পেট
গুড়গুড় করে না, আর সবুজ আলো দেখার জন্য ডাক্তারের কাছে ফিজ গুনতেও যেতে হয় না।
এই তো এখন আমি দিব্যি সুস্থ । আমি আর
আমার সত্যি-গুড়গুড় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করি না । মিথ্যে কোনো সবুজ আলোও আর তাড়া করে
না। পেট আছে, খিদেও। যেমন
আলো আছে তার স্বমহিমায় । শুধু ওই পেট গুড়গুড় ভীষণ ভাবে মিথ্যে হয়ে গেছে। আর যে মিথ্যে সবুজ আলোর ভয়ে আমি ঠিক
হয়ে গেলাম, সেই সবুজ আলো মাথার কোনো লুকনো ঘরে দপদপ করে জ্বলছে আজও।
সবুজ আলোর ব্যাপারটা বেশ লাগল!
উত্তরমুছুনএসবই ফেসবুক সিনড্রোম
উত্তরমুছুন