শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



হয়ত আমারই কাছাকাছি / 
-----------------------
ম্যানিকুইনটার বয়স হয়ত আমারই কাছাকাছি। অনেক ছোটবেলা থেকেই দেখছি, যবে থেকে এই পথে আসা-যাওয়া। এখন রঙ উঠছে। চিবুকের কাছে বিবর্ণ, চর্মরোগ হ'লে যেমন হয়। অথচ এক কালে খুবই সুন্দরী ছিল। ম্যানিকুইন নিয়ে ফ্যাসিনেশন, ফেটিশ বা যৌনবিকৃতির কথা মনে হ'লে অন্য দিকে তাকান, যেদিকে বাস-অটো চলে। মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার থেকে সহজ প্রতিক্রিয়া একটাই হয় - চোখ বন্ধ করে নেওয়া। ম্যানিকুইনও আপনাকে দেখছে না। পোস্টার থেকে ঋত্বিক, দীপিকা, শ্রদ্ধা - কেউই আপনাদের দেখে না। যাক গে, আসলে আমার ম্যানিকুইনকে যতটা চেনা লাগল, ততটাই চেনা লাগল দোকানের মালিককে। ওদের দোকানটা একসময় খুব চালু ছিল। তখন লোকটা মেনটেইন করা চাপ দাড়ি রাখত। চকচক করত চুল পাতলা হয়ে আসা চওড়া কপাল। দোকানের বাইরেও টু-পাইস কামানোর ব্যবস্থা ছিল।

দোকানের ভেতরে বসে থাকত, কাউকে 'আসুন আসুন' করত না। এখন দেখে বেশ রোগাটে লাগে। মাথায় টাক বেড়ে গেছে। গালের দাড়ি অযত্নে আগাছার মত, দুর্বল। চোখে যে ক্লান্তির ছাপ, তাও বয়সের নয়... লড়াইয়ের, যার থেকে মধ্যবিত্তের মুক্তি নেই। জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে একটা টুলের ওপর বসে থাকে। অভ্যেস ভেঙে 'আসুন আসুন' করতে চায়। অনেক সময়, বলার আগেই হেঁটে চলে যায় লোকজন।  অনেকদিন আগে এক প্রৌঢ়কে দেখতাম, বাড়ির দরজার সামনে এই ভাবে বসে অপেক্ষা করতে... পিওনের জন্য। পেনশনের টাকা নিয়ে আসত পিওন।

ম্যানিকুইন তাকিয়ে আছে দক্ষিণ দিকে, যেদিকে মন্দির। মন্দিরের বাইরে অসংখ্য ধূপ ছাই হয়ে যায়। কাছে হলেও তার গন্ধ এদিকে আসে না। এদিকে ভাসে ফাস্টফুডের গন্ধ। উত্তপ্ত চাটুতে চ্যাপটা খুন্তির ঠোকাঠুকির শব্দ। ভাজা গন্ধে জিভে জল আসে, পাক দিয়ে ওঠে ঘুমনো খিদে। প্রিয় খাবারের স্মৃতি। বার বার খেতে চাওয়ার প্রবৃত্তি। ম্যানিকুইনের খিদে নেই। অথবা অসীম সহ্যশক্তি। কোমরের কাছে আলতো করে ছুঁয়ে থাকা মধ্যমা, পাকস্থালী অথবা অন্ত্রের খবর রাখে না। লাস্যময়ী পুরুষকে বোকা বানাতে জানে। নিজেকে কী বানায় কে জানে। যাদের খিদে-ঘুম আছে তারাও তো অদ্ভুত রকম অবিচলিত, নিরুদ্বেগ, কর্তব্যনিষ্ঠ সারসের মত গ্রীবা হেলিয়ে অপেক্ষমান। সেখানেও তো ফাস্টফুডের ঠং ঠং। বাতাসে গরম তেলে কিছু ছেড়ে দেওয়ার সুবাস। এগরোলের মতই কাগজ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে গোগ্রাসে গিলে চলেছে রাত। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টমেটো কেচাপ। ঠিক কতটা ক্ষতি করে যায় ক্ষতিকারক রঙ... বলতে পারো প্রবৃত্তিমার্গ?

আমি ভীষণ ভাবে চাইতাম - ম্যানিকুইনটাকে শাড়ী পরানো হোক। কেন চাইতাম? সে কথা থাক। একটা টিপ পরালে আরও ভাল লাগত। স্তন, কোমর, নাভি - এ নিয়ে তো কিছুই বলিনি। শুধু একটা টিপ, কপালটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত। আজ শাড়ি নেই, টিপও নেই। যতটা সম্ভব ঢাকা একটা সালোয়ার স্যুট। হয়ত শরীরেও রঙ উঠছে। ঢেকে রাখতে হচ্ছে কুৎসিত চর্মরোগ। বাহ্যিক শ্রী অনেকের কাছেই গৌরবের। তা হ্রাস পেতে থাকলে তাদের মন খারাপ হয়। কেউ কেউ নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে। উজ্জয়িনীর এক  জনপ্রিয় বারাঙ্গনা মা হওয়ার পর নিজের কন্যাকে ঘৃণা করত, তলপেটে প্রসবরেখা তার জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছিল বলে। মাতৃত্ব এই দাগগুলো ছাড়া নাকি আর কিছুই দেয়নি। নিজের মন খারাপ অথবা মনিবের জীর্ণতা সালোয়ার স্যুটের আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যানিকুইন। তার আড়াল করার মত আর কোনও সুগভীর সুরঙ্গ পথ নেই। এক পুকুর মাছের মত খলবল করে ছুটে যায় না শুক্রাণুরা। সবাই মন দিয়ে টিন্টো ব্রাসের সিনেমা দেখছে।

যে মহিলা দোকানের সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, আমি তার পিঠ দেখতে পাই। ব্লাউজের ঘেরাটোপ কাটিয়ে সস্নেহ উন্মুক্ত পিঠ। হালকা বাদামী, সন্ধের আলো পিছলে পড়ে। হয়ত মালিকের পরিচিত। দু'কথা-চারকথা বলতে গিয়ে দু'জনেরই মুখে সৌজন্যের হাসি। আমি অবশ্য শুধু মালিকের হাসিই দেখছি, বাকিটা আন্দাজ। অপরিচিতার শরীরের আদল এক পরিচিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রাথমিক ভাবে নিরুদ্দেশ হই, তারপর ফিরে আসি তিক্ত স্মৃতি আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। আরও একবার কিছু কথোপকথনের মহড়া চলে মাথার ভেতর। হঠাৎ দু'জনের দেখা হ'লে যেসব কথা উঠতে পারে। অনেক বছর ধরেই ভাবি, মহড়া চলে... কিন্তু দেখা হয়নি। সেই অপরিচিতার হাত ধরে একটি পাঁচ-ছ' বছরের ছেলে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে অস্থির হয়, মা'র হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায়। সেই অপরিচিতার মুখ দেখতে পেলাম। একাধিক মৃদু ধমকের পরেও ছেলের টানে ভেসে গেল সে। ভেসে ঢেউয়ের সঙ্গে ফিরে যাওয়া পার্থিব স্মৃতিচিহ্নের মত। আবার আস্বস্ত হ'লাম, মোহ ভঙ্গ হ'ল... এ সে নয়। ভাগ্যিস... এ সে নয়!

একবার ইচ্ছে হ'ল ম্যানিকুইনটার শরীরে নতুন করে রঙের প্রলেপ দেওয়ার অনুরোধ করি। ইচ্ছে করল বলি - শুধু শাড়ীই পরিও, আর কপালে একটা টিপ... যেমন অনেক বছর আগে সাজাতে। কিন্তু দু'হাতে ব্যাগ থাকলে রিকশা ডাকা ছাড়া আর কিছুই পারি না। সেই পরিচিতা আর এই ম্যানিকুইন দুজনেরই জমে থাকা অভিযোগ বাজার ফেরত ব্যাগের ভারের মত ক্রমাগত শুষে চলেছে আমার শরীরের সঞ্চিত শক্তি। আমি পালটা দোষ দিতে দিতে রিকশায় উঠে বসি। বাতাস লেগে বুক হালকা হয়। বুকের বোতাম খুলতে খুলতে বুঝতে পারি - সে সব দিন, স্পর্শ, অভ্যেস একেবারেই ভুলে যাচ্ছে আঙুলগুলো ৷

1 টি মন্তব্য:

  1. অনেকদিন পর ধীরস্থির একটা গল্প পড়লাম। যেটার কাহিনি জীবনের চাক্ষুষ জটিলতা হলেও বিবরণ একটা দারুণ গতি দিয়েছে গল্পটায়।

    উত্তরমুছুন