শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

অণুশ্রী মুখার্জী


গল্পের নাম ::::  মুদ্রা  ::::


ড্রেসিংরুমের আয়না টাও এবার আমাকে উঠতে বলছে  .. কিন্তু আজকের পর  হয়তো আর কখনো এই আয়নার সামনে বসা হবে না.....কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না আয়না টা ছেড়ে..... 
আমি রুদ্রানী ,রুদ্রানী ব্যানার্জী.... সবাই আমাকে রিয়া বলে ডাকে.... আমি একজন নৃত্যশিল্পী.... কিন্তু আজ হয়তো না হয়তো নয় আজই আমি শেষ বারের মতো নাচবো..... আগামীকাল আমার বিয়ের পাকা কথা.. বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে.. আমার উড বি হাসব্যান্ড র নাম শীর্ষেন্দু.. শীর্ষ 

***********************************************
-তুমি কি সোমবার ওখানে যাবে ?
-কোথায় শীর্ষ ?
-কলামন্দির..
-হ্যাঁ আমাকে যেতে হবে ,আমি যাবো ,আমার সপ্ন ....-     -কিসের সপ্ন ?মধ্যবিত্তদের মেয়েদের মতো  সপ্ন দেখো .. যেটা পূরণ করতে পারবে ..... যদি ওখানে গিয়ে নাচলে তোমার সপ্ন পূরণ হয় তবে আমাকে বিয়ে করার সপ্ন ভুলে যাও ....                                                - তোমাকে আমি ভালোবাসি শীর্ষ .... তোমাকে ছাড়া কাউকেই বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারিনা আমি ....    -মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে )   যদি ভালোবাসতে তাহলে আমার সম্মান নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতে না .... কি জানো তুমি ?? নৃত্যশিল্পী !!!!! কিসের শিল্পী তুমি ?ওইসব শিল্পী ফিল্পির  বা**  গল্প আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই... কি মমতা শঙ্কর নাকি তুমি ?? না  না বলো আমাকে ..... নিজেকে কি ভাবো তুমি ? এমন একটা ভাব করছো যে তুমি না নাচলে টিকিট বিক্রি হবে না ....                                                                     -আমি সবসময় তোমার সম্মান নিয়েই ভাবি ,তুমি না একটা শিক্ষিত ছেলে....কি মুখের ভাষা তোমার !আর আমি নিজেকে কোনো বড় শিল্পী ভাবি না ,আমি এই শিল্পের শুধুই একজন একনিষ্ঠ সাধিকা....                    -তাই ????? কি লাভ হয়েছে তোমার এই সাধনায় ??
-লাভ ক্ষতি নয়..... এটা আমার অক্সিজেন.... তুমি কেনো বোঝোনা ?
-রিয়া ,তোমার এই অক্সিজেন আমার কাছে বিষ..... গিয়েছিলাম তো তোমার নাচ দেখতে ওই উত্তর পাড়া ক্লাবের ফাংসানে.... কি বলছিলো সবাই যদি সেটা তুমি শুনতে..... 
-কি বলছিলো ?
-বলছিলো তুমি একটা মাল....... 
আমার খুব খারাপ লাগলো....কান্না পাচ্ছিলো আমার.... কান্না চেপেই ওকে বললাম..
-তুমি চুপ করে রইলে ?ওদের কে একটা চর লাগিয়ে দিতে পারলে না.... 
-না......ওরা তো ঠিকই বলেছে .... তুমি যখন নাচ ছিলে তখন তোমার পুরো শরীর টা নাচ ছিলো .... মেয়েদের শরীরের লম্ফঝম্ফ দেখতে আসে সবাই ..... আর ওটাকে রিয়া তোমার মতো মেয়েরা নাচ বলে ..... ফেসবুকে তোমার নাচের অতো ছবি .... কি প্রমাণ করতে চাও ??তুমি খুব সুন্দরী ?তুমি অনেক বড় মাপের শিল্পী ?? অফিসের গুহ দা কে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন তোমার নাচ দেখতে ..... ওই ছেলেগুলোর কথা সব শুনেছে গুহ দা .. পরের দিন অফিসে গিয়ে সবাই কে বলেছে .... আমি  যাকে বিয়ে করতে চলেছি সে নাচে ..... সবাই মুখ টিপে হাসছিলো ..... চক্রবর্তী দা কি বললো জানো??বললো এবার অফিসের ফাংসানে তোমাকে নাচতে বলবে ..... লজ্জায় আমার....আমার মাথা টা নিচু হয়ে গিয়েছিলো .....  চক্রবর্ত্তী দা চুপিচুপি এসে বললো..শিল্পী হওয়ার যার এতো স্বাধ তাকে বৌ বানিয়ে কি করবি ?? ছিঃছিঃ....
-একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন দিয়ে যদি বিচার করো শুধু তাহলে হয়তো ওরা শিক্ষিত কিন্তু যদি ওরা এইরকম ভাবে আমার নাচ কে বিশ্লেষণ করে থাকে তাহলে ওদের এতো একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন থেকে কি লাভ হলো ?ওদের এই শিক্ষার মূল্যায়ন করতে গেলে আমার লজ্জা করছে....ওরা সবাই ফেল  .... আমি নাচি বলে কি ভালো স্ত্রী হতে পারবো না !এরকম ভাবনা কে তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কি করে সমর্থন করো ?
-দ্যাখো রিয়া এতো কথা আমার ভালো লাগছে না.... তুমি কোনো স্কুলে চাকরি করো তো ঠিকাছে ..এতে আমার মানে আমদের লাভ .... দুজনে মিলে চাকরি করলে  ....খুব তাড়াতাড়ি আমরা গাড়ি বাড়ি কিনে ফেলতে পারবো ....  আমিতো তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি .. তুমি স্কুলের চাকরি করো ....                             -পায়রার পা বেঁধে তাকে উড়তে দিচ্ছো ..... ঠিক যতটুকু তুমি চাও ঠিক ততোটাই সে উড়বে ....  তোমার বেঁধে দেওয়া গন্ডির মধ্যে .... আমার নাচ নিয়ে তোমার মা বাবার কোনো আপত্তি আছে বলে তো আমার মনে হয় না .. তাঁরা তো বেশ ভালো ভাবেই আমার এই সত্তা টাকে এক্সেপ্ট করেছেন.. তোমার মা তো কলা মন্দিরের নাচের অনুষ্ঠানে যাবেন বলেছেন....উনিতো শুনে খুব খুশি.....
-আমার মা বাবা খুব সহজ সরল মানুষ ওদেরকে এই ব্যাপারে জরিয়ে লাভ নেই.... তোমার যদি বাঈজীর মতো নাচতে ইচ্ছে করে নাচো কিন্তু এই ঘোমটার তলায় ক্ষেমটা নাচের গল্প আমাকে করতে এসো না ..
- শীর্ষ...... আর একটা ও কথা বলবে না.. আমি তোমাকে বিয়ে করবো না 
-আমি তোমাকে আর বিয়ে করতে চাই না তোমার মতো বাজারের মেয়েকে.....
আমি ফোন টা রেখে দিলাম.... ঘরে গিয়ে দেখি বাবা ঘুমাচ্ছে কিন্তু তখনই মনে হলো ডক্টর কাকুর কথা.... কোনো রকম উত্তেজনা তে যদি বাবার আর একটা এট্যাক হয় তাহলে বাবা কে আর বাঁচানো যাবে না..... আবার ফোন করলাম শীর্ষ কে পাঁচ বারের মাথায় শীর্ষ ফোন টা তুললো ,
-শীর্ষ আই এম সরি...... এক্সট্রিমলি সরি ...... আমি আর নাচবো না ,আমাকে শেষ বারের মতো নাচতে দাও..... 
ওপাশ থেকে শীর্ষ র অনেক ব্যঙ্গাত্মক উত্তর আসতে থাকলো.... যা আমার খুব  সহজেই স্বাভাবিক ভাবে  প্রাপ্য হওয়ার কথা সেই অক্সিজেন আমি শীর্ষ র কাছে ভিক্ষা পেলাম,শীর্ষ হাসছে..... তাঁর অহং বোধ হাসছে..... সে জিতে গেছে.... 
***********************************************
 -ঘুঙুরের শেষ দড়ি টাও বাধা হয়ে গেছে ,এক এক করে প্রতিটি অলংকার আমার গায়ে উঠেছে যেনো আমি আজ কোনো যুদ্ধে  যাচ্ছি কিন্তু ক্লান্ত সৈনিকের মতো.....আহত  হওয়া  এক সৈনিকের মতো কিন্তু আজই তো শেষ দিন আজ আমি প্রাণ দিয়ে নাচবো যে প্রাণ আর আজকের পর হয়তো .... খুব মনে পড়ছে মায়ের কথা .... মা সেই কোন ছোটবেলায় আমাকে নাচের স্কুলে নিয়ে গিয়ে ছিলো আজ খুব কান্না পাচ্ছে .... মাগো তোমায় যদি পেতাম আজ তাহলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম ,কি কিন্তু মা থাকলেও কি কাঁদতে পারতাম ,ঠিক আজ যে কারণে বাবা কে কিছু বলতে পারিনি ঠিক সে কারণেই হয়তো মা কে বলতে পারতাম না ,এতো বড় আঘাত দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারতাম কি ?? মায়ের মৃত্যুর পর কুট্টি আম্মা কে আমি পাই ..আমার গুরু ..সবাই ওনাকে আন্টি বলে ডাকত তো কিন্তু উনি আমাকে প্রথম দিন থেকে এতো অপত্য স্নেহে বেঁধে রেখেছিলেন ঠিক যেনো মায়ের মতো..... আমি কুট্টি আম্মা..আম্মা বলে ডাকতাম..আমার মা ছিলো না বলেই বোধ হয় উনি আমাকে এই ভালোবাসা দিতেন ,ওনার আদর টা ছিলো ঠিক মায়ের মতনই ..... ওনার কোনো ছেলে মেয়ে ছিলো না তাই হয়তো উনি আমাকে নিজের মেয়েই ভাবতেন ..... কিন্তু আম্মা ও দু মাস আগে মারা গেলেন .... আজ আমি কতো বড় জায়গায় নাচতে চলেছি..... প্রেসিডেন্ট ,প্রাইম মিনিস্টার ,চিফ মিনিস্টার সবাই আসছেন..... আরো কতো বড় বড় গুণী মানুষ রা আসছেন ,  আরো কতো বড় বড় নৃত্যে শিল্পী দের সাথে আমিও নাচের সুযোগ পেয়েছি কিন্তু তোমরা কেউ তা দেখতে পেলে না ..... আম্মা তোমার শিক্ষায় শিক্ষিত আমি ,তোমার দীক্ষায় দীক্ষিত ,আমায় আজ তুমি আর মা মিলে এতো শক্তি দাও যাতে আমি  আমার সর্বস্ব দিয়ে নাচতে পারি..... আজ আমি চোখ বন্ধ করে পায়ের পাতার তালে শুধু আওয়াজ শুনেই চিনে ফেলতে পারি মুদ্রা কে ,সেই মুদ্রা আমার প্রাণের সাথে জড়িয়ে গেছে তাকে আজকের পরে আমাকে ত্যাগ করতে হবে ..... আজ শীর্ষ র মা ও আসবে আমার নাচ দেখতে ..... কতো আবেগের সাথে আমি ওনাকে মা ডাকতে শুরু করেছিলাম ,কিন্তু শীর্ষ যে বললো  যে উনিও নাকি একমত আমার নাচ ছেড়ে দেবার বিষয়ে ,উনি নাকি কোনো আপত্তি করেন নি..... আমার বিশ্বাস হয় না.... কতো আদর করে ওনার হাতের বালা গুলো আমাকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন ,এও বলেছিলেন..বিয়ের পর যদি আমার নাচের অনুষ্ঠানে শীর্ষ নাও যেতে পারে উনি যাবেন আমার সাথে ,বলেছিলেন আজ থেকে উনি আমার মা.... এতো ভালোবাসা আমাকে আবার যেনো হারিয়ে যাওয়া মা কে আবার নতুন করে পাইয়ে দিয়েছিলো ,কিন্তু এসব কি তাহলে সব মিথ্যা ছিলো ?নাহ্ আমি আর ভাবতে পারছিনা....
অবশেষে আমি স্টেজে উপস্থিত হলাম....আজ আমার জীবনের সেরা নাচ টা আমি নাচবো.... আমি নাচলাম..... 
***************
একি হলো কে জানে...... এ কোন নৃত্যে পরিবেশন করলাম আমি ?কি দেখলাম আমি নাচতে গিয়ে মা দূর থেকে হাসছে..... সেই হাসি,চোখে সেই আনন্দাশ্রু ..কুট্টি আম্মা যেনো সেই হাতের ওপর হাত রেখে তাল দিয়ে যাচ্ছে আর হাসি মুখে বলে যাচ্ছে নাচের বোল ...  ..     ..  ওরা আমি নাচছি বলে এতো খুশি হচ্ছে তাহলে আমি নাচ ছেড়ে দিয়ে ওদের আবার হত্যা করবো কি করে ?? আমি পারবো না .....আমার মধ্যে এই শিল্প সত্তা কে ওরাই  তিল তিল করে তৈরী করেছে ,ওদের সৃষ্টি আমি .....আমার শিল্পী সত্তা কে তৈরী করেছে ওরা ..... পারবো না .... পারবো না আমি কিছু থেকেই  নাচ ছাড়তে ......  কোনো মতেই পারবো না ..... বাবা কে আমি বোঝাতে পারবো ঠিক ....বাবা ঠিক বুঝবে.... আমার সাথে মা আর আম্মার আশীর্বাদ আছে আমি ঠিক পারবো .....  আমাকে পারতেই হবে.....হটাৎ আমার মাথায় কেউ একজন হাত রাখলো......আমি পেছন ঘুরে দেখতে গিয়েই দেখি শীর্ষ র মা..আমি কিছু না ভেবেই কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললাম .. 
-আপনাদের কোনো দরকার নেই এই বাঈজী কে ঘরের বৌ করার.....
-একি কথা বলছো মা..... আমি তো তোমায় বলেছিলাম আমিই তোমার মা ,তোমার সাথে আমি আছি মা.... 
-কিন্তু ও যে বলেছে.... 
-ধূর বোকা মেয়ে আমরা কি তোকে কিছু বলেছি ?শীর্ষ যেদিন এ কথা গুলো আমাদের বললো সেদিন আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলাম ,অবাক হয়েছিলাম এই ভেবেই যে আমাদের শিক্ষায় কি কোনো ফাঁক থেকে গেলো যে ও এরকম ভাবে তোর  নাচ কে বিশ্লেষণ করছে !খুব দুঃখ পেয়েছিলাম ,বিশ্বাস কর..... সমাজে সব রকম লোক থাকে ,সবার রুচি ,শিক্ষা সমান হয়না ,আজ যখন তোর নাচের পর ওই গণ্যমান্য ব্যক্তিরা   উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিছিলো ,যখন বিখ্যাত বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী তোর প্রশংসা করছিলো তখন শীর্ষ নিজেই ওর ওই ভুল ধারণার যোগ্য জবাব পেয়ে গেছে..... জানিস আমার পাশের ভদ্র মহিলা আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করলো আমি তোকে চিনি কিনা তখন আমি বললাম তুই আমার হবু বৌমা সেটা শুনে ভদ্র মহিলা যখন তোর প্রশংসা করলেন ,শীর্ষ তখন লাজুক লাজুক হাসছিলো.... মা রে আমিও ছোটবেলায় নাচতাম ,নৃত্যে শিল্পী হওয়ার ইচ্ছে ছিলো ,কিন্তু বিয়ের পর এসে দেখি শাশুড়ি শয্যাশায়ী ,তারপর দেড় বছরের মাথায় শীর্ষ হলো আর সে সময় বিবাহিত মেয়েদের নাচ করা একরকম অপরাধ ছিলো তাই সপ্ন টা সপ্ন ই রয়ে গেলো , কিন্তু তুই এ যুগের মেয়ে ,তোর পাশে আমি আছি ,পারবি না আমার সেই অসম্পূর্ণ সপ্ন পূরণ করতে?? বল্...... কথা দে.... 
-আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম ওনার কথা ,এভাবে একজন প্রকৃত মা ই কথা বলতে পারেন..... নিজেকে ছোট লাগছে ,কতটা ভুল বুঝেছি আমি ,কতো ভালবাসেন উনি আমায়...... কতো ভালো উনি.... আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি মা ,আমি আবার আমার হারিয়ে যাওয়া মা কে খুঁজে পেয়েছি ,ওনার হাত দুটি ধরে বললাম.....
-আমি আমার প্রতিটি মুদ্রা কে সাক্ষী রেখে তোমাকে কথা দিলাম মা ..... আমিই  তোমার সব সপ্ন   পূরণ করবো.....  
(সমাপ্ত )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন