শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

রূপসা দাস

সৃজনশীলতা ও স্বনির্ভরতায় আজকের নারী "
          
                  সেই আদিকাল থেকে আজ অবধি পৃথিবীতে সকল শক্তির উৎস কিন্তু নারী.. নারীদের নিয়ে অনেকে অনেক বক্তব্য প্রকাশ করেছেন বহুবার, কিন্তু নারী জাতি এমনি এক জাতি যাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে সে কথা শেষ কোথায় হবে তা কেউ জানেনা.. পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের চরিত্র নাকি বেজায় জটিল, সাধারণ মানুষদের নাকি সেই জটিলতা কাটিয়ে নারীদের বোঝা সম্ভব না . প্রথমে মেয়ে তারপর বৌ তারপর মা বিভিন্ন চরিত্রে একজন নারী সাবলীল ভাবে অভিনয় করে যায়.. তাঁর পরেও তাকে শুনতে হয়ে নারী হয়ে জন্মানো মহা পাপের.. 
                       একটি ছোট্ট পরী কোনো এক সংসারে আলো হয়ে আসে.. সাধ করে অনেক ভেবে তার একটা মিষ্টি নাম দেওয়া হয়ে.. দাদু ঠাকুমা পিসিরা মুখ ভার করে আছে, বংশের প্রদীপ দাদুভাই এলোনা যে, দিদিভাই কে তাই কোনো রকমে দর্শন করেই চলে গেলেন.. প্রাণের দাদুভাইরা যদি চোর ডাকাত ও হয়ে তবুও তারা নাকি হীরের আংটি, ছেলেদের দাম ই আলাদা এই পৃথিবীতে.. মেয়েরা তো অপয়া, জন্মায় শুধু মাত্র নাকি পরের ঘরে যাওয়ার জন্য.. মেয়ের মা কে সইতে হয়ে নানান অপমান শুধু মাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে.. 
                 মেয়ে বড় হতে হতে শুরু হয়ে আর এক জ্বালা.. সমাজে কিছু অসুর দাদুভাইরা আছে যারা লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিজের বোনের থেকেও ছোট সেই মেয়েটির দিকে, সমাজে অসহায় ভাবে বেঁচে থাকতে হয়ে মেয়েদের..  আর ও একটু বড় হলে, স্কুল এর গন্ডি পেরোবার আগেই শুরু হয়ে তার প্রকৃতির নিয়মে এক শারীরিক যন্ত্রনা.. যে যন্ত্রনা তাকে প্রত্যেক মাসে কষ্ট দেয়. তবে সে মাত্র 4দিনের জ্বালা, নারীরা তো হাজার কষ্টের মধ্যেও হাসতে জানে, বুঁকের মধ্যে সব কষ্ট চেপে রেখে মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে চলতে জানে.. 
           কিছুদূর পড়াশোনা এগোতেই বাড়ির বড়দের হুকুম এবার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে. মেয়েটি তখনো প্রানোচ্ছল, জানেনা বিয়ে নামক শব্দ টা ওর জীবনটাকে কতটা পরিবর্তন করতে পারে.. তখনো সে পুতুল খেলে, পুকুর পারে দৌড়ে বেড়ায়, বোকার মতো হাসে, কষ্ট হলে মায়ের আঁচলে মুখ লোকায়.. সেই মেয়েটি আজ সাজবে কনের সাজে.. ছোট্ট হাত দুটিতে lagbe লাল মেহেন্দি, রোগা রোগা হাত এ পড়বে শাখাপলা, গায়ে লাল পার শাড়ী, মেয়েটি হয়তো ভাবে তা কে সাজানো হচ্ছে পাড়ার যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতার জন্য.. হটাৎ মিষ্টি মুখটায় লাগে চন্দনের ফোঁটা, কপালে জ্বল জ্বল করে লাল টিপ.. পান পাতায় মুখ ঢেকে বরের সামনে আসে, বরের দ্বিতীয় বার বিয়ে, বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁই.. কিন্তু ওই যে ছেলে খুউব ভালো. হীরের আংটি আবার ব্যাকা আর নোংরা !! মেয়েটির সিঁথি জুড়ে লাল সিঁদুর, অপূর্ব সুন্দরী লাগছিস মা আজকে তুই.. তুই যে আমার বাড়ির লক্ষী ছিলিস.. চলে যাবি  কাল আমায় ছেড়ে, কি নিয়ে বাঁচবো আমি?পরের দিন বিদায় বেলায় সে শুধু মা কে একটি কথা জিজ্ঞাসা করলো মা গো তুমি কাঁদছো কেন আমি তো নতুন মায়ের কাছে যাচ্ছি.. তোমার মতোই সে আমায় খাইয়ে দেবে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে, চুল বেঁধে দেবে, ভেবো না মা আমি আবার আসবো তোমার কোলে ফিরে ফিরে... 
                              সব বন্ধন ছিন্ন করে চললো মেয়েটি পরের ঘরে, তবু সমাজ তোমার চোখে মেয়েরা জটিল, মেয়েরা অপয়া!! নারীজাতি কে বোঝা পুরুষদের কাজ নয়.. বিয়ের পর মেয়েটির সব সপ্ন ভেঙে যায় এক নিমেষে, পনের জন্য রোজ তা কে সহ্য করতে হয়ে স্বামীর অত্যাচার,  ঐটুকু মেয়ে যে বিয়ের মানেটাই বোঝেনা তাকে রোজ রাতে সহ্য করতে হয়ে ওই নরপিশাচের অকট্ঠো শারীরিক নির্যাতন.. লাল শাড়ী লাল সিঁদুরএর মতোই রক্তে ভেসে যায় বিছানা.. অসহ্য যন্ত্রণা ছটফট করছে মেয়েটি, শাশুড়ি মা কে বারবার ডেকেছিল সে, কিন্তু কোনো সারা পায়নি.. বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চাই বাচ্চা.. অসহ্য প্রসব ব্যাথা সয়ে জন্ম দিলো.. ছোট্ট মায়ের কোল আলো করে এলো আর এক ছোট্ট সন্তান.. ফুটফুটে একটি চাঁদের কণা, রাজপুত্র.. 
   মেয়েদের ছোট থেকে শেখানো কিছু জিনিস মুখে মুখে কথা না বলা, মানিয়ে চলা, ত্যাগ শিকার করা, মন দিয়ে সংসার করা !! ব্যাস এইটুকু গন্ডির মধ্যে মেয়েদের জীবন আবদ্ধ.. অচেনা পুরুষের সাথে একটা কথা বলা মানেই সমাজের চোখে মেয়েরা চরিত্রহীন.. 
ওরে সমাজ, পুরুষ শাসিত সমাজ তোরা আর কি বুঝবি নারীর মাহাত্ম.. এত কিছুর পরেও নারীদের হতে হবে সৃজনশীল, অশ্লীলতার কোনো ছাপ যেন কোথাও না থাকে.. ধর্ষিতাদের সমাজের চোখে হতে হয়ে ঘৃণার পাত্রী, পড়াশোনা বেশি করলে সমাজের ক্ষতি, স্বনির্ভর হতে নেই মেয়েদের.. তাহলে নাকি বাইরে মন চলে যাবে মেয়েদের.. তারা শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ.. রান্না করা কাপড় ধোয়া, সবার খেয়াল রাখা এইসব তার একমাত্র কাজ.. 
ভগবানকে শুধু একটাই জিজ্ঞাসা নারীরা কি পশুদের থেকেও অধম??  কেন এত কষ্ট তাঁদের জীবনে??  সইতে হয়ে সতীদাহ প্রথার জ্বালা, বিধবা দের হাজার নিয়ম পালন??? তবুও আজ রানী রাসমণি, রামমোহন, বিবেকানন্দ ছিলেন বলে মেয়েদের জীবনে এসেছে নতুন ভোর, নতুন সূর্য, নতুন আলো.. বন্ধ হয়েছে অনেক ফালতু নিয়ম যা পুরুষের তৈরী, কিন্তু যেহেতু তারা পণ্ডিত, তাই তাঁদের কষ্টদায়ক বিধানও মেয়েরা মানতো সবার মঙ্গলার্থে.. বিধবা বিবাহ চালু হয়েছে, মেয়েদের প্রতি অন্যায়ে, অনাচার বন্ধ হয়েছে,  মেয়েরা আজ অনেক এগিয়ে গেছে, পড়াশোনা করছে, সংসার সামলাচ্ছে, চাকরিও করছে, নিজের স্বামীর পাশে দাঁড়াচ্ছে..
শাড়ীর পাশাপাশি এসেছে চুড়িদার, জিন্স টপ, যা এখন মেয়েরা পড়ছে, সৃজনশীলতা বজায় রেখে.. তবে হ্যাঁ অনেকে এই উন্নতির অপব্যবহার করছে.. মেয়েরা আজ গুরুজনদের সন্মান দিতে ভুলে যাচ্ছে, হাতে তুলেছে মদের গ্লাস আর মুখে সিগারেট.. পোশাক এর দিকে তাকানো যায়না.. যা সত্যি অন্যায়ে, কারণ এরা সভ্যতার নাম এ অসভ্যতা করছে, অপমান করছে গুণী মানুষদের বলিদানের কথা.. আজ যাদের জন্য মেয়েরা একটু হলেও ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে পারছে তাদেরকে কখনোই অপমান করা উচিৎ হচ্ছেনা.. 
শহরের পাশাপাশি গ্রামেও শুরু হয়েছে স্বনির্ভর প্রকল্প..  গ্রামের মেয়ে বউরা নিজেদের ফাঁকা সময় কাজে লাগাচ্ছে, বাড়ছে রোজগার, নিজের পায়ের তলার মাটি আজ শক্ত হচ্ছে.. রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল সুভাষ চন্দ্র এর কথায় বারবার উঠে এসেছে দেশের কথা এবং নারীদের আত্মজাগরণের কথা.. মেয়েরা আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,  হচ্ছে রিকশাওলি, ফুচকা বিক্রেতা, সাঁতারু, দাবাড়ু, ক্রিকেটার, ফুটবলার, টেনিস প্লেয়ার, আরও কত কি.. বলে শেষ করা যাবেনা.. 
তবে এবার সমাজ কি বলবে, নারীরা ছলনাময়ী, জটিল, অপয়া???  নাকি যুগে যুগে যেমন দেবী দূর্গা অসুর বধ করেছিল, বেহুলা যেমন যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়েছিলো স্বামীর প্রাণ, তেমন ভাবেই আজও নারীরা সর্বশক্তিমান ই আছে, নারীজাতি এক হলে এই পৃথিবীর সকল পুরুষজাতি তলিয়ে যাবে.. নারী শক্তি সব শক্তির উৎস. . নারীকে অপমান, অবহেলা আজ আর তারা সহ্য করবেনা.. তারা আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, মুখোশ খুলছে বহু মুখোশধারী শয়তানের.. ধর্ষণকারী দের নিজেরা শাস্তি দিচ্ছে.. বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হচ্ছে তারা. 
তাই বলি নারী জাতি শান্ত জাতি, মায়ের জাত এ গড়া. 
নরম ভাবে রাখতে তাঁদের 
কিসের এত জ্বালা? 
নারী সৃষ্টি নারী ধ্বংস নারী শক্তির উৎস, 
সেই নারীকেই মারছিস তোরা, সাংঘাতিক নৃশংস, 
সন্মান আর শ্রদ্ধা দিয়ে করো আপন তাঁদের, 
ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে সকল ঘৃণার আঁধার, 
মা জাতি শান্ত বড় স্নিগ্ধ আবেগ মাখা 
ঠোঁটের কোনে নিটোল হাসি আর আন্তরিকতা বুকের মাঝে রাখা... 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন