শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথের ওপর পথ
------------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়




         পথের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে কত কত মানুষ। সকলের পথ তো এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন পথে তাদের হেঁটে চলা। আমার সামনে কত কত মানুষ। আমার পিছনেও অনেক। আমরা কি সবাই তাহলে এক পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি। কখনোই নয়। আমার পথ সে তো আমারই। আমারই রঙে রঙিন হয়ে আছে সে। আমারই শব্দ দিয়ে সাজানো তার শরীর। আমার জন্যেই কথা বলে ওঠে আমার পথ। 

          আজকের কথা তো নয়। সেই কোন সকালে পথে পা রেখেছি। এখন অনেকটাই বেলা হল। এখনও পথ আমাকে তার বুকের ওপর ধরে রেখেছে। আমাকে পথ একটু একটু করে চিনিয়ে দেয় তার শরীর। আসলে আমি তো পথ চলি না। সবাই যখন দেখে আমি পথ হাঁটছি, আমি নিজেও যখন আমাকে পথের ওপর সচল দেখি তখন সকলের মতো আমারও মনে হয় আমি পথ হাঁটছি। কিন্তু এই চলা তো পথচলা নয়। পথের শরীরকে একটু একটু করে চেনার চেষ্টা। পথের বর্ণমালাকে আপন হৃদয়ে ধারণ করার অভিযান। 

          বর্ণমালা চেনার পর্ব শেষ হলে আমি শব্দ চিনি। কত কত শব্দ। মনে হয় তারা আমার খুব চেনা। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও যেন তাদের দেখেছি বলে মনে হয়। তাদের শরীরের গন্ধও যেন আমার কত চেনা। মনে পড়ে, এ তো পথের শব্দ। কত সময় ধরে সে আমাকে একটু একটু করে সবকিছু চিনিয়েছে। এত সহজে কি তাদের ভুলে যাওয়া যায়? সাহসে ভর করে আমি একটার পর একটা শব্দ সাজাই। অশক্ত বাক্যগুলোর গায়ে দেখতে পাই হিম পড়েছে। অদ্ভুত ভাবে তারা কাঁপে। বুঝতে পারি আমার পা টলছে। এগিয়ে আসে পথ। হাতে ধরে বাক্য ঠিক করে দেয়। আমার খাতা জুড়ে শুধু সংশোধন। আমি বুকে জোর পাই। এক একটি সঠিক বাক্যের উত্তাপ আমাকে হিমশীতল গহ্বর থেকে উঠিয়ে আনে। 

          আমি পথকে ধরতে পারি। একটু একটু করে বাক্যজালে বেঁধে ফেলি পথের শরীর। এখন পথ তো আমার হাতের মুঠোয়। আমি দেখতে পাই পথ নিজেও অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। আসলে আমার গতিপথ দেখেই তার এই স্থিরতা। আমি আমার সাদা ক্যানভাসে বাক্য সাজাই। একটার পর একটা বাক্য। তৈরি করে ফেলি পথের শরীর। 

          আমার পথ সে তো আমারই কথা। আমারই প্রিয় রঙে রঙিন হয়ে আছে সে। আমার কষ্ট কষ্ট কথার মালায় ফুল হয়ে ফুটে আছে সে। কখনও দুপুরের ভীষণ উত্তাপে সে উজ্জ্বল। আমাকেই সে চেনা দেয় আমার মতো করে। 

          কত না মানুষ হেঁটে গেছে পথ ধরে। তাদের মতো করে তারা তাদের পথকে সাজিয়েছে। হয়ত সে রঙকে আমি চিনি। কিন্তু তার ইতিহাস আমার অজানা। আমার অপ্রয়োজনীয় রঙেই সে গড়ে তুলেছে তার পথের আল্পনা। কখনও কোথাও দেখি আমার প্রয়োজনীয় রঙের ছিটেফোঁটা লেগে আছে তার পথের চোখে মুখে। কিন্তু তা দিয়ে তো চেনা যায় না সমগ্রকে।

          আমার আগের মানুষ তার নিজের মতো করে চিনে নিয়েছে তার পথকে। এক পা , এক পা করে রেখা এঁকে গেছে তার পথে পথে। সে রেখার যা অর্থ হয় তা শুধু খুঁজে পাওয়া যায় তারই অভিধানে। সে বিমূর্ত রেখার একমাত্র সমর্থক শুধু সে নিজেই। তার মতো করে সেই রেখার সমীকরণ সঠিক। এই রেখায় সে এতটাই বিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে, চোখের সামনেও সে ওই একই রেখার মিছিল দেখে। দেখতে চায় অন্যের পথেও। সফলতার যে রেখাচিত্র সে সারাজীবন ধরে এঁকেছে সেটাই সে মনে করে সর্বজনগ্রাহ্য রেখাচিত্র। 

          প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব পথের সপক্ষে চিৎকার করে। আমার পথ নিয়ে শুধু আমিই ব্যস্ত থাকি না। কি দরকার আমার অন্যের পথের মূল্যায়নে। প্রতিটি পথ তার নিজের ঘাম, রক্তবিন্দু দিয়ে তৈরি। আমার পথে তোমার পথের সমীকরণ কিছুতেই খাটবে না। আবার এটাও তো সত্যি, আমার পথের ওপর কিভাবেই বা মেনে নি অন্যের পথের শরীর। 

          সেই কবে প্রথম যখন পথের ওপর এসে দাঁড়াই তখন কে-ই বা আমায় চিনত! পথ আমাকে নিয়েছিল তো। একটু একটু তাকে চিনেছি। কত কাছ থেকে গভীরভাবে তাকে দেখেছি। ভালোবেসে ফেলাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যকে অস্বীকার করা -------
" আমি ঠিক পথে হাঁটছিলাম / আর সে ভুল পথে / কিন্তু সে-ও ভাবছিল / সে-ই ঠিক পথে হাঁটছে / আর আমি ভুল পথে ; / কেউ একজন মনে হয় / আমাদের দুজনকে দেখেই / ফিক্ ফিক্ করে হাসছিল । "

          একসময় কত মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলেছে  -------- আমার পথ নাকি ভুল। আমি খুব হেসেছি। পথ কি ভুল হয় কোনোদিন? না, পথ ভুল হয় না। যে পথের জন্য যে যোগ্যতা লাগে ------ এটা তো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। যে পথের জন্য যে কৃচ্ছ্রসাধন ------ মাথায় রাখতে হবে সে কথাও। আমরা যদি সেই সাধনপথে যেতে অপারক হই, পথ আমাকে কেন সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেবে? এ তো ভুল পথের দৃষ্টান্ত নয়। এ আমারই অক্ষমতা। পথের মতো হয়ে আমি পথে হেঁটে যেতে পারি নি। এমনও তো হয়েছে পথ বদলে এসেছে আকাঙ্ক্ষািত সাফল্য। এই সাফল্যও ওই পথের ইতিবাচক দিক নয়। আসলে ওই পথ যা চেয়েছে আমার মধ্যে তা-ই ছিল। আজকের সফলতা সে পথেই।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন