রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

সম্বৃতা দাশরায়


চরণচিহ্ন

 

গীতুমাসি আমার মায়ের বন্ধু । একই স্কুল একই  পাড়ায় বাড়ি হওয়ায়  দুজনের সখ্যতা  বেশ গাঢ় হয়েছিল। কলেজের প্রথম ধাপে উঠতেই  মায়ের বিয়ে দিয়ে দিল আমার রক্ষণশীল  দাদু আর গীতুমাসি কলেজ শেষ করে গেল ইউনিভার্সিটিতে। তবুও   দুই বন্ধুর কিন্তু  বন্ধন অটুটই ছিল। মামাবাড়ি গেলেই গীতুমাসিদের বাড়ি যাওয়া অবধারিত।   লম্বা বিনুনি হাসিমুখ ,ছোট্ট আমাকে টুপ করে  কোলে তুলে  নেওয়া গীতুমাসির  ছবি  মনে গেঁথে আছে আর যেটা আছে,  তিনতলার বিরাট একটা ঘর   যেখানে সিলিংছোঁয়া  দেয়াল আলমারিতে থরে থরে  বই। একটা দেওয়ালে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ছবি । কোনও কোনও শনিবার  রবিবার সন্ধ্যায়  আসর বসত।  গমগমে গলায় গান শুনতে পেতাম সিঁড়ি উঠতে উঠতে । গীতুমাসির বাবা নামকরা উকিল ছিলেন ঐ মফস্বল শহরের ,  রাশভারি মানুষ । তাঁর দরাজ গলার গানে কিছু না বুঝেও  আমার ভেতরটা দুলে উঠত  যেন  । রবিঠাকুরের গান ,মা বলত । ও বাড়ির সবার গানে কবিতায় এমন অনায়াস বিচরণ, এমনকী ক্কচিত-কদাচিৎ বাড়িতে গুনগুন করা আমার সাদামাটা  মা , সেও ঐ আসরে গাইত-- আমার একটি কথা বাঁশি জানে , বাঁশিই জানে   কিংবা ওগো আমার শ্রাবণ -মেঘের খেয়াতরীর মাঝি......
সে গানের   ভালো মন্দ  বলতে পারিনা কিন্তু কেমন মায়ায় আমার ছোট্ট বুকটা ভরে যেত ।
একদিন শুনলাম গীতুমাসির বিয়ে। বনেদি  শ্বশুরবাড়ি, বর মস্ত চাকুরে বিলিতি কোম্পানির, মামাবাড়িতে উত্তেজিত আলোচনা কানে ঢুকে পড়ছে । বিয়ের পর নাকি দিল্লি চলে যাবে বৌ নিয়ে। গীতুমাসির চলে যাবার খবরে মনটা খারাপ হয়েছিল হয়তো ঠিক মনে পড়ে না তবে মা  বন্ধুবিচ্ছেদের কষ্ট পেয়েছিল জানি। 
সেই মফস্বল  শহর দেখল আমরাও দেখলাম রূপকথার সেই বিয়ে। তারপর গীতুমাসির সঙ্গে আর দেখা হয়নি।  স্কুল খেলা বন্ধুবান্ধব  জীবনের অনেকটা জায়গা দখল করে নিচ্ছে , তখন গীতুমাসিরা সিডনিতে ।  স্মৃতির অ্যালবামে ততদিনে ধুলো জমেছে প্রচুর ।
কলেজে পড়ি যখন  , সেই সময় গীতুমাসিরা  কলকাতায় এল ।   চিঠিতে জানিয়ে, ঠিকানা আর ফোন নম্বরও  দিয়েছে। আমাদের তো পুরনো ঠিকানাতেই বসবাস । মা পুরনো বন্ধুর কলকাতায় আসার খবর  পেয়ে খুব খুশি। একদিন মোড়ের ফোন বুথে গিয়ে কথাও বলে এল কিন্তু মনের জমানো কথা তো ফুরল না। মাসি যেতে বললেও অসুস্থ  ঠাকুমা বিছানায়, তাঁর  দেখভাল  সংসারের দায়দায়িত্ব  সামলে মার পক্ষে যাওয়া....
একদিন হঠাৎই  গীতুমাসি চলে এল আমাদের বাড়িতে । বিরাট গাড়িটা আমাদের সরু গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রতিবেশীদের কৌতুহল জাগিয়ে।  চেহারা,  হাবভাবে বিদেশি সৌরভ থাকলেও   গীতুমাসির ব্যবহারের পুরনো উষ্ণতা  মায়ের আড়ষ্টতা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল কোথায়!  আমাকে দেখে মাসির বিস্ময় আর কমে না--  কত বড় হয়ে গেলি বুকুন! হ্যাঁ রে কণা ছেলেকে গান শিখিয়েছিস ? বলতিস যে ?
মা অপ্রস্তুত হাসে , ছাপোষা সংসারে আয় আর ব্যয়ের টানাপোড়েন তো গীতুমাসি বুঝবে না। সেদিন ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করে আটপৌরে  রান্নাঘরে  মায়ের পাশে বসে আড্ডা দিয়ে  ফিরে গেল মাসি । তারপর মাঝেমাঝেই  আসত  দুপুরের দিকে।  গল্পে গল্পে একেকদিন সন্ধে গড়িয়ে যেত ।আমি কলেজ টিউশন থেকে , বাবা অফিস থেকে ফিরলে আরেকপ্রস্থ  জমিয়ে চা এবং  টা সমেত আড্ডা চলত ।  গীতুমাসি কিন্তু কখনও মেসোমশাই বা ছেলেমেয়েদের আনতে না সঙ্গে ।  বাবা মা  বললে , হেসে উড়িয়ে দিত-- দূউউর , ওদের সময় কোথায়? সারাদিন তো যাঁতাকলে ঘুরছে । তোরাই বা কোথায় আসছিস আমার বাড়ি ? কতবার বলি আয়.....তবু তো এলি  না। 
 একদিন   ছুটির বিকেলে   মাকে নিয়ে চলেই গেলাম গীতুমাসিদের বাড়ি । আলিপুরের অভিজাত এলাকায় যেমনটা হওয়া উচিত ঠিক তেমনই চমৎকার বাংলো। কেয়ারি করা ফুলের বাগান , সবুজ লন ডিঙিয়ে  হলঘরে পৌঁছে দেখি যা কল্পনায় ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি বৈভবের চিহ্ন ছড়ানো সেখানে ।  উর্দি পরা  আর্দালি খবর দিল গীতুমাসিকে,  আমাদের  দেখে মাসি একটু চমকে  গেল যেন, ভাবতে পারেনি বোধহয় সত্যিই চলে আসব। তারপর সামলে নিল অবশ্য, হৈচৈ বাধিয়ে দিল একেবারে । ছেলেমেয়েকে  ডেকে আনল । সাহেবি কেতার  ছেলেমেয়ে দুটি মৌখিক আলাপ সেরেই কোথায় অদৃশ্য হল আর দেখলাম না। গীতুমাসির বর  মিস্টার অবনীশ মিত্র একবারও আসেননি সামনে।  প্রচুর  খাবারদাবার সাজিয়ে আনল বাবুর্চি কিন্তু নাহ্, জমল না আমাদের আড্ডা । কি যেন এক অস্বস্তি ঘর জুড়ে। হালফ্যাশানের ঝাড়বাতির চড়া আলো  বড্ড মেকি , দুপাশের ঘরগুলোর দরজায় নিষেধের ভারি ভারি পর্দা । মাসির হাসি ঠাট্টা সবই নিষ্প্রাণ, অস্বচ্ছন্দ  বুঝে উঠে পড়লাম । বেরনোর  আগে বললাম -- এতকিছুর মধ্যে তোমার প্রাণের   ঠাকুর স্থান পেল না মাসি ?   রক্তকরবীর রাজাকে তো নন্দিনী বদলাতে পেরেছিল , তুমি পারলে না ! মা অনেক  চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি আমার অসভ্যতা।  স্তব্ধ ফ্যাকাশে গীতশ্রী মিত্রকে পিছনে ফেলে জোর করে মা কে  নিয়ে বেরিয়ে  এলাম ।
মা ভীষণ দুঃখ পেয়েছিল আমার কথায়  কিন্তু কেন বলব না ? কলেজে পড়ি রক্ত  টগবগে। অত  তাচ্ছিল্য  সহ্য হয়নি  আমার, মাসিই বা কেন বারবার যেতে বলেছিল! নিজের আর্থ সামাজিক অবস্থান দেখাতে?
বুঝিনি ঠিক।
তবে  এরপর গীতুমাসি আর  আসেনি আমাদের বাড়িতে।      
এ পর্ব ভুলেও গেলাম  জীবনের ঝড়ঝাপটার মোকাবিলা করতে করতে।।  পায়ের তলার মাটি  শক্ত করতে গিয়ে বেশ অবেলায় জীবনসঙ্গী পেয়েছি শম্পিকে। দুজনে দুজনকে জেনে চিনে নেব এই ইচ্ছে থেকে নিভৃতবাসে  এসেছি ঝাড়খণ্ডের এই ছোট্ট গঞ্জে ।পরিচিত জায়গা নয় তাই ট্যুরিস্টের উৎপাত কম, শান্ত নিরিবিলি । একটা তিরতিরে নদী , টিলা পাহাড় কয়েকটা আর চারপাশে সবুজ আর সবুজ ।  
সকালে  বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে যাই কোনওদিন পাহাড়ের কাছে।  শম্পিরও খুব পছন্দ হয়েছে জায়গাটা।  একটা গেস্ট হাউসে উঠেছি, বেশ ছিমছাম পরিচ্ছন্ন।  আজ বিকেলে  একাই বেরিয়ে পড়লাম । 
শম্পির  সর্দিজ্বর মতো হয়েছে , বেরতে চাইল না। আজ এখানে  হাটবার শুনে ইচ্ছে হল দেখতে যাবার । 
      নদীর দিকে যেতে বাঁ হাতি রাস্তা ,  গেস্ট  হাউসের কেয়ারটেকার বলে দিলেন ।   বড় বড় গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ । দুপাশে  অনেকটা  জমি সমেত পাঁচিল ঘেরা সাহেবি আমলের বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ি ।  ঝোপঝাড় আগাছা গজিয়ে গেছে একেকটা বাড়িতে , সুন্দর রঙিন ফুলে ভরা বাগানও আছে কোনও কোনও বাড়িতে। সবই বাঙালিবাবুদের বাড়ি  হাওয়া বদলাতে আসত অনেক আগে তখনকার, কেয়ারটেকারের কাছেই শুনলাম । কেউ কেউ এখনও  যত্নে রেখেছে  ,কোথাও আবার পরিত্যক্ত পূর্বপুরুষের বাড়ি।   হঠাৎই   ঝিমধরা বিকেলের নির্জনতা চিরে কানে ভেসে এল -- কোন ভাঙনের পথে এলে ....রবিঠাকুরের গান ! এখানে! এদিক ওদিক তাকিয়ে এগোতেই  গানের বাড়িটা দেখতে পেলাম মানে  যেখান থেকে গান ভেসে এসেছে সেই বাড়ি। কৌতুহলী হয়ে  কখন পায়ে পায়ে ভিতরে চলে এসেছি  খেয়াল করিনি। ঘরটায় ঢুকতেই ঠিক মুখোমুখি দেওয়ালে  ফ্রেমবন্দি   রবীন্দ্রনাথ !  কয়েকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা বসে গলা মেলাচ্ছেন  আর পিয়ানোয় বসে চোখ বুজে  তন্ময় হয়ে গাইছেন যিনি, তিনি আমার অত্যন্ত পরিচিত ! অস্ফুট ডাক বেরিয়ে গিয়েছিল বোধহয় ,গান থামিয়ে গীতুমাসি তাকাল। অপরিচয়ের দৃষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই। অতীতের সদ্য তরুণ  আমি , এখন নুনমরিচ চুলের , ভারি চশমার  প্রৌঢ় । 
          ঘরে উপস্থিত সবার অবাক দৃষ্টি আমার দিকে।  এখানে এরকম কোন পথিক আসে না সম্ভবত ! 
বুকুন ! -- খুশিতে উজ্জ্বল মুখটা, চিনতে পেরেছে  ঠিক! এখন  বসে আছি  বাগানে, বাঁধানো বেদিতে। মনে ভিড় করে আসা প্রশ্নেরা সব উত্তর পেয়েছে।  মেসোমশাই  চলে গেছেন বছর পাঁচেক আগেই। মাসিকে  বাকি জীবন স্টেটসে  কাটাতে রাজি করাতে পারেনি রুষা  ঋভু কেউই । ওদিকে
 পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় মাসির দাদামশাই-এর তৈরি এই বাড়ির সঙ্গে তাঁর শখের পিয়ানো আর রবিঠাকুরের ছবিও এসে পড়েছে গীতুমাসির ঝুলিতে। ব্যস তারপর  চেনা  অচেনা কয়েকজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ধূপছায়া নিকেতন । মায়ের কথা আমাদের সব কথাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেও মাসির  আশ মেটে না ।  মা বাবাকে কিছুদিনের মধ্যেই এখানে নিয়ে আসার প্ল্যানও করে ফেললাম । গল্পে গল্পে  রাত বাড়ছে দেখে উঠে পড়তে হল।  শম্পিকে নিয়ে কাল থেকে  ধূপছায়ার অতিথি হবার কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিল মাসি। মৃদু জ্যোৎস্না ভেজা পথ , কানাভাঙা চাঁদ মায়াবী আলো ছড়ালেও আকাশের এককোণে সন্ধ্যাতারাটি স্থির, প্রত্যয়ী  । সেদিকে চোখ পড়তেই মাসির বলা  শেষ কথাগুলো কানে বেজে উঠল যেন--  বুকুন  তুই বোধহয় সেই অমোঘ শক্তি, যে আমাকে প্রাচুর্যবাসনার অন্ধ গহ্বর থেকে এক  ঝটকায় তুলে নিজের চিরকালীন বৃত্তের সামনে  দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কিন্তু সেই বৃত্তে ঢোকার  দরজাটা খুঁজতে খুঁজতেই অনেকটা সময় চলে গেল রে। তবু আপসোস নেই জানিস, অন্ততঃ এই শেষবেলায় এসে মনে হয় যেন  সেই আলোকময় বৃত্তের  এককোণে ছোট্ট  একটু ঠাঁই পেয়েছি -- মাসির   চোখদুটোয় কি গভীর বিশ্বাস,  চুপ করে রইলাম। বলা হল না , আমার এমন কোনও শক্তিটক্তি নেই কেবলমাত্র  ঈর্ষার  কূট দংশনেই  তিক্ত  ঝাঁঝালো কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম সেদিন। আনমনে ফিরছি... .হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতোই কথাটা  বুঝতে পারলাম।   যে অমোঘ শক্তির কথা বলেছে মাসি সে শক্তি আমি নই, অন্য কেউই নয়। ছোট থেকে সেই যে বাঁশিওয়ালার  চরণচিহ্ন ছড়িয়ে ছিল গীতুমাসির জীবনবৃত্তে ,  স্থূল  বৈভবের অহং-এ  তাঁর ক্লান্তি আসবে  এটাই তো স্বাভাবিক। সেই  বাঁধন থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছে হয়তো ছিলই  শ্রীমতী  গীতশ্রী মিত্র'র । সত্যি এটাই যে সম্পূর্ণ একক প্রয়াসে  তিনি  আবার ফিরে  পেয়েছেন নিজের স্বত্বাকে।  আমি ছিলাম নিমিত্তমাত্র।।
.



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন