অপরাহ্নের পরিচয়
মাকে শেষ যেদিন দেখেছিলাম, মায়ের শরীর জড়ানো ছিল একটা ধনেখালি তাঁতে। শাড়িটার পাড় ছিল আকাশী। আকাশী মায়ের প্রিয় রঙ।
ধনেখালি তাঁতের আঁচলে সুতোর বিনুনি থাকে। মাও চুল সবসময় বিনিয়ে রাখত। বিনুনিটা বিনোতে বিনোতে শেষটা সরু হয়ে যেত বলে মা তা গুটিয়ে গাডার লাগাত। শেষদিন মাকে ধনেখালি শাড়িটা পরিয়ে, চুলের বিনুনিটা খুলে কপালে একটা টিপ পরিয়ে দিয়েছিলাম মনে আছে। মায়ের চোখদুটো বোজা ছিল। মা বোধহয় খুব আরাম পাচ্ছিল। শেষেরদিকে মায়ের চুলে বিলি কাটলে মা আরামে চোখ বুজে দিত। পরে বুঝেছিলাম, মা চির ঘুমের দেশে যাবে বলে মাঝে মাঝে চোখ বুজে অভ্যাস করে নিত সে সময়।
ফ্রিজের ওপর যে থালাটায় মা চিরুণি, গাডার, সিঁদুর কৌটো, পন্ডস ক্রিম, টিপের পাতা, সেপ্টিপিন রাখতো, সেটা এখনো ওখানেই আছে ওগুলো সমেত।তবে গাডারগুলো কয়েকটা গলে গায়ে গায়ে লেগে গেছে। টিপের পাতার টিপগুলোয় ধুলো পরেছে। ক্রিমটা জল কেটে গেছে।
মাকে শেষদিন চুল আঁচড়ে দেবার পর দেখেছিলাম, মায়ের চিরুণীতে মায়ের লম্বা সোজা আধা পাকা আধা কাঁচা এক গোছা চুল লেগেছিল। মাকে নিয়ে ওরা চলে যাবার পর চুলগুলো হাতে নিয়ে মনে হচ্ছিল যদি এগুলো দিয়ে মায়ের ক্লোন বানানো যেত, বেশ হতো।
হ্যাঁ, মা মানে ফর্সা চেহারার লম্বা চুলের শাড়ি পরা একজন। ঠিক তখনি মনে হল, মায়ের ক্লোন যে মায়ের মতো শাড়ি পরবে এর কি মানে আছে? মায়ের ক্লোন মায়ের মতো পন্ডস ক্রিম না মাখলে তার শরীর থেকে মা মা গন্ধটা পাব না যে। মায়ের ক্লোন যদি ছোটো ছোটো চুল রাখা পছন্দ করে তবে তো মাকে আর মায়ের মতো দেখতেও লাগবে না। তবে থাক, ক্লোন বানিয়ে কাজ নেই।
মায়ের চিরুণিতে লেগে থাকা শেষ চুলগুলো মা যে খালি সাবানের বাক্সে জড়ো করতো সেখানে রেখে চুল ভর্তি বাক্সটা ড্রয়ারে রাখলাম। মা ঘরের যেখানে সেখানে চুল পড়ে থাকা একদম পছন্দ করতো না।
মাকে শেষ যেদিন দেখেছি, সেই দিনটা ক্রমশ যত অতীত হয়ে আসছিল আমি তত গোটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে মাকে খুঁজছিলাম।
একদিন দুপুরে ঘুঙুর বাজাতে বাজাতে একটা লোক হাঁক দিল বারান্দা দিয়ে। আমি বারান্দায় বেরোতে লোকটা একটা স্টিলের বাটি আর একটা স্টিলের গ্লাস আমার হাতে দিয়ে বললেন, ' মাসিমাকে বলবেন, পরের দিন এসে জমা চুলগুলো নিয়ে যাব।' 'মা আর বেঁচে নেই', আমি লোকটাকে এ কথাটা বলার আগেই লোকটা চলে গেল।
আমি বাটি আর গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘরে এসে দেখতে লাগলাম। তারপর বাটি আর গ্লাসটা সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে বাটিতে মুড়ি ঢাললাম, গ্লাসে নিলাম চা। এখন আমি মুড়ি দিয়ে চা খাব। সন্ধ্যেবেলা মা মুড়ি দিয়ে চা খেত।
মায়ের চুলের বিনিময়ে কেনা নতুন বাটি-গ্লাসে মুড়ি-চা খেতে খেতে বহুদিন বাদে চেনা সন্ধ্যের মুড়ি-চায়ের মিষ্টি স্বাদ পেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মায়ের শেষ চুলগুলো দিয়ে মায়ের ক্নোন করবো না স্টিলের বাসন কিনে তাতে মায়ের পছন্দের খাবারগুলো রেঁধে খাবো!
কদিন বাদে মায়ের আলমারির পাল্লা খুলে মায়ের শাড়িগুলোতে মুখ গুঁজে কাঁদছিলাম, এমন সময় বারান্দায় ঘুঙুর বাজিয়ে লোকটার ডাক শুনলাম, ' মাসিমা, ও মাসিমা, চুল জমেছে? বিক্রি করবেন? '
আমি কান্না থামিয়ে কাপড় থেকে মুখ তুলতেই দেখি আকাশী কাপড়টায় আমার চোখের জল আর বিশাল একটা চুল। আমি চুলটা ফেলবার জন্য হাত বাড়াতেই ধন্দে পড়ে গেলাম, চুলটা আমার না মায়ের!
খুব মনকেমন করা লেখা
উত্তরমুছুন