সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

মেঘশ্রী ব্যানার্জী

                  



বিজন ঘরে





আয়নার মুখোমুখি হলেই সিঁথির চেরাপথে সোহাগের সাথে অভিজ্ঞতার সহবাস। রূপালি রেখা দিনে দিনে সংখ্যা গরিষ্ঠ। ক'দিন ধরেই ফরসেপটা খুঁজে পাচ্ছি না। বড় বাক্স, ছোট বাক্স, বড় ব্যাগ, ছোট ব্যাগ সব তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ গিয়ে পৌঁছলাম পঞ্চাশ নম্বর সাতকড়ি চ্যাটার্জী লেনের বাড়িতে। 


একতলায় দিনের বেলা আলো তেমন ঢোকে না। তাও ছুটির দুপুরে হাফ পর্দা ফেলা জানলার দিকের খাটে দুটো নরম বালিশে মাথা দিয়ে এলোচুলে শুয়ে থাকতে তুমি। আর আমি ফরসেপ হাতে অপরাধী খোঁজার মতোই প্রখর দৃষ্টি দিয়ে ধরতাম আর কুট কুট করে উপড়ে ফেলতাম তোমার মাথার ছোট্ট ছোট্ট পাকাচুলগুলো।


'পাকা চুল তুললে আরও বেশি গজাবে' এই কথাটা হেন লোক নেই যে আমাদের বলে নি। তবু থোড়াই কেয়ার করতাম? আমার উৎসাহ ছিল তোমার তিন গুন। কারণ প্রতি পাকাচুল পিছু প্রথমে দু'টাকা করে পেতাম। তারপর চুল যখন চক্রবৃদ্ধি হারে পেকেই চলল তখন এক টাকা, পঞ্চাশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, এমনকি শেষে দশ, পাঁচ, এক পয়সায় এসে দাঁড়াল। কই পরোয়া নেহি। আমার লাভের খাতায় তাতেও বেশ ভালোই জমা হত। তখন আবার পাশে ঠোঙা নিয়ে বসতাম যাতে তোলা চুলগুলো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে না পড়ে। হিসেবে আমি বড় পাকা! 


তবে এই হিসেবের খেলাটায় তুমি সব সময় আমার গুণতি ভণ্ডুল করে দিতে। পঞ্চাশটা হয়ে গেলে বলতে সবে ত্রিশ। আর আমিও বুঝে শুনে ছদ্মকোপে ফেলে দিতাম সন্না 'যাও আর তুলে দেবো না'। তুমিও তখন 'লক্ষ্মী মেয়ে সোনা মেয়ে'র বন্যা বইয়ে দিতে। শেষে আমি বুদ্ধি বের করলাম ঢ্যাঁড়া কাটার। চুলের চুলচেরা হিসাবে কাঠের বিবর্ণ দরজার পিছনে চক দিয়ে দাগ টেনে দিতাম। পাওনাগণ্ডা না মেটা অবধি সেই দাগের পরের লাইনে আবার দাগ যোগ হত। হিসাব মিটলে যখন কাপড় দিয়ে মুছে দিতে দাগগুলো তখন দরজার পিঠটা ঘোলাটে সাদা হয়ে থাকত। তার উপরেই আবার নতুন করে দাঁড়ি কাটা হত পরের দিন। 


দাঁড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, ওই দরজার পিছনেই দাঁড়ি কেটে কেটে গুনতে শিখিয়েছিলে। দশ, কুড়ি, ত্রিশ মানেই আগের ন'টা দাগের পেট বরাবর একটা করে ঢ্যাঁড়া। দিনের আলোর ঘরে প্রবেশে যতটা দ্বিধা, রাতের ল্যাম্প পোস্টের ঘষা ঘষা হলদেটে আলোটার ততই উৎসাহ মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ার। আলো নিভিয়ে দিলেও দিব্য দেখা যায় কড়িকাঠ। যেন একটা মস্ত হারমোনিয়াম কেউ উল্টো করে টাঙিয়ে রেখেছে। তখন তো আর মোবাইল অ্যাপে কাউন্টিং শেখার সুযোগ তৈরি হয়নি। কড়িকাঠ একবার সোজা দিকে আরেকবার উল্টো দিকে গুণেই পঞ্চাশ অবধি রপ্ত হয়ে যেত। দুটোর পরে আর দুটো কড়িকাঠ এগোলে চার, আবার একটা পিছিয়ে এলে তিন - সে এক ভারি মজার যোগ-বিয়োগ। মনে মনে রিড চেপে কখনও বা সা-রে-গা-মা! 


সে বছর বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট ওঠার সময়ে উই লাগা কড়ি-বরগা সব ভাঙা পড়ল। বৃষ্টির জল ছাতে ঘর করতে করতে দেওয়াল বেয়ে নেমে এসে নানারকম ছবি এঁকে দিত। সেই ছবিগুলো কোনোটা মেঘ, ফুল, পরী হয়ে, কোনোটা চাঁদের বুড়ি, কোনওটা বা বিরাটাকার দৈত্য হয়ে দেওয়াল বেয়ে ছাত অবধি উঠে যেত। বাড়িটা ভাঙা পড়ার সময় সেই ছবিগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল। যেগুলোর লোহা-লক্করের বাজারে ভালো দাম সেইসব সিঙ্ক পাইপ কল পাম্প ট্যাঙ্ক আগেই বিক্রি হয়ে গেল। কুকুর ঢোকা বন্ধ করতে গলিপথের মুখে যে হুড়কো দেওয়া লোহার গেট, রক ঘিরে আর ওই যে দালানের ওইদিকের দরজা খুলে ছাতে ওঠার আগে ডানদিকের যে মস্ত বড় গ্রিলের দরজা লাগিয়েছিলে - যার এপারে দাঁড়িয়ে ঠায় কল্পনা করতাম বন্দিনী রাজকন্যের জন্য এক রাজকুমার ওই আকাশ পথে উড়ে আসছে - সেগুলোও সব ওরা বিক্রি করে দিল। শুধু দরজাটা পড়ে রইল ভাঙাচোরা স্তূপের উপর। 


ক'দিন পরপর বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ ছিল। সকালবেলা পায়ে পায়ে গিয়ে পড়লাম পুরোনো পাড়ায়। বাড়ি ভাঙার জায়গাটা আর ঘেরা নেই। দরকারও নেই। পুরোটাই ফাঁকা মাঠের মতো। ইতিউতি ভগ্নস্তূপ। তার মধ্যেই তুমি সকালে ভাত ডাল আর ঢ্যাঁড়শভাজা নামিয়ে স্নানে চলে গেলে। আপুমা মাছটা সামলে নিল। তারপর বাবা আর তুমি নাকেমুখে গুঁজে একসাথে বেরিয়ে পড়লে। বিকেলে ফেরার সময় সরাসরি দরজায় আসতে না। গ্রিল বসার আগে খোলা রকে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকতে! পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা। কত বড় হয়ে তবে জেনেছি দু'জনের অফিস দু'জায়গায়। 


ফিরেই জামাকাপড় পাল্টে চা বসাতে বসাতে রাতের রান্নার ফর্দটুকু আপুমার সাথে আলোচনা হয়ে গেল। ঠাকুরের সামনে শাঁখ বাজিয়ে একটা ঢিপ করে প্রণাম ঠুকে নিলে। ধূপের গন্ধটা আজও ধক করে নাকে এসে লাগে। দাদু, আপুমা, বাবার নির্দিষ্ট স্টিলের কাপ। আমার জন্য চা নেই, তবে কাপটা কাচের। দুধে বোর্নভিটা গোলা, সাথে চিংড়ির বড়া। প্রথম খোলের ভাজাগুলোয় আমার অধিকার। মেঝেয় বসে তখন স্কুলের পড়া করছি। তুমি পাশে বাটি রেখে গেলে। মাথায় একটা চকাস করে চুমু। সেদিনও মেঝেতেই বসে পড়ছিলাম। পাশের বাড়ির হাবুকাকু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, "জলকাদার উপর কোথায় বসছ! আমাদের ঘরে এসে বোসো!" শুনেছি কাকুদের বাড়িটাও দর করা হয়ে গেছে। আমি আজ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অতীত দেখছি, আর কাকু দেখছেন ভবিষ্যৎ! 

 

দরজাটার উপর খুব মায়া হচ্ছিল। এই ক'দিনের টানা বৃষ্টিতে আরও ঝুরঝুরে হয়েছে কাঠগুলো। এখানে ওখানে খয়েরি সবুজ ছাপ। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে যুদ্ধে হারা সৈনিকের মতো। কিন্তু এখনও কেমন তেজ!  আগলে চলেছে নিচের ইট কাঠ পাথরের ডাঁইকে। আমাদের সেই চকের দাগগুলো এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। মলিন হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় মিলিয়ে এসেছে। যেন ছোট্ট ছোট্ট শ্বাস নিচ্ছে। এইবুঝি পরেরটা নিতে ভুলে যাবে। কিন্তু আমি ঠিক খুঁজে নিয়েছি। আস্তে আস্তে হাত বোলাই ওগুলোর উপর। ভিজে ভিজে ঠেকে হাত! বৃষ্টির জলই হবে হয়তো! কড়ার গোড়ায় মরচে পড়ে মেটে মেটে রঙ ধরেছে। সেইখান থেকে একসার পিঁপড়ে দল বেঁধে চলেছে। ভেজা কাঠের নির্যাসে জন্ম নিয়েছে একটা উজ্জ্বল সবুজ চারা। তুলতুলে সবুজ কান্ডটা নুইয়ে আছে দুটো কচি পাতার ভারে। মুখটা নামিয়ে লক্ষ্য করলাম, একটা পাতা একটু বড়, আরেকটা ঠিক বাচ্চার মতো জড়োসড়ো হয়ে ঘেঁষে আছে ওর কোলে। দরজাটা আমাদের ভোলেনি। এবড়োখেবড়ো একটা পাথর তুলে দাগ কাটতে গেলাম ওর পাশটায়। দাগ আর পড়ল না। কোন শব্দও হলো না। শুধু একটু দেবে গেল জায়গাটা। 


অঙ্ক তো শিখে নিয়েছি সেই কবেই। শুধু হিসেব মেলানোটা বাকি রয়ে যায়। এখনও দাঁড়ি কাটি। মনে মনে। তোমার জন্মদিনের বয়সটা আর দাঁড়ি কেটেও বাড়াতে পারি না। মৃত্যুদিনের বয়স বাড়ে কেবল। থামাতে পারি না।

1 টি মন্তব্য: