#মাতৃত্ব
-সারাদিনে ঐ ইস্টিশেনে বসে কটা টাকা কামাই করে আনো যে একখানা বাড়তি পেট সংসারে এনে তুলেছ! এত বছরে তো তোমার সে সোহাগী দিদির টিকিটাও দেখিনি। তা মরে গিয়ে এই আস্ত একখান পেটের বোঝা ভাইয়ের ঘাড়ে না চাপালেই কী চলছিল না! আর তোমাকেও বলিহারী, পাড়ার লোকে বলল আর অমনি তুমি ঐ দামড়া ছেলেটাকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে চলে এলে! অফিসে কলম পিষে মাসের শেষে মোটা টাকা তো ঘরে আনো না। করো তো প্লাটফর্মে ভিক্ষা। এই বাতাসী সেই আকাশে সুয্যি ওঠার আগে থেকে হোটেলে মুখে রক্ত তুলে খেটে তোমার আর তোমার দুই ব্যাটার পেট চালায় বুঝেছ। যদি এই বাতাসী না থাকত, তোমরাই না খেতে পেয়ে মরতে। আমার খাটনির পয়সাতে আমি পুষ্যি পুষতে পারব না।
মামা বুঝি নোটনের কান বাঁচিয়ে নোটন যাতে শুনতে না পায়, তাই চাপাস্বরে কিছু বোধহয় বলতে গিয়েছিল মামিকে। মামি তো তাতে আরও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল যেন।
-ওসব নোটন পায়রা আমি পুষতে পারব না। কাল থেকে সাধের ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করতে যাবে। মা মরার অশৌচের বেশে আছে, আমদানি মন্দ হবে না।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে হেসেই অস্থির মামি।
ছিটে বেড়ার ঝুপড়ি ঘরের বাইরের একফালি বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল নোটন। সামনেই রেললাইন। হুহু করা খোলা হাওয়ায় হাতপা অবশ হয়ে আসছে। তার ওপর সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। শুধু আজ কেন, কালকে সকালবেলা বুদোকাকু একটা পাউরুটি খেতে দিয়েছিল, তারপর তো আর কিছু খায়নি নোটন। রোজ দিনের মত কালকেও মা কাজে গিয়েছিল। কাজ বলতে মা বিড়ি বাঁধতে যায়। ইস্কুলে গিয়েছিল নোটন। দুপুরে তো ইস্কুলেই খায়। বাসস্যাণ্ডের উল্টো একটা মার্কেট তৈরি হতে হতে বন্ধ আছে, সেখানেই থাকে নোটনরা। মধুকাকা, হেনামাসিরাও ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার পেতেছে ওখানেই। শুধু ট্যারা লাল্টুকে রোজ দশটাকা করে তোলা দিতে হয়। মা কাজ থেকে ফেরে শেষ বিকালে, তখনই চাল-আলু কিনে নিয়ে আসে। সন্ধে হলেই কাঠকুটো জ্বেলে ভাত ফুটিয়ে নিয়ে, মায়ে-পোয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। ওদের কোন আলোর ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোটুকু ওদের ভরসা। ঐ আলোতে তো আর পড়াশুনো করা যায় না। তাই ভোরের আলো ফুটলেই উঠে পড়তে বসে যেত নোটন। ইস্কুলের মাস্টারমশাইরা বলেন, নোটনের মাথায় বুদ্ধি আছে। একটু ঘষামাজা করলে ওর লেখাপড়া হবে। লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার খুব ইচ্ছা নোটনের। তখন আর ও মাকে কাজ করতে দেবে না ভেবেছিল। নিজে কাজ করে মাকে খুব ভালো রাখবে ভেবেছিল। কিন্তু কাল কোথা থেকে কী হয়ে গেল! এখনও ঠিকমত ভাবতেই পারছে না নোটন।
মিড ডে মিলের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল নোটন। তখনই যতু আর জীবনকাকা গিয়ে খবর দিল, মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রাস্তার লোকজনই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গেই নোটন যখন হাসপাতালে পৌঁছায়, তার আগেই সব শেষ। মা মরে গেছে।
কেমন হতভম্বের মত হয়ে যায় ন'বছরের নোটন। কীভাবে কী যে হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না। মা ছাড়া আর তো কেউ নেই নোটনের!
ওখানেই সবাই বলাবলি করছিল, মা মারা যাওয়ার আগে নাকি বলে গেছে নোটনের এক মামা আছে। তার কাছেই নোটনকে পৌঁছে দিতে বলেছে। এই শহরেই নোটনের মামা আছে, কোনদিনও তো শোনেয়নি নোটন। মামাকে প্রথম দেখল শ্মশানঘাটে। কারা মামাকে খুঁজে নিয়ে এসেছে কে জানে! দাহ কাজ সেরে কাল রাতেই এসেছে মামার বাড়ি। মামি তাকে দেখে থেকেই রাগারাগি করছে। সারাদিনে একটু কিছু খেতে অবধি দেয়নি।
দুটো ছেলে আছে মামার। তারাও কত বাজে বাজে কথা বলছিল সারাদিন। এখন আবার মামা-মামির ঝগড়া হচ্ছে তাকে নিয়ে। মায়ের ওপর ভীষণ অভিমান হয় নোটনের, এইভাবে ওকে একা ফেলে মা কেন যে চলে গেল! মামি আবার বলছে ওকে দিয়ে ভিক্ষা করাবে! মা যে বলত,
কারও কাছে হাত পাততে নেই। ষকী করবে এখন নোটন!
ঘরের ভেতর থেকে থালা বাসনের আওয়াজ পাচ্ছে। মামি ঝগড়া করতে করতেই নিজের দুই ছেলেকে দিচ্ছে। আজকেও খেতে দেবে না নোটনকে! মনটা ভীষণ খারাপ হয় ওর। যেদিকে দুচোখ যাবে সেখানেই চলে যাবে নোটন, তবু কিছুতেই এখানে থাকবে না।
উঠে পড়ে নোটন। কেউ যেন শব্দ না পায় এমন করে পা টিপে টিপে বারন্দা থেকে নেমে আসে। মামা মানুষটাকে ওর খারাপ লাগেনি। ওকে এইভাবে চলে যেতে দেখলে মামা কষ্ট পাবে। অন্ধকারে হাঁটতে থাকে নোটন। এই শহরের রাস্তাঘাট কিছুই তো চেনে না সে! যদি চিনত ফিরে যেত নিজেদের সংসারে। মা না থাকুক, মায়ের ছোঁয়া তো আছে ওখানে।
কী ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে নোটনের। ভীষণ খিদেও পেয়েছে। শরীর আর যেন চলছে না। একটা দোকানের বন্ধ শার্টারে হেলান দিয়ে বসে পড়ে নোটন। ক্লান্তিতে দুটো চোখ যেন বুজে আসছে তার। বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ যেন মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ঘুমটা ভেঙে যায় নোটনের।
আরে এ তো ছায়া পাগলী। ওর ছেলেকে নাকি ছেলেধরায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় ছেলেকে খুঁজে বেড়ায়। কোথায় ওর বাড়িঘর ছিল কিছুই বলতে পারে না। ছেলেকে হারানোর থেকেই বোধহয় ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।
নোটনের গায়ে নিজের ছেঁড়া নোংরা চাদরটা মুড়িয়ে দিয়ে ওকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছে। ঠিক এমন করেই তো মা ওকে জড়িয়ে ধরে থাকত। কাঁদছে কেন পাগলীটা? ওকে কাঁদতে দেখে নোটনেরও যে কান্না পাচ্ছে। মায়ের জন্য ভীষণ মনখারাপ করছে। নোটনকে কাঁদতে দেখে পাগলী আরও জড়িয়ে ধরে ওকে।
-কাঁদে না। আমার লাল্টুসোনা। এই তো তুই তোর মায়ের কাছে চলে এসছিস। আর ঐ দুষ্টু লোকগুলো তোকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না।
কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারছে না নোটন। লাল্টু কে? লাল্টুই কি ওর সেই হারানো ছেলে! নোটনকে কি ও তবে ওর হারানো ছেলে মনে করেছে!
পাগলীকে আর যেন পাগলী মনে হচ্ছে না নোটনের। মাকে যেভাবে পরম নিশ্চিন্তে জড়িয়ে থাকত, ছায়া পাগলীকে ঠিক তেমন করে আঁকড়ে ধরে নোটন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন