রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

গোপা পাল


আজ মা'য়ের বিয়ে


তিন্নি আজ খুব খুশি, মনটা ভরে আছে আনন্দে, অনেকদিনের একটা ইচ্ছা আজ তার পূরণ হয়েছে।

        আজো মনে আছে তিন্নির, যেদিন ওর পাপা চলে গেছিলো ওদের ছেড়ে, তিন বছর ভোগার পর ভয়ংকর ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছিলো ওর পাপাকে ওর বয়স তখন মাত্র ছয়,  মা কেমন যেনো পাথরের মত হয়েগেছিলো তখন, শুকনো খটখটে চোখে যে যা বলেছে শুনেছে, যে যা বলেছে করেছে, নিয়ম কানুন সব শেষ হওয়ার পর রাতে বাঁধ ভেঙ্গেছিলো, ওকে জড়িয়ে ধরে খুব চিৎকার করে কেঁদেছিলো মা, বড্ড অসহায় দেখাচ্ছিলো সেদিন মা কে,

এখন বুঝি , তখন মা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাঁদছিলো, আমার কি হবে ভেবে কাঁদছিলো। না কেও ছিলোনা সেদিন মায়ের পাশে, ঠাম্মা, জ্যেঠু, পিসিরা কেওনা , দাদু দিদুন দুরে থাকতো মাসিকে নিয়ে, তাদের যা আয় তা দিয়ে তাদেরই চলে কোন মতে তাই মায়ের দায়িত্ব তারা নিতে পারবেনা তা ভেজা চোখে সেদিনই জানিয়ে দিয়েছিলো ।

মা কারো সাহায্য সেদিন চায়নি, চেয়েছিলো একটু সাথ, যা কেও দেয়নি, একজন সুন্দরী যুবতী গৃহবধুর পক্ষে একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এই কঠোর সমাজের বুকে সন্মানের সাথে টিকে থাকাটা খুব সহজ ছিলোনা। টাকা পয়সা জলের মত খরচ হয়েছিলো তার পাপার ট্রিটমেন্টে, সব পুঁজি শেষ করে পাপা যখন চলে গেলো তখন মায়ের ভরসা বলতে একটা দোতলা বাড়ী আর কিছু সোনার গয়না। অসহায় বিধবা মহিলাকে সেই ভাবে সাহায্য করার জন্য কেও এগিয়ে আসেনি যদি গলগ্রহ হয়ে যায় সেই ভেবে । দিনের পর দিন মা কে দেখেছে চিন্তায় শুকিয়ে যেতে, নিজে না খেয়ে তিন্নিকে খাইয়ে দিতে কিন্তু কাওকে পায়নি পাশে । পাপাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখেছিলো এক ঘরোয়া গৃহবধু যা তাকে মন থেকে অনেক শক্ত করে দিয়েছিলো।

          প্রায় একটা বছর মা যে কি ভাবে চালিয়েছিলো মা ই জানে, শাড়ীর ফলস, পিকো করা, ব্লাউজের হুক লাগানো, শাড়ী, নাইটি বিক্রী করে, আধ পেটা খেয়েও যখন দিন চলতো না তখন হাত পরতো গয়নায়।
এমন সময় আমাদের পাশে দেবদূতের মত এসে দাঁড়িয়েছিলো তমাল আঙ্কেল। না পূর্ব পরিচিত কেও নয়, মা যেখান থেকে শাড়ী নিতো বিক্রী করার জন্য সেখানেই পরিচয়। প্রায় সবাইকেই মা বলতো একটা চাকরীর জন্য, তমাল আঙ্কেলকেও বলেছিলো, আর অদ্ভুতভাবে তমাল আঙ্কেল একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলো মাকে। ছোটখাটো কাজ হলেও তা মাকে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিলো ।

তমাল আঙ্কেল ই মাকে বলেছিলো বাড়ীটা বিক্রী করে ছোট ফ্ল্যাটে উঠে যেতে, সেখানে নিরাপত্তা অনেক বেশী আর ফ্ল্যাট কেনার পরেও বাড়ী বিক্রীর কিছু টাকা থেকে গেছিলো যা ছিলো মা'র ভরসা ।


তমাল আঙ্কেল কবে যে আঙ্কেল থেকে কাকু হয়েগেছিলো তিন্নির কাছে আর আপনি থেকে তুমি হয়েগেছিলো মায়ের কাছে মনে নেই তিন্নির। শুধু মনে আছে কাকুই তখন তাদের একমাত্র ভরসা, যা কিছু বিপদ আসুক না কেনো কাকু পাশে এসে দাঁড়ালেই মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যেতো। আর শুধু বিপদ কেনো কারণে অকারণে সব সময়ই পাশে থেকেছে সে, অবিবাহিত, অনাথ, শান্তশিষ্ঠ একলা মানুষটা নিজের সবটুকুই উজার করে দিত তাদের কাছে।

তিন্নির চোখের কোনে একফোঁটা জল এলেও যেনো তার বুক ফেঁটে যেতো। তিন্নির সব আবদার তার কাছেই। এই জন্য মা বকতো অনেক সময়, সব সময় কাকু মায়ের কথা শুনলেও এই ক্ষেত্রে কাকু সোজা বলে দিতো "এটা আমাদের মা বেটার ব্যাপার, এতে তুমি নাক গলিয়োনা"।। বাবা না থাকার দুঃখ কাকু অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু তবু মা মাঝে মাঝে কেমন যেনো দূরে দূরে থাকতো কাকুর থেকে। হাজার রাত হয়ে গেলেও কাকুকে ফ্ল্যাটে থাকতে দিতনা, টাকা পয়সার সাহায্য নেয়নি কোনদিন, কোথাও বেড়াতে গেলে কাকুকে সঙ্গে নিতনা আর কাকু যদি আমাকে কোথাও নিয়ে যেতো তাহলে মা যেতোনা আমাদের সঙ্গে। একটাই কথা লোকে কি বলবে.....

একটু বড় হওয়ার পর তিন্নি বুঝলো যে এই লোকরাই হচ্ছে সমস্যার মূলে যা কাকুকে পুরোপুরি তাদের সঙ্গে থাকতে দিচ্ছেনা। একদিন সে তমালকে জিজ্ঞাসা করে যে কেনো সে ওদের সঙ্গে থাকেনা, উত্তরে কাকু বলে যে সেও চায় ওদের সঙ্গেই থাকতে কিন্তু ওই যে ওর মা বলবে লোকে কি বলবে তাই পারেনা। মাকে একি প্রশ্ন করায় মা বলেছিলো "তুই এখনো অনেক ছোট আছিস, বড় হলে বুঝবি , চাইলেই সব কিছু হয়না" । সেদিন তিন্নি এইটুকু  বুঝেছিলো যে তার মানে মা'ও চায়, মনে মনে সেদিন তিন্নি প্রতিজ্ঞা করে যে এই দুজনার চাওয়াটাকে সে একদিন পূর্ণ করবেই ।

আজ তিন্নির মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেড়িয়েছে, শত বাঁধা, প্রতিকুলতা সত্বেও আজ সে স্কুলে নবম হয়েছে। সবাই আজ খুব খুশি, মা ঠাকুরের সামনে বসে কেঁদেই যাচ্ছে।  কাকু এক হাঁড়ি মিষ্টি এনে তিন্নিকে বলেছে যে সে যা চাইবে আজ তাই পাবে,

" সত্যি তো যা চাইবো তাই দেবে?"

"তুই শুধু একবার বল মা?"

"তোমার পদবীটা আমার চাই, পারবে দিতে?"

"তিন্নিইইইইই" চিৎকার করে ওঠে মা, বলে "অনেক বড় হয়েগেছিস তাইনা? পাকা পাকা কথা, আমরা একটা সমাজে থাকি, এর কিছু কায়দা কানুন আছে, লোকে কি বলবে? কি করে মুখ দেখাবো আমি ?"

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কাকু।

আমার যা লাগবে আমি তাই চেয়েছি মা, আর এমন তো আগেও হয়েছে মা, তুমি প্রথম করছো এমন নয়, আজ যদি পাপার জায়গায় তোমার কিছু হয়ে যেতো, পাপাকে কি ঠাম্মা আবার বিয়ে দিয়ে দিতোনা? পাপাও করে নিতো মা আমি ছোট সেই দোহাই দিয়ে, তখন কি লোকে কিছু বোলতো?
কিসের জন্য তুমি এত কষ্ট করছো ? সেই ছোট্ট থেকে দেখেছি একা একা কি অমানসিক পরিশ্রম তুমি করেছো পাপাকে বাঁচাতে, তখন কোন লোক এসেছিলো মা?

যখন তোমার পড়াশোনার ইচ্ছাকে মাটিতে মিশিয়ে জোর করে দাদুন তোমার অপছন্দের লোকের সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছিলো তখন কোন লোক এসেছিলো মা?

যখন একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে, অভুক্ত থেকে, লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছো তখন কোন লোক এসেছিলো ?

আমি জানি তুমি কাকুকে আর কাকু তোমাকে ভালবাসে কিন্তু এই লোকে কি বলবে তাই তোমরা দুজনাই কষ্ট পাচ্ছো আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছো। শুধু লোকের কথাই ভাবলে মা,  যারা তোমার জন্য কিচ্ছু করেনি আর কাকুর কথাটা একবারো ভাবলেনা তুমি, যে আমাদের জন্য এতকিছু করলো? তুমি কি ভাবো এখন লোকে কিছু বলেনা কাকুর এই আমাদের বাড়ী আসা যাওয়া নিয়ে? আমাদের জন্য তার কনসার্ন নিয়ে? বলে মা বলে, সেটা তুমিও জানো।

আমার ভালো লাগেনা তোমাকে এই হাল্কা রংয়ের শাড়ীতে দেখতে, আমার ভালো লাগেনা এই অসম্পূর্ণ পরিবারকে দেখতে, পাপার কথা আমার আর বলতে গেলে মনে পরেনা মা, কাকু সেই জায়গাটা অনেকটাই পূর্ণ করেছে। তুমি তো জানো মা আমার বাইরে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা কিন্তু আমি তোমায় একা কার ভরসায় রেখে যাবো মা? আমি না থাকলে লোকে কি বলবে এই ভেবে তো তুমি কাকুকে ডাকবেনা,  ভগবান না করুক তোমার যদি কিছু হয় আমি কি করবো বলোতো? তুমি চাওনা মা আমি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করি? তুমি চাওনা একটু ভালো থাকতে? না হয় একটু দেরী করেই সই খুশি তোমার দরজায় এসেছে মা, তাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমার জন্য অনেক অনেক কষ্ট করেছো তুমি, আবার না হয় আমার জন্যই একটু কষ্ট করো ?

কান্নায় ভেঙ্গে পরে মা, তখন কাকু বলে "তিন্নি থাক"

"না কাকু, আজ না বললে আমার আর বলা হবেনা, আমি তোমাকে আমার বাবা ভেবেই নিয়েছি আর মা মুখে না বললেও আমি দেখেছি তোমার শরীর খারাপ হলে মা কে কষ্ট পেতে, তোমার জন্মদিনে মন্দিরে পুজো দিতে, তোমার পছন্দের খাবার রান্না করতে, উঠতে বসতে তোমার গুণ গান করতে.....

আহ্ তিন্নি

মাগো তোমার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি, তোমার কথা আমি রেখেছি, মন দিয়ে পড়াশুনো করেছি এবার তুমি আমার কথা রাখো?

আমিও কিছু চাইনি তোমার কাছে কোনদিন, আজ একটা ছেলে তার মা কে চাইছে, ফিরিয়ে দেবে তুমি?

না, ফেরাবে সেই সাধ্য মা'র ছিলোনা কারণ মা কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায়নি আমার কথা ভেবেই, যদি আমার সাথে কেও সৎ মেয়ের মত ব্যবহার করে তাই, আজ মা সেই চিন্তা থেকে মুক্ত।

মায়ের মুখে শুনেছি ছোট বেলায় নাকি আমি খুব কাঁদতাম এই বলে যে কেনো মা নিজের বিয়েতে একা গেছিলো? কেনো তিন্নিকে নিয়ে যায়নি মায়ের বিয়েতে? আজ সেই খুশির দিন, নিজের হাতে সাজাবে মা কে আজ , অনেক কষ্ট সহ্য করেছে মা, আজ তিন্নি দেবে মা'য়ের বিয়ে আর লোকে দেখবে ..... 



1 টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লিখেছো। স্টিরিওটাইপ সামাজিক চিন্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিজের খুশির অধিকার কেড়ে নিতে। এমন লেখাই পাল্টাবে একদিন সমাজ কে। তোমার গল্পের চরিত্রে্র মতো বাস্তব চরিত্র গুলি ভালো থাকুক এভাবেই।

    উত্তরমুছুন