মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

তুষ্টি ভট্টাচার্য


                           প্রিয় বৃষ্টিকে লেখা চিঠি  


                                                                                         ২৩/৪/২০১৭
                                                                                         --------------

প্রিয় বৃষ্টি,                                                                                 
         কেমন আছ তুমি? অনেকদিন তোমার সঙ্গে মুখোমুখি কথা হয় না। তুমি আমাকে আকন্ঠ ভিজিয়ে দেবে, আমি ভিজতে ভিজতে হেসে উঠব, গুনগুন করব, আর তুমি হয়ত আরও জোরে নেমে পড়েছ ততক্ষণে। আমাকে আরও ভিজিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে, দুষ্টুমি নিয়ে। ভিজতে আমার ভালই লাগে, সে তুমি জানই। শরীর খারাপের কথা মনে রাখি না তখন। কিন্তু সব সময়ে যে ভেজা যায়, তা তো না! ঘরের মধ্যে বসে বৃষ্টির শব্দ শোনাও দারুণ রোমাঞ্চের। শুনেছি টিনের চালে তুমি যখন খামখেয়ালে ছিটকে পড়, সেই পড়ার শব্দ শোনা নাকি এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা আমার হয় নি, এটাই আফসোসের। সে যাক, সব কিছু যে পেতে হবে এমন তো না। কিছু না-পাওয়া থাকা ভাল জীবনে। কখনও কখনও মাঝরাতে তোমার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে চুপ করে শুনি তোমাকে। নিস্তব্ধ রাতে ঝড়ের সঙ্গে তুমি এলে যেমন এক ভয় মিশ্রিত অনুভূতি আনে, মনে হয় এই তোমাকে আমি চিনি না। তুমি এত ভয়াল, এত দুর্দম আগে জানতে পারি নি তো! তোমার এত এত রূপ দেখতে দেখতে ভাবি, আমি এক সামান্য মেয়ে, তোমার এই বহুরূপের সঙ্গে আমার সখ্য হল কী করে! আবার হালকা ভাবে তুমি যখন ঝরে পড়, তখন মনে হয় তুমি যেন ফিসফিস করে আমার কানে কিছু বলতে চাইছ। সে এমন কিছু গোপন কথা, যা আমাকে ছাড়া তুমি কাউকেই বলতে পারবে না। অথচ, আমি কেন যেন বুঝতে পারছি না তোমার কথা। কিছু শব্দ শোনার বাইরে থেকে যাচ্ছে, অধরা থেকে যাবে বলেই যেন ওরা এসেছে। আমি তখন অস্থির হয়ে পড়ি, জানলার কাছে গিয়ে কান পেতে থাকি তোমার সব কথা শুনবো বলে। কিন্তু তুমি যেন কেমন গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে ততক্ষণে। ধীরে ধীরে তুমি চলে যাও, তোমার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরে আমি একলা হয়ে পড়ি। তোমার অনুপস্থিতি আমাকে নিঃসঙ্গতা দেয়। আর তারপর থেকেই শুরু হয় আমার অপেক্ষা।
    সে এমন এক অপেক্ষা, যার অর্থ তুমিও বুঝবে না। প্রতিটি ঋতু, প্রতিটি দিন-রাত, সন্ধিক্ষণ জুড়ে আমার অপেক্ষা পড়ে থাকে। এই অপেক্ষার মধ্যে তোমাকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে যেমন থাকে, না-পাওয়ার দুঃখ তেমন থাকে না। আমি জানি, তোমাকে ডাকলে তুমি চলে আসবে এক ছুটে। যখন তখন আমি তোমায় ডাকি না, তোমারও তো নিজস্ব অভ্যেসে থাকার স্বাধীনতা আছে, যখন তখন কাউকে ডাকতে নেই। যখন মন চাইবে, তখনি তা পেতে নেই। তীব্রতা হারিয়ে যায়, টান কমে যায়। তাই আমি এমন সময়ে ডাকি, যখন তোমাকে পাওয়ার আকুলতা আমাকে পেরে ফেলেছে, আমার ভেতরের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, এক ফোঁটা জলের জন্য আমার গলা, জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে কন্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময়ে আমি তোমাকে ডাকি। আর তুমিও আমার তেমনি বন্ধু, যে কখনই আমাকে ফেরায় নি, আমার ডাক শুনে একবারের জন্যও আমার কাছে না এসে পারে নি, আমার প্রাণের ভেতরে প্রাণ দিয়ে গেছে, গান দিয়ে গেছে। আমার কৃতজ্ঞতা এতটাই তোমার ওপর যে সারা জীবন ঋণী হয়ে থাকতে হবে তোমার কাছে। আর এও ঠিক, তুমি আমার তেমনই বন্ধু, যার কাছে মুখ ফুটে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় না আমাকে। কারণ তুমি লজ্জা পাবে, কুন্ঠায় হয়ত আর আমার কাছে আসবেই না। তাই আমি তোমার জন্য সঞ্চিত আমার সমস্ত অনুভূতিগুলোকে মনের ভেতরেই রেখে দিই। তুমি বুঝে যাও আমার না-বলা কথা, আমিও বুঝে নিই তোমার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি, দুটোকেই।
     শুনেছি, যে কোন সম্পর্কের মধ্যে একটু মান-অভিমান, খুনসুটি, ঝগড়াঝাঁটি না হলে নাকি সম্পর্কের মধুরতা থাকে না। আমাদের অবশ্য তেমন প্রকাশ্য ঝগড়া হয় নি কখনও। তোমার আসতে দেরী হলে একটু আধটু অভিমান আমি লুকিয়ে ফেলি নিজের মধ্যে। আবার তুমি এলে সেই সব অভিমান মুহুর্তের মধ্যেই ধুয়ে দাও তোমার কোমল হাত দিয়ে। এইটুকুই যা আমাদের মনোমালিন্যর বিস্তৃতি। আমাদের সম্পর্কের টানপোড়েন। আসলে আমার চাওয়ার পরিসর অল্প, আমাদের মধ্যে পড়ে থাকা ব্যবধান আমাদের নিজস্বতাকে সমৃদ্ধ করে, আমাদের আকর্ষণকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে, ফলে এর মধ্যে কোন ফাঁকি থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি তো তোমার থেকে শুধু নিতেই শিখেছি, কিছুই তো দিতে পারি নি। তুমি নিজেই এত সম্পদশালী যে, তোমাকে কিছু দিতে পারার মত ক্ষমতা আমার নেই। যখন চেয়েছি, তুমি এসে শুধু ভরিয়ে দিয়ে গেছ আমাকে। কোন প্রত্যাশা না করেই। আমি শুধু দুহাত পেতে নিয়েছি, নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি। আর তুমি তাই দেখে আনন্দে হেসেছ। তৃপ্তিতে তোমার বুক ভরে গেছে। সত্যি বলতে কী, আমি তোমার থেকে ‘দেওয়া’ শিখেছি। কীভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়, শেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার মত অতটা নিঃস্বার্থ হয়ে পারি নি। আর পারবোও না।  তুমি যেভাবে দাও, সেটা তোমাকেই মানায়, তোমার স্বভাবসিদ্ধ এই দেওয়া। আমার চেষ্টাটুকু আছে কেবল। কিন্তু পুরোপুরি তোমার মত হওয়ার ক্ষমতা নেই। আর যদি পুরোটা তোমার মত হয়েই যাই, সেটা কেবল মিমিক্রির মত মনে হবে। কারুর অন্ধ অনুকরণ করতে আমি পারি না।
      যাই হোক, আর কথা বাড়িয়ে তোমায় ‘বোর’ করব না। এবার একদিন চলেই এসো। আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। মুখোমুখি হই আমরা আরেকবার। ভিজব খুব তো নিশ্চই, কিন্তু তার থেকেও বড় পাওনা হবে তোমার সঙ্গে মুখোমুখি বসে তোমার কথা শোনা। আচ্ছা তোমারও কি এমন ইচ্ছে হয় না? যদি হয় তাহলে আর দেরী ক’র না প্লিজ!
                                                                       
-   ইতি
তোমার একান্ত ফ্যান

     আমি   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন