মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

পিয়ালী বসু ঘোষ



সাঁঝবিহান (তৃতীয় পর্ব)


সকালের চা টা নিয়ে সতীশ বাইরের দাওয়াতে মাদুর বিছিয়ে বসেছে রোজকার মতই l বাড়ীর হাতার মধ্যে জামরুল গাছের ডালে একটা জোড়া বসন্ত বৌরী এসে বসেছে l ওদেরই দেখছিলো l এমন সময় ফজিরাম এলো l গায়ের কালো চাদর টা নামিয়ে রেখে মুখটা কালো করে দাওয়ায় বসল l সতীশের ভিতরে গত রাত্রের ছবিটা বিদ্যুৎ চমকের মত ভেসে এলো l 

কাল অনেক রাত্রে যখন চারপাশ নিস্তব্ধ ,শুধুই ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছেনা তখনই এক ভয়ার্ত উৎকণ্ঠিত রমণী কণ্ঠ ফজিরাম কে বাইরে থেকে ডাকছে শুনতে পেলো l সেই ডাকের মধ্যে এমন কিছু ছিল যে সতীশের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো l সতীশ তড়িঘড়ি উঠে দরজা খুলে বাইরে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো ,ভাবল এভাবে বেরোনো ঠিক হবে কিনা ! তখনই ফজিরামের গলার শব্দ শুনে দরজা খুলে বাইরে এলো l দাঁড়াল খানিক দূরত্ব বজায় রেখে l 

কুপির দপদপিয়া আলোয় যেটুকু দেখলো সতীশ তাতে মহিলাটি একবার ফজিরামের পায়ে ধরছে আর একবার মাটিতে বসে পরে বুকফাটিয়ে কাঁদছে ,আর অবিরাম বলছে," তুই একবার বললেই ডাগদর বাবু যাবে ফজি দাদা l"  ফজিরাম না সূচক ঘাড় নাড়ছে আর বলছে ,এখন তুই যা কলমী সকালে দেখা যাবে l বাবু এখন ঘুমাচ্ছে l ডাকা যাবেনা l মহিলাটি চোখে আগুন জ্বেলে বলল , "তোর নিজের মেইয়ে হলে তুই একথা বলতে পারতি ?"পরক্ষণেই কেঁদে ভাসিয়ে বলল ,"মেয়েটা আমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে" গো ,সকাল অবধি যদি না বাঁচে !!

এমন সময় সতীশকে দরজার কাছে দেখেই কালবিলম্ব না করে লুটিয়ে পরে সতীশের পায়ে l সতীশ কান্নার দমকের মাঝে যেটুকু বোঝে তাতে তার মেয়েকে রাতের অন্ধকারে কারা যেন গণধর্ষণ করে l তাই সে ছুটে এসেছে ডাগদর বাবুর কাছে l কিন্তু রোগীর চিকিৎসা সতীশ করবে কি করে ?তাই কলমী কে সে বলল মেয়েকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যেতে l কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবার ঝক্কি অনেক বিশেষতঃ এই অঞ্চলে সেটা বোঝে l.......মাইল দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে করতেই হয়তো মেয়েটা মরেই যেত l 

বেশি দেরী না করে ফজিরাম কে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সতীশ কলমীর বাড়ীর পথে l অন্ধকার পথে কলমী তখন বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছুটছে l পিছনে সতীশ এবং দু'পা আগে ফজিরাম l ফজিরামের ঘাড়ে ওর পুরনো আমলের বাঘ স্বীকারের রাইফেলটা lহাতে একটা হ্যারিকেনহঠাৎই চারদিক কাঁপিয়ে ভয়ংকর একটা আর্তনাদ করে ডেকে উঠলো একটা পাখি l আমি আবছা আলোয় দেখলাম সামনের বাজপড়া তাল গাছের মাথা থেকে কি যেন একটা উড়ে গেলো l আমি জানি এটা পাখিই কিন্তু ফজিরাম বলে অশুভ আত্মা l কি জানি ! এই পাহাড়জঙ্গলে আধা অন্ধকার পরিবেশে কিছুই অসম্ভব না যদিও l 

একসময় কখন কলমীর কুয়োতলির ধারে এসে দাঁড়ালো ওরা l বিভ্রান্ত কলমী তখন মেয়ের ক্ষতবিক্ষত শরীরটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে আর চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে দিতে বলছে "একবার্ চোখ মেলে দ্যাখ সাঁঝ ,ডাগদর বাবু এসেছে.....মা আমার.....চোখ খোল "
ওই অস্পষ্ট অন্ধকারে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যেতেই সতীশ চাপা স্বরে বলল..শাল্মলীঈঈঈঈঈঈঈ......
কলমী শুনতে পেয়ে বলল ,না ডাগদর বাবু... সাঁঝ ,আমার সাঁঝ গো 
তুমি শিগগির দ্যাখো....এই বলে ওষুধের বাক্সটা ওর হাত থেকে নিয়ে ওকে টানতে টানতে সাঁঝের কাছে নিয়ে গেলো l

(ক্রমশঃ)


ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার : চন্দ্রাণী বসু 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন