মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

স্বনির্ভরতা এবং আজকের নারী


চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে,
সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে।

আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি পৃথিবী  সেখানে খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের বাইরে এক অনন্ত দুনিয়া ।  চার দেওয়ালের ঘর উঠোনকে কে আজ আর কল্পনায় রঙিন করার দরকার নেই । এক বর্ণময় মানচিত্রে সামনে আজকের  মায়েরা , বোনেরা । তার আজ সেই দুনিয়ায় সাহসী পা রেখেছে  । একটু একটু এগিয়েছে অনেকগুলি সোপান । কিন্তু ছবিটা তো এরকম ছিলনা ।  যদি ফিরে তাকাই  অতীত ইতিহাসের দিকে।  তাহলে কি দেখব আমরা । দেখব যে ইতিহাসের পর্বে পর্বে যে কঠিন কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে তা অশ্রু মোচনের ইতিহাস , বেদনার ইতিহাস  যা পাঠ করতে গেলে  ভারি হয়ে আসে বুকের বাতাস । মর্ম বেদনা এসে ধাক্কা লাগে হৃদয়ের কার্নিশে  । এই পৃথিবীর মাটিতে নারী নিপিড়ন ও নৃশংস নির্যাতনের যে গ্লানি আছে, তা বনপুড়া আগুনের মতো ইতিহাসের পাতায় পাতায় দাউ দাউ করে শুধু  জ্বলছেনা জ্বলে উঠছে প্রতিবাদের বহ্নিশিখায় । । হাজার হাজার বছর ধরে নারীরা পাহাড় থেকে নেমে  খরস্রোতা নদীর মতো নেমে আসা কান্নায়  বুক ভাসিয়েছে। সতীদাহের আগুনে পুড়ে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে জীবনের পর জীবন । তা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে রামমোহন , বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ অগনন মানবের আবির্ভাব ঘটেছে এই পৃথিবীতে । উনবিংশ শতাব্দী ছিলো প্রকৃত অর্থেই  নারীমুক্তি আন্দোলনের । নারী মুক্তির সূচনা লগ্নের সময়টার দিকে যদি তাকিয়ে দেখি তাহলে লক্ষ্য করা যাবে । নারীর  বেদনার্ত জীবনে কঠোর পথ  কঠিন কষ্টকর পীড়ন এবং শৃঙ্খলিত জীবন থেকে নারীরা মুক্তির পথ খুঁজে পায় এই শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তখনকার পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের দ্বারা শৃঙ্খলিত নারীদের মুক্তি আন্দোলন কিন্তু সর্বপ্রথম পুরুষরাই শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায় তিনিই দেখিয়েছিলেন আলো ।রাজা রামমোহন উত্তর নারীমুক্তি আন্দোলনে  অম্লান জ্যোতির্বলয়  তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সনাতনপন্থী পরিবেশে রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে  সংস্কৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও  গ্রামীন পরিকাঠামো থেকে উঠে এলেও  তিনিই প্রথম আধুনিক মানুষ । যা গ্রাম শহরের ভেদরেখা দিয়ে নির্নয় করা যায় না ।  অজস্র কুসংস্কারযুক্ত হিন্দু সমাজে লালিত হয়েও বিদ্যাসাগর সমকালীন সামাজিক কুপমন্ডুকতা ও ধর্মের নামে  অধর্মের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছিলেন।  ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন এই স্থবির অচলায়তন । তিন বুঝেছিলেন স্ত্রী শিক্ষার প্রসার না হলে নারীমুক্তি শুধুমাত্র এক আভিধানিক এবং অলীক শব্দকোষ ।
এত কথা বলার প্রয়জন ছিলনা । বললাম এই জন্য যে আজকের নারীর অবস্থান নিরুপন করার জন্য রেফারেন্স ফ্রেম জানা অত্যন্ত জরুরি ।
আজকের নারী যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে । কীভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে । তা বলতে গেলে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস না হোক প্রাথমিক পর্ব তুলে ধরতেই হয় । এই বিষয়ে অনেককথাই লেখার ছিল কিন্তু কিছুই লেখা হবে না । পারমিতা আধদিন মাত্র সময় দিয়েছে এই নিবন্ধ লিখতে । কী গভীর পড়াশোনা করে এই বিষয়ে লিখতে হয় তা আমি জানি । এবং এও জানি পারমিতা আমার চেয়ে খুব ভালো লিখত মেয়েদের কথা । কিন্তু সে আমাকে এই প্রথম লিখতে বলল । না বলার হিম্মত আমার নেই ।  স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের মধ্য দিয়ে চিন্তা চেতনার বিস্তার যেমন ঘটল পাশাপাশি আর্থিক স্বনির্ভতার দিকেও শুরু হল প্রাথমিক পদযাত্রা । স্বাক্ষর মায়ের সন্তান নিরক্ষর হয়না । অর্থাৎ একজন নারীর শিক্ষিত হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পারিবারিক শিক্ষার মানচিত্রও প্রসারিত হল । শুধু এই নয় পরবর্তী ক্ষেত্রে  নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি তথা উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষটিও  বিকাশলাভ করল । সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব ক্ষেত্রেই নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নারীর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টিকেও নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমান  পঞ্চায়েত স্তর অবধি প্রসারিত এই ক্ষমতায়ন । আজকের  নারীরা যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন,  সংসারের পাশাপাশি দেশ ও প্রশাসন পরিচালনা করতে পারছেন, নিজেদের ভাবনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন  আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করতে পারছেন, নারীর অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারছেন তার প্রধান কারণ অধিকহারে নারীদের প্রতিনিধিত্ব তথা ক্ষমতায় অধিষ্ঠান। এই ইতিবাচক প্রবণতা এই অগ্রসরন  যতই বৃদ্ধি পাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও  বদলাতে বাধ্য  হবে, দেশে নারী নির্যাতনও কমে আসবে।মানুষ হিসেবে সামাজিক  অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়েই একসময় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয়েছিল। সেই লড়াই এখনও চলছে। আপাতদৃষ্টিতে গত দুশ বছরে নারীর অনেক অর্জন আছে। তারপরও পুরুষতন্ত্রের সর্বগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী সমাজ নারীকে সব সময়ই পেছনে টেনে ধরে রাখছে। ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লাগাতার চলবে সচেতন অভিযান ।
     গ্রামের মেয়েদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল একেবারে রুট লেভেল থেকে শুরু হয়েছে  স্বসহায়ক দলগুলির পথচলা। অথচ এই পদক্ষেপেও সারা দেশে এবং রাজ্যে অর্থনৈতিক ভিত্তির  টলমল  ভাবটা   যায়নি। এখন তো বেশিরভাগ স্বসহায়ক দলই ধুঁকছে।  প্রায় অধিকাংশ জায়গাতেই তা নিষ্ক্রিয় । সেগুলিকে সক্রিয় করার তেমন উদ্যোগও নেই প্রশাসনের তরফে বা স্থানীয় মহিলাদের পক্ষ থেকে ।  একটা সময় অনেক আশা নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়ে করে স্বসহায়ক দলগুলি তৈরি হয়েছিল ।  পরবর্তী কালে নজরদারির অভাব লক্ষ্য করা যায় । সারা দেশে বা রাজ্যে  স্বসহায়ক দলের প্রসারের কারণটা কী? এখানকার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। কিন্তু  আজকের নিম্নচাপ নির্ভর চাষও এমন মাত্রায় হয় না, যাতে এলাকা সম্পন্ন হয়ে ওঠে বিকশিত হয় । তা ছাড়া, এলাকায় কোনও কল-কারখানা নেই।  নতুন কারখানা গড়ার উদ্যোগ নেই । কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে দিনদিন । ফলে, স্বসহায়ক দল গড়ার  ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ সেভাবে আর নেই । মেয়েদের স্বনির্ভরতার চেয়ে ভোটব্যঙ্ক হয়ে যাচ্ছে মুল অভিমুখ ।
তবু সামগ্রিক চিত্র খুব হতাশাব্যঞ্জক নয় ।নাগরিক সমাজে নারীদের অধিকার আজ সুপ্রতিষ্ঠিত । আর্থিক এবং সামাজিক স্বনির্ভরতা আজ অনেক পরিস্ফুটিত । গ্রামীন অর্থনীতিও বিকাশমান । প্রতিটি গ্রাম ধরে সমীক্ষা করলে দেখা যাবে আজ মেয়েদের বিদ্যালয় অভিমুখীনতা বেড়েছে , স্কুলছুট কমেছে । কর্ম মানচিত্রেও তার উৎসাহ এবং অংশগ্রহন আশাব্যঞ্জক । অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার পারিবারিক প্রয়াসগুলির বিরুদ্ধেও তারা সোচ্চার । এই স্বপ্ন নিয়েই আমাদের আগামীর দিকে জয়যাত্রা ।   




 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন