মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

বেথুন বেরা



বর্ষার রাতে



বর্ষাকাল মাঝে মাঝেই ঝমঝম্ করে বৃষ্টি এসে যাচ্ছে সব কাজে কর্মেই ব্যাঘাত ঘটছে 

মিতালী এক বছর হলো উলুবেড়িয়া কলেজে পার্ট-টাইমার হিসাবে জয়েন করেছে প্রত্যেকদিনের মতো মিতালী কলেজ ছুটির পর আরও তিনটে ব্যাচ্ পড়িয়ে উলুবেড়িয়া থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরছে বৃষ্টির জন্য আজ তার অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে, বলা যায় এই বর্ষাকালটায় প্রত্যেকদিনই প্রায় দেরী হয়ে যাচ্ছে আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না 

বৃষ্টির পরিমান ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে এখন আবার ঠান্ডা একটা হাওয়া-ঝড়ের মতো হচ্ছে এদিকে ঘড়িতেও প্রায় 'টা বাজে রাত বাড়লে লোকজন কমে যায় বলে সে ফেরার সময় লেডিস্ কামরাটা রোজই অ্যাভয়েড্ করে আজও তাই করেছে দেখতে দেখতে বাগনান স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ালো ট্রেন একেবারে ফাঁকা দু-এক জন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাও সবাই কোলাঘাট অবধি যাবে কিনা কে জানে সত্যিই তাই হলো পরের স্টেশনেই আরো দু-একজন নেমে গেলো এদিকে বৃষ্টির সাথে ঝড়টাও খুব জোরে হচ্ছে এখন হঠাৎ করেই ট্রেনটা বিভৎস্য শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেলো মাঝ রাস্তায় চারিদিক অন্ধকার বাইরে মুশলধারায় বৃষ্টি আর ঝড় চলছে নির্ঘাত ট্রেনে তার ছিঁড়েছে

প্রায় একঘন্টা কেটে গেলো ট্রেন ছাড়ার নামগন্ধ নেই এদিকে রাত বাড়ছে কোলাঘাটে নেমে ট্রেকার, রিক্সা এই বৃষ্টিতে পাওয়া যাবে কি না কে জানে এবার মিতালীর টেনশন শুরু হলো রাত দশটা বাজে মনে হলো, একবার দেখি কামরায় পরিচিত কেউ আছে কিনা...

মুখ ঘুরিয়ে তো মিতালি অবাক সেই কামরায় একটা মাত্র ছেলে কিছুটা দূরে বসে মোবাইলে কি সব খুটখাট করছে আর কেউ কোথাও নেই উল্টোদিকের সিটে বসে আছে, কে বসে আছে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না তাই সে পরিচিত কিনা দেখার জন্য এগিয়ে এলো কথা বলতে কাছে এসেও আবার ফিরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো সে সে অবাক হয়ে গেলো ওটা তো সৌরভ দু'বছর আগেই ওদের ডিভোর্স হয়েছে তার সাথে একই কামরায়... এবার টেনশনের সাথেই অন্যরকম একটা ফিলিংস অ্যাড হলো মিতালীর বাড়ি ফেরার চিন্তার সাথে পুরোনো দিনের বিভিন্নরকমের কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করলো

দেখতে দেখতে আরও এক ঘন্টা কাটলো এগারোটা বেজে গেছে বাইরে ঝড়, বৃষ্টি আরও বেড়েছে এবার আর অপেক্ষা করতে পারলো না মিতালী সৌরভের কাছে উঠে এসে বসলো সে চাপা গলায় বলতে গেলো
- সৌরভ, তুমি কি...

- হ্যাঁ মিতা, আমি দিয়ে আসবো তোমাকে বাড়ি অবধি, চিন্তা করো না


সৌরভ যেন আগে থেকেই জানতো মিতালী এই কামরায় উঠেছে সৌরভের বাড়ি অর্থাৎ মিতালীর শ্বশুর বাড়িটা স্টেশন সংলগ্ন 

- থ্যাঙ্ক ইউ সৌরভ...

- অল রাইট,

- কেমন আছো?

- চলে যাচ্ছে...

- তোমার মা?

- ওই আছে, বয়স বাড়ছে... একা একা, জানোই তো...


মিতালী কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না সে নেই বলেই তো আজ সৌরভের মা একা তাও মিনিটখানেক পর কাঁপা গলায় বলার চেষ্টা করলো...

- একা কেন? সঞ্চারী? সে নেই...?

- মিতালী প্লিজ্ তোমার মাথা থেকে এই ভুল ধারনাটা সরানো আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব আজ দয়া করে এই টপিক্ টা বাদ রাখো

- নতুন করে কিছু ভাবছো না?

- নতুন...!! কিসের নতুন? আমাকে কি মনে হয় তোমার

- হ্যাঁ নতুন কিছু, এই ভাবে তো সারা জীবন চলতে পারে না... মা এর বয়স হচ্ছে

- হুম নতুন কিছু ভাবছি, তবে নতুন কাউকে নিয়ে নয়...

- তাহলে?

- আগে বলো কোথায় গিয়েছিলে, আগেও দু-একদিন দেখলাম...

- উলুবেড়িয়া কলেজে পার্টটাইম করছি

- এতো রাত?

- টিউশন পড়িয়ে ফিরি কি ভাবছো এবার বলো, অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে তোমার...

- ভাবছি, তোমার সাথেই আবার শুরু করা যায় না? নতুন করে মানছি দু'জনেরই অনেক ভুল ছিলো তবুও শুরু তো করাই যায় নতুন করে...


মিতালী মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ পর বোঝা গেলো সে কাঁদছে সৌরভ এবার মিতালীকে ছুঁলো, কিছুটা ইতস্তত ছিলো দুবছর হয়ে গেছে সে মিতালীকে স্পর্শ করেনি সারা শরীরটা সৌরভের কাঁটা দিয়ে উঠলো...

- কি হলো মিতালী কাঁদছো কেন?

- কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব নয় সৌরভ...

- কেন সম্ভব নয়? বলো...

- আমার যে অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক্ হয়ে গেছে...


কথাটা শুনেই সৌরভের বুকের ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠলো, আর তখনই ভীষন রকম একটা কাঁপুনি দিয়ে উচ্চস্বরে হর্ন দিয়ে ট্রেনটাও ছেড়ে দিলো তারপর স্টেশন আসা অবধি আর কেউ কারোর সাথে কথা বলেনি... শুধু দুজনের চোখের জল যেন একটা অন্য বর্ষাকালের সৃষ্টি করেছিলো 

স্টেশনের বাইরে এসে দেখলো তখনও শেষ ট্রেকার ছাড়েনি মিতালী তাই ট্রেকারেই যাওয়াই স্থীর করলো সৌরভ বললো -

- আমি তো দিয়ে আসতাম

- না ঠিক্ আছে... (ট্রেকারে উঠতে উঠতে বললো)

- বলছি, আর কি কোন উপায়ই নেই?

- না গো...

- ফোন নম্বর কি একই আছে?

- না চেঞ্জ করেছি

- নম্বরটা দাও...

- কি দরকার? কষ্ট বাড়িয়ে? থাক্ না...

- আমার কিছু কথা ছিলো...

- অনেক দেরী করে ফেলেছো সৌরভ...

- এতো বড়ো একটা ডিসিশন নিলে... একবার আমার কথা ভাবলে না?

- দুটো বছর কম নয় সৌরভ, একবারও কি যোগাযোগ করা যেত না? বলো...

- আর একটা সুযোগ দাও প্লিজ্ মিতা কথা দিচ্ছি আর কখনও এরকম হবে না... একটা সুযোগ দাও, প্লিজ্...

- আর যে কোন রাস্তা খোলা নেই সৌরভ...

- প্লিজ্ মিতা... বিয়ে তো হয়ে যায়নি বলো...

- তোমাকে অনুরোধ করছি, এই ব্যাপারে আমায় কিছু বলো না, আমার আর কোন উপায় নেই... অনেক রাত হয়েছে, সাবধানে বাড়ি যাও...

- আর আজকে কিভাবে বাড়ি ফিরলে জানবো কিভাবে? আমার যে টেনশন হবে...

- এই একবছর যেভাবে ফিরেছি...সেইভাবেই আর তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই খবর পাবে...

- মিতা (চেঁচিয়ে উঠলো সৌরভ...)


বলতে বলতেই ট্রেকার ছাড়লো... সৌরভের মুখ থেকে আর কোন কথা বের হলো না দুবছর আগের আলাদা হওয়ার থেকেও আজকে মিতালীর চলে যাওয়াটা যেন অনেক কষ্টের, অনেক বেদনার... আলাদা হওয়াটা অন্যরকম ছিলো, কিন্তু মিতালী অন্যকারো হবে এটা মেনে নেওয়ার জন্য সৌরভ মোটেও প্রস্তুত ছিলো না অস্বীকার করারও তো উপায় রইলো না.... মনে মনে বলতে লাগলো - "তুমি ভালো থেকো মিতালী, সুখে থেকো...."

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন