বেলাশেষের বৃষ্টি
ফোনের রিংটা বাজতেই ছ্যাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় কাজরীর । কাচের জানলার ভারী পর্দার সামান্য ফাঁক দিয়ে একটুকরো পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে লিভিংস্পেসের এককোণে । দিনের শেষের পড়ন্ত সূর্যরশ্মি । দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস কাজরীর কোনদিন-ই ছিলনা । খাওয়া-ঘুম কোনোকিছুর-ই কি নির্দিষ্ট অভ্যাস ছিল কাজরীর । কাজের শিডিউল মতো সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়েছে সারাজীবন । এখন অবশ্য আর সেভাবে কাজের তাড়া নেই । নিজের ইচ্ছাতেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে কাজরী । এখন যেটুকু করে তা নিতান্তই শখে । আজকাল একটা অবসন্নতা মাঝেমাঝেই ঘিরে ধরে কাজরীকে । জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে আসতে কখনো এমন ক্লান্তি বোধ হয়নি । হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দেয় । সাড়ে তিনটে বাজে মাত্র । এখন আবার কে ফোন করলো !!!!! ইণ্ডাস্ট্রির কেউ তো বারোটা থেকে ছটার মধ্যে ফোন করবে না । তবে কি দাদার কিছু হলো ? গত পরশুদিন বৌদি ফোনে বলছিল , দাদার প্রেসারটা ভীষণ বেড়েছে , সাথে সামান্য শ্বাসকষ্ট । বিছানা থেকে নেমে দ্রুতপায়ে লিভিংস্পেসে আসে কাজরী ।
বেতের সোফাসেট আর কাচের সেন্টারটেবিলের একপাশে স্ট্যাণ্ডল্যাম্পটা রাখা । তারপাশেই সাইডটেবিলে টেলিফোনটা রাখা । একদম ব্যক্তিগত কিছু মানুষের সাথে ছাড়া মোবাইল নম্বরটা ব্যবহার করে না কাজরী । দরকারী-অদরকারী সব কথাবার্তাই এই ল্যান্ডফোনে ।
তাড়াতাড়ি আসতে গিয়েই বোধহয় কাপ্তানের একটা কোনা আটকে গেল সাজানো এরিকা পামের পাতায় । একটু টান দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো কাজরী । আলতো হাতে ছাড়িয়ে নিল কাপ্তানটাকে ।
রিসিভারটা তুললো কাজরী,- হ্যালো ?
-- ম্যাডাম....আমি মহেশ বলছি....
কাজরী অবাক হলেন । এতবছর পর মহেশ ফোন করেছে ? একসময় ইণ্ডাস্ট্রিতে মেক-আপ ম্যানের কাজ করতো , তারপর তো বম্বে চলে গিয়েছিল । এতদিন পরে হঠাৎ.....!!!!
জিজ্ঞাসা করলো , -- কি ব্যাপার ?
---- একটা খারাপ খবর আছে ম্যাডাম । ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা । তারপরে আবার স্বর ফুটলো , সুনন্দ সরকার আজ দুপুরে মারা গেছেন । নিজের বাড়িতেই হঠাৎ স্ট্রোক । হসপিটাল নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ ।
এমন একটা খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই বোধহয় মহেশের কথাটা মগজাস্ত হতে একটু সময় লাগলো কাজরীর ।
মহেশ তখনো বলে চলেছে , হাসপাতাল থেকে বডি আগে চন্দ্রালোক স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হবে , তারপর ওনার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ি হয়ে সোজা শ্মশানে । ওনার ভাইপো খবর পেয়েই দিল্লি থেকে ফ্লাইটে রওনা দিয়েছেন ।
মহেশ হঠাৎ সুনন্দর মৃত্যু সংবাদটা কাজরীকে জানাতে এলো কেন ?
গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে কাজরীর । একটা ঢোক গিলে কিছু বলতে যাওয়ার আগে মহেশ-ই বলে ,--- আপনি আসছেন তো ম্যাডাম ?
সুনন্দ সরকার মারা গেছেন । সেখানে কাজরী মৈত্রর যাওয়াটা কি সত্যিই প্রয়োজনীয় !!!!
মহেশকে হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল কাজরী , কিন্তু ততক্ষণে মহেশ ফোনটা কেটে দিয়েছে ।
সুনন্দ সরকার একসময়ের সেরা অভিনেতা ছিলেন , তাঁর মৃত্যু সংবাদ এতক্ষণে নিশ্চই নিউজ চ্যানেলগুলো জেনে গেছে ।
আনমনা ভাবেই টিভিটা অন করে কাজরী । সব চ্যানেলেই দেখাচ্ছে সুনন্দর মৃত্যুসংবাদ , সাথে ওর অভিনয় জীবনের টুকরো টুকরো ছবি । একটা ছবিতে হঠাৎ যেন রক্তকণিকার গতি বেড়ে যায় কাজরীর ।
কোনো একটা গানের দৃশ্যে সুনন্দর বক্ষলগ্না হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে দুজনে.......
একঝটকায় যেন অনেকগুলো বছর পিছিয়ে যায় কাজরী । বাংলা সিনেমা জগতের একনম্বর জুটি তখন কাজরী-সুনন্দ । শ্যুটিং এর জন্য সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াচ্ছে দুজনে তখন । সেবার কেরালা গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল কাজরী । ডাক্তারের পরামর্শে তিনমাস টানা বিশ্রাম । ঐ তিনমাসের অবসরেই কাজরী বুঝেছিল , সুনন্দ নিজের অজান্তেই কখন যেন ঢুকে পড়েছে জীবনের রঙ্গমঞ্চে । প্রেম বিনিময় হতে সময় নেয়নি তারপর । নতুন জীবন তখন দুচোখে স্বপ্ন আঁকছে কাজরীর । নতুন জীবন-নতুন সংসার-নতুন নতুন স্বপ্ন ।
তখনি কাজরীর জীবনের সবথেকে বড়ো দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল । এক রাতে শ্যুটিং সেরে ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার আর ওর সেক্রেটারির সামনেই একদল নরখাদক ......
চরমতম সর্বনাশটাও হয়তো হয়ে যেতো সেদিন , যদি না পুলিশের গাড়িটা সেদিন দেবদূতের মতো এসে পড়তো ঐখানে । দোষীরা ধরা পড়েছিল , শাস্তিও হয়েছিল । রূপালী জগৎ তখন তোলপাড় কাজরীকে নিয়ে । কাজরী কিছুতেই ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । সেইসময় সুনন্দকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল কাজরীর । অথচ সুনন্দ তখন বম্বেতে । খবরটা পেয়েও ছুটে আসেনি কাজরীর কাছে .....
কলিংবেলের আওয়াজটাতেও যেন চমকে ওঠে কাজরী ।
আইহোলে দেখে নিয়ে দরজা খুলে দেয় ।
ছবি ফিরে এসেছে । কাজরীর সংসারের সব কাজ , রান্নাবান্না সব ওই সামলায় । পিছুটান বলতে তেমন কেউ নেই । কালেভদ্রে দুপুরবেলা মেয়ের সাথে দেখা করতে যায় । যেমন আজকেও গিয়েছিল ।
-- ম্যাডাম , আপনার চা
চায়ে চুমুক দিতে দিতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় কাজরী । কংক্রিটের শহরেও এখান থেকে কিছুটা সবুজ দেখা যায় এখনো ।
নিস্তেজ রোদ্দুর । গোমড়া আকাশের নীচে পৃথিবীটা কেমন যেন মনমরা আজ । হয়তো বৃষ্টি আসবে ।
বৃষ্টি বরাবর-ই ভীষণ প্রিয় কাজরীর ।
ম্যাডাম আপনার ফোন....
ছবি মোবাইলটা শোবার ঘর থেকে এনে দিতেই খেয়াল করলেন , তিনটে মিসড্ কল । প্রমিতা ফোন করেছিল । সাইলেন্ট করা ছিল বলে শুনতেই পায়নি । নিশ্চয় সুনন্দর মৃত্যু সংবাদটাই দেবে । ভাবতেই ভাবতেই আবার বেজে ওঠে মোবাইলটা ।
সুনন্দ আর কাজরীর সম্পর্কের গ্রাফের ওঠানামার সবটুকুই প্রমিতার জানা । তাই হয়তো চন্দ্রালোক স্টুডিওতে সুনন্দকে শেষবারের মতো নিয়ে আসার খবরটুকুই দিলো , কাজরীকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি ।
বাইরে গুমোট বিকাল , আকাশটা চুনকালি মেঘে ঢাকা । পড়ন্ত চৈত্রেও আজ সূর্যের তাপ ম্রিয়মাণ , গাছপালাগুলোও যেন অভিমানে নিথর । এ কি ঝড়ের পূর্বাভাস !!!!
পরেশকে একটা ফোন করে নেয় । ও আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বে । বহুদিন ধরেই কাজরীর গাড়ি চালাচ্ছে পরেশ । আজকাল তেমন আর বেড়নো নেই কাজরীর । পরেশকে সারাদিনের জন্য আটকে না রেখে প্রয়োজন মতো ডেকে নেন । যদি অন্য কারো গাড়ি চালিয়ে বাড়তি দুটো পয়সা রোজগার করে করুক ।
কাপ্তানটা ছেড়ে অভ্যস্ত হাতে শাড়ি পড়ে নেয় কাজরী । শাড়িতেই যেন সবথেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কাজরী ।
গরম পড়ে গেলেও চামড়ায় একটা টান আসে আজকাল , হয়তো বয়সের জন্যই । হালকা হাতে বডিলোশন লাগাতে লাগাতে আয়নাতে নিজেকে দেখেই যেন চমকে ওঠে কাজরী । কিছু না ভেবেই আশমানী রঙের লক্ষ্ণৌচিকনের শাড়িটা পড়েছিলেন । সুনন্দ বলতো , আশমানী রঙে নাকি কাজরীকে সবথেকে বেশি মানায় ।
সময়ের সাথে সাথে রঙজ্বলে হলদেটে হয়ে যাওয়া কতো ছবি ভিড় করছে মনের খাতায় ।
শ্যুটিং এর প্রয়োজন ছাড়া চড়া মেক-আপ পছন্দ নয় কাজরীর । প্রয়োজন মতো সামান্য প্রসাধনে অল্প সময়েই তৈরি হয়ে নিল ।
গাড়ির এসিটাতে কেমন যেন শীতশীত ভাব লাগছে কাজরীর । জ্বর আসবে নাকি !!!! নাকি নার্ভাসনেস থেকে অকারণেই বেড়ে গেলো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ !!!! হয়তো না এলেই হতো....
রাস্তায় তেমন যানজট না থাকায় আধঘন্টার মধ্যেই সিনেমা পাড়ায় পৌঁছে যায় ।
এসে গেছি ম্যাডাম....
এসে গেছি কথাটাতে আবারো যেন "না এলেই হতো" ভাবনাটা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে কাজরীর । বুকের মধ্যে কি এক বিজবিজে অস্বস্তি ।
সুনন্দ সরকারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছে কাজরী মৈত্র । মিডিয়া এতোবড়ো খবরটা তো বেশ ফলাও করে কভার করবে । সব জেনেও কিসের টানে যে ছুটে এলেন নিজেই বুঝতে পারছে না ।
পরেশ গাড়ির দরজা খুলে দিতেই মিডিয়ার লোক হামলে পড়ে । ঘন ঘন ঝলসে উঠছে ক্যামেরা । এই সব কিছুতেই বহুদিন ধরে অভ্যস্ত কাজরী , তবু আজ যেন ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে । কালো চশমাও সাথে নেই । চোখ দুটো আড়াল করলে খুব সহজেই বাইরের মানুষের থেকে নিজের অভিব্যক্তিটা লুকিয়ে রাখা যায় ।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্ধ্বে সুনন্দ তো একজন শিল্পী । তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোটুকু তো একজন শিল্পী হিসাবে কাজরীর কর্তব্য । নিজেকে একটু মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে কাজরী ।
চন্দ্রালোক স্টুডিওর বিশাল গেট ছাড়িয়ে ভিতরে ঢুকছে । তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে যাতায়াত । দু-একটা চেনা মুখ নজরে পড়ছে । যত এগোচ্ছে তত যেন হাঁটুর জোর নিঃশেষ হয়ে আসছে কাজরীর । রাগ-অভিভান-দুঃখ-ঘৃণা-প্রেম সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । একটু যেন শ্বাসকষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে ।
ফুলের বাগানঘেরা মাঠটার মধ্যে মন্দিরের সেটটার সামনে রাখা আছে সুনন্দর বডি । রূপালী জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর আর পেপারে বা টিভিতেও সুনন্দকে দেখেনি বহুবছর । কোঠরগত চোখ , মাথায় চুল নেই বললেই চলে , ফর্সা রঙটার ওপরেও যেন বাদামী প্রলেপ ......এ কি জীর্ণ চেহারা হয়েছিল সুনন্দর !!!!!
মনের মধ্যে এতদিনের জমানো বিদ্বেষ যেন মরে আসছে , ঘৃণা - দুঃখ সব যেন উবে যাচ্ছে মন থেকে । কোনো করুণা-ক্ষমা বা অপরাধ বোধ নয় , তবু যেন এক অদ্ভুত শূণ্যতা বুকটা জুড়ে ।
সব সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরেও সারাটা জীবন একা কাটানোটার মাঝেও কি কোনো অদৃশ্য বাঁধন ছিল !!!! এই শূণ্যতা কি সেই বাঁধন ছেঁড়ার শূণ্যতা !!!!
সুনন্দর সাথে কাজরীর শেষ দেখা হয়েছিল এই সেটেই । সেই তাদের একসঙ্গে শেষকাজ । একটা বৃষ্টির সন্ধ্যায় নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদের সিন ছিল । সেদিন দুজনেই জানতো এই তাদের শেষ কাজ । রেনমেশিনের জলে কৃত্রিম বৃষ্টি তখন সারা সেটে । মন্দির থেকে ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে নায়িকা । নায়ক আটকাচ্ছে না । শেষবারের মতো পিছু ফিরে তাকালো নায়িকা । দেখলো নায়ক তখনো একটা হাত বাড়িয়ে আছে.....
সিনেমার শেষ দৃশ্য .....
শেষবারের মতো সুনন্দর দিকে ফিরে তাকানোর সময় সত্যিই দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল কাজরীর । রেনমেশিনের কৃত্রিম বৃষ্টির সাথে সেদিন মিলেমিশে বোধহয় এক হয়ে গিয়েছিল কাজরীর চোখের জল । রেনমেশিনের জলের সাথে কাজরীর চোখের জলকে সেদিন আলাদা করতে পারেনি সুনন্দ !!!!!
দুফোঁটা জল যেন গায়ে এলো । আজকেও কি কোনো ফ্লোরে রেনমেশিন চালিয়ে শ্যুটিং হচ্ছে !!!!!
ম্যাডাম বৃষ্টি পড়ছে , ভিতরে চলুন ।
ওহ্ বৃষ্টি পড়ছে !!!!
ছেলেটিকে চিনতে পারে না কাজরী , মনে হয় নতুন এসেছে এই লাইনে ।
একটু অবাক চোখেই যেন দেখছে কাজরীকে ।
অগোচেরে গড়িয়ে পড়া চোখের জলটুকু বোধহয় ধরা পড়ে গেলো ছেলেটির কাছে ।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মোছার অছিলাই চোখের কোণটা মুছে নেয় কাজরী । চেনা মানুষগুলোর আর ক্যামেরার ফ্লাস থেকে জলটুকু লুকোতেই হবে কাজরী মৈত্রকে.....
ফোনের রিংটা বাজতেই ছ্যাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় কাজরীর । কাচের জানলার ভারী পর্দার সামান্য ফাঁক দিয়ে একটুকরো পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে লিভিংস্পেসের এককোণে । দিনের শেষের পড়ন্ত সূর্যরশ্মি । দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস কাজরীর কোনদিন-ই ছিলনা । খাওয়া-ঘুম কোনোকিছুর-ই কি নির্দিষ্ট অভ্যাস ছিল কাজরীর । কাজের শিডিউল মতো সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়েছে সারাজীবন । এখন অবশ্য আর সেভাবে কাজের তাড়া নেই । নিজের ইচ্ছাতেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে কাজরী । এখন যেটুকু করে তা নিতান্তই শখে । আজকাল একটা অবসন্নতা মাঝেমাঝেই ঘিরে ধরে কাজরীকে । জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে আসতে কখনো এমন ক্লান্তি বোধ হয়নি । হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দেয় । সাড়ে তিনটে বাজে মাত্র । এখন আবার কে ফোন করলো !!!!! ইণ্ডাস্ট্রির কেউ তো বারোটা থেকে ছটার মধ্যে ফোন করবে না । তবে কি দাদার কিছু হলো ? গত পরশুদিন বৌদি ফোনে বলছিল , দাদার প্রেসারটা ভীষণ বেড়েছে , সাথে সামান্য শ্বাসকষ্ট । বিছানা থেকে নেমে দ্রুতপায়ে লিভিংস্পেসে আসে কাজরী ।
বেতের সোফাসেট আর কাচের সেন্টারটেবিলের একপাশে স্ট্যাণ্ডল্যাম্পটা রাখা । তারপাশেই সাইডটেবিলে টেলিফোনটা রাখা । একদম ব্যক্তিগত কিছু মানুষের সাথে ছাড়া মোবাইল নম্বরটা ব্যবহার করে না কাজরী । দরকারী-অদরকারী সব কথাবার্তাই এই ল্যান্ডফোনে ।
তাড়াতাড়ি আসতে গিয়েই বোধহয় কাপ্তানের একটা কোনা আটকে গেল সাজানো এরিকা পামের পাতায় । একটু টান দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো কাজরী । আলতো হাতে ছাড়িয়ে নিল কাপ্তানটাকে ।
রিসিভারটা তুললো কাজরী,- হ্যালো ?
-- ম্যাডাম....আমি মহেশ বলছি....
কাজরী অবাক হলেন । এতবছর পর মহেশ ফোন করেছে ? একসময় ইণ্ডাস্ট্রিতে মেক-আপ ম্যানের কাজ করতো , তারপর তো বম্বে চলে গিয়েছিল । এতদিন পরে হঠাৎ.....!!!!
জিজ্ঞাসা করলো , -- কি ব্যাপার ?
---- একটা খারাপ খবর আছে ম্যাডাম । ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা । তারপরে আবার স্বর ফুটলো , সুনন্দ সরকার আজ দুপুরে মারা গেছেন । নিজের বাড়িতেই হঠাৎ স্ট্রোক । হসপিটাল নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ ।
এমন একটা খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই বোধহয় মহেশের কথাটা মগজাস্ত হতে একটু সময় লাগলো কাজরীর ।
মহেশ তখনো বলে চলেছে , হাসপাতাল থেকে বডি আগে চন্দ্রালোক স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হবে , তারপর ওনার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ি হয়ে সোজা শ্মশানে । ওনার ভাইপো খবর পেয়েই দিল্লি থেকে ফ্লাইটে রওনা দিয়েছেন ।
মহেশ হঠাৎ সুনন্দর মৃত্যু সংবাদটা কাজরীকে জানাতে এলো কেন ?
গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে কাজরীর । একটা ঢোক গিলে কিছু বলতে যাওয়ার আগে মহেশ-ই বলে ,--- আপনি আসছেন তো ম্যাডাম ?
সুনন্দ সরকার মারা গেছেন । সেখানে কাজরী মৈত্রর যাওয়াটা কি সত্যিই প্রয়োজনীয় !!!!
মহেশকে হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল কাজরী , কিন্তু ততক্ষণে মহেশ ফোনটা কেটে দিয়েছে ।
সুনন্দ সরকার একসময়ের সেরা অভিনেতা ছিলেন , তাঁর মৃত্যু সংবাদ এতক্ষণে নিশ্চই নিউজ চ্যানেলগুলো জেনে গেছে ।
আনমনা ভাবেই টিভিটা অন করে কাজরী । সব চ্যানেলেই দেখাচ্ছে সুনন্দর মৃত্যুসংবাদ , সাথে ওর অভিনয় জীবনের টুকরো টুকরো ছবি । একটা ছবিতে হঠাৎ যেন রক্তকণিকার গতি বেড়ে যায় কাজরীর ।
কোনো একটা গানের দৃশ্যে সুনন্দর বক্ষলগ্না হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে দুজনে.......
একঝটকায় যেন অনেকগুলো বছর পিছিয়ে যায় কাজরী । বাংলা সিনেমা জগতের একনম্বর জুটি তখন কাজরী-সুনন্দ । শ্যুটিং এর জন্য সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াচ্ছে দুজনে তখন । সেবার কেরালা গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল কাজরী । ডাক্তারের পরামর্শে তিনমাস টানা বিশ্রাম । ঐ তিনমাসের অবসরেই কাজরী বুঝেছিল , সুনন্দ নিজের অজান্তেই কখন যেন ঢুকে পড়েছে জীবনের রঙ্গমঞ্চে । প্রেম বিনিময় হতে সময় নেয়নি তারপর । নতুন জীবন তখন দুচোখে স্বপ্ন আঁকছে কাজরীর । নতুন জীবন-নতুন সংসার-নতুন নতুন স্বপ্ন ।
তখনি কাজরীর জীবনের সবথেকে বড়ো দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল । এক রাতে শ্যুটিং সেরে ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার আর ওর সেক্রেটারির সামনেই একদল নরখাদক ......
চরমতম সর্বনাশটাও হয়তো হয়ে যেতো সেদিন , যদি না পুলিশের গাড়িটা সেদিন দেবদূতের মতো এসে পড়তো ঐখানে । দোষীরা ধরা পড়েছিল , শাস্তিও হয়েছিল । রূপালী জগৎ তখন তোলপাড় কাজরীকে নিয়ে । কাজরী কিছুতেই ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । সেইসময় সুনন্দকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল কাজরীর । অথচ সুনন্দ তখন বম্বেতে । খবরটা পেয়েও ছুটে আসেনি কাজরীর কাছে .....
কলিংবেলের আওয়াজটাতেও যেন চমকে ওঠে কাজরী ।
আইহোলে দেখে নিয়ে দরজা খুলে দেয় ।
ছবি ফিরে এসেছে । কাজরীর সংসারের সব কাজ , রান্নাবান্না সব ওই সামলায় । পিছুটান বলতে তেমন কেউ নেই । কালেভদ্রে দুপুরবেলা মেয়ের সাথে দেখা করতে যায় । যেমন আজকেও গিয়েছিল ।
-- ম্যাডাম , আপনার চা
চায়ে চুমুক দিতে দিতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় কাজরী । কংক্রিটের শহরেও এখান থেকে কিছুটা সবুজ দেখা যায় এখনো ।
নিস্তেজ রোদ্দুর । গোমড়া আকাশের নীচে পৃথিবীটা কেমন যেন মনমরা আজ । হয়তো বৃষ্টি আসবে ।
বৃষ্টি বরাবর-ই ভীষণ প্রিয় কাজরীর ।
ম্যাডাম আপনার ফোন....
ছবি মোবাইলটা শোবার ঘর থেকে এনে দিতেই খেয়াল করলেন , তিনটে মিসড্ কল । প্রমিতা ফোন করেছিল । সাইলেন্ট করা ছিল বলে শুনতেই পায়নি । নিশ্চয় সুনন্দর মৃত্যু সংবাদটাই দেবে । ভাবতেই ভাবতেই আবার বেজে ওঠে মোবাইলটা ।
সুনন্দ আর কাজরীর সম্পর্কের গ্রাফের ওঠানামার সবটুকুই প্রমিতার জানা । তাই হয়তো চন্দ্রালোক স্টুডিওতে সুনন্দকে শেষবারের মতো নিয়ে আসার খবরটুকুই দিলো , কাজরীকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি ।
বাইরে গুমোট বিকাল , আকাশটা চুনকালি মেঘে ঢাকা । পড়ন্ত চৈত্রেও আজ সূর্যের তাপ ম্রিয়মাণ , গাছপালাগুলোও যেন অভিমানে নিথর । এ কি ঝড়ের পূর্বাভাস !!!!
পরেশকে একটা ফোন করে নেয় । ও আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বে । বহুদিন ধরেই কাজরীর গাড়ি চালাচ্ছে পরেশ । আজকাল তেমন আর বেড়নো নেই কাজরীর । পরেশকে সারাদিনের জন্য আটকে না রেখে প্রয়োজন মতো ডেকে নেন । যদি অন্য কারো গাড়ি চালিয়ে বাড়তি দুটো পয়সা রোজগার করে করুক ।
কাপ্তানটা ছেড়ে অভ্যস্ত হাতে শাড়ি পড়ে নেয় কাজরী । শাড়িতেই যেন সবথেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কাজরী ।
গরম পড়ে গেলেও চামড়ায় একটা টান আসে আজকাল , হয়তো বয়সের জন্যই । হালকা হাতে বডিলোশন লাগাতে লাগাতে আয়নাতে নিজেকে দেখেই যেন চমকে ওঠে কাজরী । কিছু না ভেবেই আশমানী রঙের লক্ষ্ণৌচিকনের শাড়িটা পড়েছিলেন । সুনন্দ বলতো , আশমানী রঙে নাকি কাজরীকে সবথেকে বেশি মানায় ।
সময়ের সাথে সাথে রঙজ্বলে হলদেটে হয়ে যাওয়া কতো ছবি ভিড় করছে মনের খাতায় ।
শ্যুটিং এর প্রয়োজন ছাড়া চড়া মেক-আপ পছন্দ নয় কাজরীর । প্রয়োজন মতো সামান্য প্রসাধনে অল্প সময়েই তৈরি হয়ে নিল ।
গাড়ির এসিটাতে কেমন যেন শীতশীত ভাব লাগছে কাজরীর । জ্বর আসবে নাকি !!!! নাকি নার্ভাসনেস থেকে অকারণেই বেড়ে গেলো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ !!!! হয়তো না এলেই হতো....
রাস্তায় তেমন যানজট না থাকায় আধঘন্টার মধ্যেই সিনেমা পাড়ায় পৌঁছে যায় ।
এসে গেছি ম্যাডাম....
এসে গেছি কথাটাতে আবারো যেন "না এলেই হতো" ভাবনাটা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে কাজরীর । বুকের মধ্যে কি এক বিজবিজে অস্বস্তি ।
সুনন্দ সরকারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছে কাজরী মৈত্র । মিডিয়া এতোবড়ো খবরটা তো বেশ ফলাও করে কভার করবে । সব জেনেও কিসের টানে যে ছুটে এলেন নিজেই বুঝতে পারছে না ।
পরেশ গাড়ির দরজা খুলে দিতেই মিডিয়ার লোক হামলে পড়ে । ঘন ঘন ঝলসে উঠছে ক্যামেরা । এই সব কিছুতেই বহুদিন ধরে অভ্যস্ত কাজরী , তবু আজ যেন ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে । কালো চশমাও সাথে নেই । চোখ দুটো আড়াল করলে খুব সহজেই বাইরের মানুষের থেকে নিজের অভিব্যক্তিটা লুকিয়ে রাখা যায় ।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্ধ্বে সুনন্দ তো একজন শিল্পী । তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোটুকু তো একজন শিল্পী হিসাবে কাজরীর কর্তব্য । নিজেকে একটু মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে কাজরী ।
চন্দ্রালোক স্টুডিওর বিশাল গেট ছাড়িয়ে ভিতরে ঢুকছে । তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে যাতায়াত । দু-একটা চেনা মুখ নজরে পড়ছে । যত এগোচ্ছে তত যেন হাঁটুর জোর নিঃশেষ হয়ে আসছে কাজরীর । রাগ-অভিভান-দুঃখ-ঘৃণা-প্রেম সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । একটু যেন শ্বাসকষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে ।
ফুলের বাগানঘেরা মাঠটার মধ্যে মন্দিরের সেটটার সামনে রাখা আছে সুনন্দর বডি । রূপালী জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর আর পেপারে বা টিভিতেও সুনন্দকে দেখেনি বহুবছর । কোঠরগত চোখ , মাথায় চুল নেই বললেই চলে , ফর্সা রঙটার ওপরেও যেন বাদামী প্রলেপ ......এ কি জীর্ণ চেহারা হয়েছিল সুনন্দর !!!!!
মনের মধ্যে এতদিনের জমানো বিদ্বেষ যেন মরে আসছে , ঘৃণা - দুঃখ সব যেন উবে যাচ্ছে মন থেকে । কোনো করুণা-ক্ষমা বা অপরাধ বোধ নয় , তবু যেন এক অদ্ভুত শূণ্যতা বুকটা জুড়ে ।
সব সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরেও সারাটা জীবন একা কাটানোটার মাঝেও কি কোনো অদৃশ্য বাঁধন ছিল !!!! এই শূণ্যতা কি সেই বাঁধন ছেঁড়ার শূণ্যতা !!!!
সুনন্দর সাথে কাজরীর শেষ দেখা হয়েছিল এই সেটেই । সেই তাদের একসঙ্গে শেষকাজ । একটা বৃষ্টির সন্ধ্যায় নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদের সিন ছিল । সেদিন দুজনেই জানতো এই তাদের শেষ কাজ । রেনমেশিনের জলে কৃত্রিম বৃষ্টি তখন সারা সেটে । মন্দির থেকে ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে নায়িকা । নায়ক আটকাচ্ছে না । শেষবারের মতো পিছু ফিরে তাকালো নায়িকা । দেখলো নায়ক তখনো একটা হাত বাড়িয়ে আছে.....
সিনেমার শেষ দৃশ্য .....
শেষবারের মতো সুনন্দর দিকে ফিরে তাকানোর সময় সত্যিই দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল কাজরীর । রেনমেশিনের কৃত্রিম বৃষ্টির সাথে সেদিন মিলেমিশে বোধহয় এক হয়ে গিয়েছিল কাজরীর চোখের জল । রেনমেশিনের জলের সাথে কাজরীর চোখের জলকে সেদিন আলাদা করতে পারেনি সুনন্দ !!!!!
দুফোঁটা জল যেন গায়ে এলো । আজকেও কি কোনো ফ্লোরে রেনমেশিন চালিয়ে শ্যুটিং হচ্ছে !!!!!
ম্যাডাম বৃষ্টি পড়ছে , ভিতরে চলুন ।
ওহ্ বৃষ্টি পড়ছে !!!!
ছেলেটিকে চিনতে পারে না কাজরী , মনে হয় নতুন এসেছে এই লাইনে ।
একটু অবাক চোখেই যেন দেখছে কাজরীকে ।
অগোচেরে গড়িয়ে পড়া চোখের জলটুকু বোধহয় ধরা পড়ে গেলো ছেলেটির কাছে ।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মোছার অছিলাই চোখের কোণটা মুছে নেয় কাজরী । চেনা মানুষগুলোর আর ক্যামেরার ফ্লাস থেকে জলটুকু লুকোতেই হবে কাজরী মৈত্রকে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন